সেকেলে ব্যক্তিগত গ্যারান্টিতে ভোগান্তি বাড়ছে

আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার উত্তম চর্চার পরিপন্থী

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০

আইনের অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে অধিকাংশ ব্যাংক জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বহু পুরনো প্রক্রিয়া ব্যক্তিগত গ্যারান্টর প্রথা চালু রেখেছে। উন্নত দেশগুলোয় ধরনের বিধান সেকেলে বলে তা রহিত করা হলেও আমাদের এখানে এর চল গ্যারান্টরের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামানতবিহীন ঋণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গ্যারান্টর হয়ে বিপদে পড়েছেন অনেকে। কেউ কেউ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। মানসম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি জেল-জরিমানার ঘটনাও ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের একটি আধুনিক সুষ্ঠু পরিপূর্ণ গাইডলাইন প্রয়োজন, যাতে ঋণগ্রহীতা হয়রানির শিকার না হন আবার ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। কোনো কোনো ব্যাংক ঋণগ্রহীতার আর্থিক ব্যাকগ্রাউন্ড পরীক্ষা করা থেকে শুরু করে সামাজিক অবস্থানও বিবেচনায় নিয়ে থাকে। এজন্য নির্ধারিত ফরম প্রক্রিয়া রয়েছে। তাছাড়া ঋণগ্রহীতার কিছু বিষয়ও যাচাই করা হয় তৃতীয় পক্ষকে দিয়ে। ব্যাংকঋণের ঝুঁকি কমাতে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। এসব নীতিমালার মূল উদ্দেশ্য হলো ঋণকে যথাসম্ভব নিরাপদ রাখা। তবে ঋণ বিতরণের ক্ষমতা জামানত গ্রহণের নীতিমালার বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনতা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো নিজেদের জন্য প্রণীত নীতিমালার ভিত্তিতেই ঋণের জামানত গ্যারান্টি গ্রহণ করে। বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে বৈশ্বিকভাবে জামানত গ্রহণ করপোরেট গ্যারান্টির প্রচলন আছে। তবে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বর্তমানে জামানত গ্রহণের নীতিকেও সেকেলে ধারণা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে ব্যাংকঋণ নেয়ার জন্য জমি বা বাড়ি বা স্থাবর সম্পত্তি জামানত রাখার প্রয়োজন হয় না। ব্যাংক থেকে নেয়া অর্থ ফেরত দেয়া হবে, প্রতিশ্রুতিই সেখানে বড় জামানত হিসেবে ব্যবহূত হয়। যদিও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জামানত, করপোরেট গ্যারান্টির পাশাপাশি ব্যক্তিগত গ্যারান্টিও আদায় করছে।

ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে গারান্টি একটি কার্যকর প্রক্রিয়া। প্রতিটি দেশেই এটি প্রচলিত। তবে বাংলাদেশে এক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান। বড় বড় গ্রাহকের ক্ষেত্রে জামানত ছাড়াই শুধু পরিচয় সূত্রে বা সুনামের ওপর ভর করে কোটি কোটি টাকা ঋণ দেয়া হচ্ছে। এতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলেও গবেষণায় দেখা গেছে। কোনো কোম্পানিকে জোর করেও ঋণ দেয়ার উদাহরণ রয়েছে। এক্ষেত্রে শিশুসন্তান থেকে শুরু করে বন্ধু, আত্মীয়, এমনকি অফিসের কলিগকে গ্যারান্টর করা হচ্ছে। কোনো ঋণগ্রহীতা অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে গ্যারান্টর বাড়তি ঝামেলায় পড়ছেন। ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত গ্যারান্টর পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। আধুনিক সময়ে ব্যাংকঋণের গ্যারান্টর জোগাড় না করে বীমার সহায়তা নেয়া যেতে পারে। ঋণের বিপরীতে বীমা বাধ্যতামূলক হলে ঋণগ্রহীতা ব্যাংকের জন্য তা লাভজনক হবে বৈকি। এছাড়া ঋণ প্রদানের আগে ব্যক্তিগত প্রোফাইল যাচাইয়ে তৃতীয় পক্ষকে সংযুক্ত করার বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে ঋণ দেয়া আদায়ে এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এতে ঋণখেলাপি হওয়ার প্রবণতাও কমে আসবে। একই সঙ্গে ঋণ প্রদান আদায় সহজ হয়ে উঠবে। ঋণের অর্থের ব্যবহারও তদারকির আওতায় আনা যাবে।

আধুনিক সময়ের সঙ্গে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সম্পৃক্ত করতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। ঋণ প্রদান থেকে শুরু করে ব্যাংকের পরিচালন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসতে হবে। আমাদের আইন, বিধিমালাও পরিবর্তন প্রয়োজন। ব্যাংকিং খাতে এখন ব্যাসেল- বাস্তবায়ন হচ্ছে। অথচ আমাদের ঋণ প্রদান বা আদায়ে এখনো সেকেলে ধারণা বিদ্যমান, যার পরিবর্তন প্রয়োজন। জামানতসহ বা জামানতবিহীন ঋণ প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা আবশ্যক। আশা করি, গ্রাহকের হয়রানি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আধুনিক সময়ের উপযোগী একটি গাইডলাইন দ্রুত প্রণয়ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে। আমাদের দেশে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। কারণে দেশে আন্তর্জাতিক মানের আদর্শ ব্যাংকিংয়ের চর্চা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ঋণখেলাপিদের বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে দেশে ক্রিমিনাল হিসেবে সম্বোধন করা হয় না। পরিস্থিতির পরিবর্তন লাগবে। ঋণখেলাপিদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে। দীর্ঘদিন থেকেই ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ দেখা যাচ্ছে না। প্রচলিত আইন রীতিনীতি দেশের ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। এমন প্রবণতা পরিহার করতে হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫