ইরানের ১৯৫৩ অভ্যুত্থানে ব্রিটিশ-মার্কিন ইন্ধন: নব্য সাম্রাজ্যবাদ

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০

মাসুমা সিদ্দিকা

প্রায় ৭০ বছর আগে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে হটানো নিয়ে সম্প্রতি এক তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। মোহাম্মদ মোসাদ্দেক তেহরানে জন্মগ্রহণকারী একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক পন্থাতেই ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু তাকে সরে যেতে হয় সিআইএ ও ব্রিটিশ এসআইএস গোয়েন্দা দলের চক্রান্তে ঘটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। তিনি গনতন্ত্রকে সামনে নিয়ে আসেন ও বিদেশীদের বলয় থেকে ইরানকে আধুনিকতার দিকে নিতে যেতে চেষ্টা চালান। তার সঙ্গে ব্রিটিশ ও মার্কিনীদের দ্বন্দ্ব তৈরি হয় ইরানের তেলক্ষেত্র গুলোকে নিয়ে। তিনি তার দেশের তেলক্ষেত্র গুলোকে জাতীয়করণের উদ্যোগ নেন; যার ফলে ব্রিটিশ ও মার্কিন স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। এতে তার কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল না, ছিল শুধুই জাতীয় স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা। কিন্তু এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশরা মার্কিনীদের সাহায্যে তৎকালীন শাহ রেজা পাহলভির সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্টে। পশ্চিমা দেশগুলো এটিকে অপারেশন অ্যাজাক্স বললেও ইরানের বর্ষপঞ্জির তারিখ অনুযায়ী এটিকে ২৮ মর্দাদ ১৩৩২ অভ্যুত্থান হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।

মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ক্ষমতায় আসেন ১৯৫১ সালে। ক্ষমতায় আসার পর এই জাতীয়তাবাদি নেতা  দেশে যেসব ব্রিটিশ তেল কোম্পানি ছিল সেগুলোকে জাতীয়করণের উদ্যোগ নেন। তার কর্মকাণ্ড তাকে ইরানের পশ্চিমাপন্থি অভিজাত শাসক মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ফেলে। মার্কিন কর্মকর্তারা ইরানের এই ঘটনা প্রবাহের দিকে সন্দিগ্ধ নজর রাখছিলেন।  ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের গোয়েন্দারা গোপন অভিযানের মাধ্যমে মোসাদ্দেক সরকারকে উৎখাত করার জন্য একটি অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে সহায়তা করেছিল। ব্রিটিশরা আমেরিকাকে বোঝাচ্ছিল যে, মোসাদ্দেক একজন কমিউনিস্ট এবং তিনি ক্ষমতায় থাকলে ইরানকে সোভিয়েত বলয়ে নিয়ে যাবেন। আসলে কমিউনিজমের ধুয়া তুলে ব্রিটিশরা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থই হাসিল করতে চাচ্ছিল। তারা চাচ্ছিল শাহ রেজা পাহলভি প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে হটিয়ে দিয়ে জেনারেল ফাজলুল্লাহ জাহেদিকে তার স্থলাভিষিক্ত করবেন।  ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে মোসাদ্দেক তার অনুসারীদের রাস্তায় বিক্ষোভে ডাকেন এবং এই বিক্ষোভের মুখে শাহ রেজা পাহলভি স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে বাগদাদ হয়ে ইতালিতে পালিয়ে যান। কিন্তু এরপর আবার ইরানের মিলিটারিরা শাহ রেজা পাহলভির দলের  সঙ্গে যুক্ত হয়ে সিআইএ-র আর্থিক ও অন্যান্য কৌশলগত সহযোগীতায় ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটায় এবং মোসাদ্দেককে কারাগারে পাঠায়। এই অবস্থায় শাহ রেজা পাহলভি আবার মহা সমারোহে দেশে ফিরে আসেন এবং আমেরিকার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরুপ ইরানের তেলক্ষেত্রের কিছু অংশ আমেরিকাকে দিয়ে দেন। এরপর অনেক ঘটনার পরে ইরানে আবার গণ অভ্যুত্থানের মুখে পাহলভির পতন ঘটে এবং ইসলামি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালে। মোহাম্মদ মোসাদ্দেক তার জীবনের শেষ দিনগুলি অনেক কষ্টে-অবহেলায় কাটিয়েছেন। তাকে তিনবছর কারাভোগ করার পরে গৃহে অন্তরীণ রাখা হয় আমৃত্যু এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এড়াবার জন্য তাকে তার বাড়িতেই সমাধিস্থ করা হয়।

মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকারের অর্থলোভী ষড়যন্ত্রমূলক এবং আগ্রাসী আচরণ আমরা বিশ শতকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে দেখি। যেমন চিলির রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দের জীবনে। তিনি চিলির রাষ্ট্রপতি হিসেবে ছিলেন ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত এবং তিনি লাতিন আমেরিকার প্রথম মার্কসবাদি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি চিলির সমস্ত তামার খনি এবং বিদেশীদের (বিশেষ করে মার্কিন) মালিকানাধীন অনেক ব্যবসা জাতীয়করণ করেন।  এর ফলে মার্কিন সরকার রুষ্ট হয় আলেন্দের ওপর এবং এর ফলে চিলিতে মার্কিন ও পশ্চিম ইউরোপের বৈদেশিক বিনিয়োগ উঠিয়ে নিয়ে চিলির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। আলেন্দে ১৯৭৩ সালের ভোটে পুনর্নির্বাচিত হলেও হঠাৎ আলেন্দের শাসনের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে চিলির সামরিক জেনারেল অগাস্তো পিনোসে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সহায়তায় আলেন্দেকে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে অন্তরীণ করে রাখেন। জনশ্রুতি আছে যে, আলেন্দেকে ওখানে হত্যা করা হয়, কিন্তু খবর রটানো হয় যে আলেন্দে আত্মহত্যা করেছেন। অনেক বছর পরে তার মৃতদেহ অতি সাধারণ একটি সমাধি থেকে উঠিয়ে মর্যাদার সঙ্গে সমাহিত করা হয়।

বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের বড় বড় নেতাদের জীবনে যে করুণ পরিসমাপ্তি ঘটেছিল বৈদেশিক রাষ্ট্রের গোপন ষড়যন্ত্র দ্বারা, তেমনই কিছু ঘটে ছিল কিনা বঙ্গবন্ধুর জীবনে, অন্য কোনো রাষ্ট্রের ইন্ধন ছিল কি না তা আমরা দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি না। অনেক গবেষক আজকাল বলছেন যে, সিআইএর গোপন নথিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তাদের (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ) সম্পৃক্ততার আঁচ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে এখনো কোনো বিস্তারিত, তথ্যনির্ভর গবেষণার কথা জানা যায় না। এখন সময় এসেছে বিভিন্ন সমৃদ্ধ আর্কাইভ থেকে অবমুক্ত তথ্য নিয়ে এ নিয়ে নির্মোহ গবেষণা করার। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গারি জে বাস আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে ধরনের গবেষণা করেছেন তা এ ব্যাপারে প্রণিধানযোগ্য হতে পারে।

যুগে যুগে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অন্য রাষ্ট্রের ওপর তাদের ভয়ঙ্কর থাবা বসিয়েছে; করুণ পরিসমাপ্তি এনেছেন অনেক মহান রাজনীতিবিদদের জীবনে। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তরকালে মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধকালে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের লড়াইয়ের বলি হতে হয়েছে অনেক মহান রাষ্ট্রনায়ককে। কখনো কখনো আর্থিক স্বার্থকে রাজনৈতিক মোড়ক দিয়ে নতুন স্বাধীন হওয়া দেশগুলোতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে যাকে এক নব্য সাম্রাজ্যবাদ বলা যায়। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এর ফলে এই দেশগুলোর উন্নয়নের যাত্রা ব্যাহত হয়েছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫