পেঁয়াজের দামে হঠাৎ উল্লম্ফন

স্থায়ী সমাধানে পদক্ষেপ নেয়া হোক

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২০

উৎপাদন বিক্রির তথ্য বিশ্লেষণে লক্ষণীয় যে কৃষকের পেঁয়াজ উৎপাদনে লোকসান হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। একদিকে কৃষককে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে এবং অন্যদিকে অস্বাভাবিক মূল্য ৮০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে ক্রয় করতে হচ্ছে ভোক্তাসাধারণকে। উৎপাদকের বিক্রয়মূল্য এবং ভোক্তা পর্যায়ের ক্রয়মূল্যের মধ্যে বিশাল পার্থক্যের কারণ পেঁয়াজ জোগানদাতার ব্যয় বৃদ্ধি নয়, চাহিদার বৃদ্ধি নয়, শুধু ভবিষ্যৎ সংকটের আশঙ্কায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সুযোগ নিচ্ছেন বিভিন্ন স্তরের মধ্যস্থ কারবারি, যেমন পাইকারি বিক্রেতা, আড়তদার, খুচরা বিক্রেতা প্রমুখ। ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণা দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এর দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার আর কোনো কারণ থাকতে পারে না।

পেঁয়াজের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তের তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ তারা তাদের পারিবারিক ব্যয়ের ক্ষুদ্র একটি অংশ ব্যয় করে এর পেছনে, কিন্তু দরিদ্র অতিদরিদ্রদের জন্য এটি খুবই পীড়াদায়ক। উল্লেখ্য, যে কৃষক রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অক্লান্ত পরিশ্রম করে উৎপাদন করছেন, সেই কৃষক পাচ্ছেন না দাম। ভোক্তা, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের ভোক্তার অক্লান্ত পরিশ্রমে উপার্জিত সামান্য রোজগার থেকে অধিক মূল্যে কিনতে হচ্ছে পেঁয়াজ। পক্ষান্তরে শুধু কারসাজি করে, মানুষকে জিম্মি করে, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। পেঁয়াজ বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত তিন শ্রেণী অর্থাৎ উৎপাদক বা কৃষক, ভোক্তা ব্যবসায়ী। এর মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে, কৃষকের নেই কোনো সংগঠন বা জোটবদ্ধতা। ভোক্তাদের একটি সংগঠন থাকলেও ততটা কার্যকর বা সংগঠিত নয়। কিন্তু ব্যবসায়ী মধ্যস্বত্বভোগীরা জোটবদ্ধ এবং তারা বেশ সংগঠিত। বিরাজমান অর্থনৈতিক অবস্থায় দেশের কৃষক নিম্ন আয়ের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে উন্নয়নের সুফল থেকে। কৃষক সমস্তরের বঞ্চিত মানুষের নিম্ন আয় আর অবৈধভাবে অর্জিত উচ্চ আয়ের যোগফলের গড় থেকে নির্ণীত মাথাপিছু আয়ে বেশ সফলতা দেখা গেলেও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে বৈষম্য। পেঁয়াজের বাজারে সৃষ্ট অস্থিরতা খুব সহজে সমাধানযোগ্য। কারণ যে কৃষক ৬০ শতাংশের বেশি জোগান নিশ্চিত করছেন, তাকে একটু সহায়তা করলে এবং ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারলে তার পক্ষে চাহিদার শতভাগ জোগান সম্ভব হবে। আমদানির ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। তবে তার জন্য প্রয়োজন উৎপাদিত কৃষিপণ্যের সংরক্ষণের সুব্যবস্থা, ভোক্তা সংগঠনকে সহায়তার মাধ্যমে আরো শক্তিশালী করা এবং মজুদদারি বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।

সরকারি হিসাবে পেঁয়াজের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন জোগান পর্যাপ্ত হলেও বাজারে তার কোনো প্রভাব নেই। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, পেঁয়াজের জোগান কম। সরকারি হিসাব সঠিক নয়। পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে কারো কারসাজি আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ধরনের অভিযান সারা বছর অব্যাহত রাখা দরকার। পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই নিত্যপণ্যের বাজারের অস্থিরতা দূর করার জন্য সময়মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডপ্রতি ক্ষেত্রেই সিন্ডিকেটের আস্ফাালন লক্ষণীয়। তবে এটা নতুন কিছু নয়, সাংবাৎসরিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্য তো বটেই, সেবা খাতেও সিন্ডিকেটের হস্তক্ষেপ প্রকট। বাজার পরিস্থিতি পাল্টানোর জন্য সবার আগে প্রয়োজন বিক্রেতাদের অসৎ, লোভী প্রতারণামূলক মানসিকতার পরিবর্তন। পরিবর্তন কবে ঘটবে তার জন্য অপেক্ষা করে নিষ্ক্রিয় বসে থাকলে চলবে না। এজন্য রাষ্ট্র সমাজের সচেতন দায়িত্বশীল মহলকে ভূমিকা রাখতে হবে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, গত বছরও পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেলে সরকার ভারত ছাড়া অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে। এমনকি উড়োজাহাজ ভাড়া করে পেঁয়াজ আমদানির মতো তুঘলগি কাণ্ড করতেও দেখেছি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের উৎপাদন দাম পর্যবেক্ষণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই আগাম ব্যবস্থা নিতে পারত। তাহলে পেঁয়াজের দাম এত বেড়ে যেত না। পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির আগাম পূর্বাভাস আগেই মিলছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীরা সংকট এড়াতে কার্যকর কোনো উদ্যোগই নেয়নি। গত বছর সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, পেঁয়াজ নিয়ে এবার শিক্ষা হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেবেন। পরিবহনের সুবিধার জন্য ভারত থেকেই বেশির ভাগ পেঁয়াজ আমদানি করা হতো। সেক্ষেত্রে দেশটি আকস্মিক রফতানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশকে বিপদেই পড়তে হয়। ভারতের পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হয়েছে, বন্যায় সেখানে পেঁয়াজ উৎপাদন কমেছে। কারণে তারা রফতানি করতে পারছে না। কিন্তু এভাবে হঠাৎ রফতানি বন্ধ না করে আগাম জানিয়ে দিলে বাংলাদেশ বিকল্প ব্যবস্থা করে নিতে পারত। চাহিদামাফিক দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন করা সময়সাপেক্ষ। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। বাজার পরিস্থিতি আগে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল। সেদিক থেকে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। সরকার আগে থেকেই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে, তার বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হলে বাজার এভাবে লাগামহীন হয়তো হতো না। দেশের প্রয়োজনে যখন দরকার তখন আমদানি বাড়ানোর সুযোগ দিতে হবে। যখন প্রয়োজন তখন সে সুযোগও সংকুচিত করা চাই। সময়ক্ষেপণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হলে তার সুফল পাওয়া যায় না। কেউ             অতিমুনাফার জন্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে কিনা, সেটি অবশ্যই তদারক করতে হবে। খুচরা আড়ত পর্যায়ে এটি দরকার। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক কিংবা বাজার স্থিতিশীল করতে সরবরাহ ঠিক আছে কিনা, সেটি আগে নিশ্চিত করা চাই।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫