রাজধানীর বছিলার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলীর জন্ম স্বাধীনতার আগে। নানা দুরন্তপনায় কাটানো মোহাম্মদ আলীর স্মৃতির বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে আঁটি নদী। নদীতে লাফানো-ঝাঁপানো ছাড়াও মাছ ধরা ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। এ নদীর মাছ বিক্রি করেই চলত তার চার সদস্যের সংসার। কালের পরিক্রমায় নদীটি হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণের বলি। ঢাকার মানচিত্রে আঁটি নদীর অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়াই যায় না। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের দখল ও ভরাটে হারিয়েছে এ নদীর অস্তিত্ব। শুধু আঁটি নদী নয়, ঢাকার অধিকাংশ নদী ও খালই এখন অস্তিত্বের সংকটে।
গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের পৃথক দুটি জরিপে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার কালেও ঢাকা জেলায় নদীর সংখ্যা ছিল ১৫। ঢাকা মহানগরী এলাকায় খাল ছিল ৭৫টি। এর মধ্যে আঁটি, কনাই, দোলাই, পান্ডো ও নড়াই—এ পাঁচ নদীর কোনো হদিস বর্তমানে পাওয়া যায় না। একই সঙ্গে ঢাকাকে ঘিরে রাখা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও টঙ্গী নদীর মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ১৭টি খালও হারিয়ে গেছে। গত ৫০ বছরে এসব নদী ও খালের বুকের ওপর গড়ে উঠেছে বড় বড় অট্টালিকা।
হারিয়ে যাওয়া পাঁচটি নদীর মধ্যে আঁটি নদীর অবস্থান ছিল বর্তমান বছিলা ব্রিজ থেকে আঁটিবাজার পর্যন্ত। কনাই নদীর অবস্থান ছিল টঙ্গী নদী থেকে উত্তরা ও আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত। দোলাই নদীর অবস্থান ছিল তেরমুখ থেকে পুরান ঢাকার ধোলাইখাল পর্যন্ত। পান্ডো নদীর অবস্থান ছিল ধানমন্ডির ঈদগাহ মসজিদ থেকে মোহাম্মদপুরের কাটাশুর পর্যন্ত। নড়াই নদীর অবস্থান ছিল বালু নদী থেকে বর্তমান কারওয়ান বাজার জামে মসজিদ পর্যন্ত। একই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া খালগুলো সংযোগ স্থাপন করেছিল রাজধানীর প্রধান চারটি নদীকে। সূত্রাপুর-লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, মোহাম্মদপুরের বছিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরার আবদুল্লাহপুর ও উত্তরখান হয়ে তুরাগ, খিলক্ষেত-ডুমনি হয়ে বালু ও মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিল এসব খাল।
মাঠপর্যায়ে জরিপ, জিপিএস মানচিত্র ও ছবির তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে জরিপ দুটির ফলাফল তৈরি করেছে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ১৫০টি নদীর বেজলাইন সার্ভের অংশ হিসেবে নদীগুলোর সংযোগ চ্যানেল চিহ্নিত করতে একটি জরিপ চালানো হয়। একই সঙ্গে রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণে বড় ভূমিকা পালনকারী খালগুলোর অবস্থান শনাক্তে খালভিত্তিক আরেকটি জরিপ চালানো হয়।
এ বিষয়ে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকায় মোট কতগুলো নদী রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান পেতেই জরিপ চালানো হয়। কারণ বেশির ভাগ সরকারি সংস্থার কাছেও নদী ও খালের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এখানে দেখা গিয়েছে, একসময় নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ঢাকার নগরসভ্যতা আজ অস্তিত্ব সংকটে। ঢাকা জেলায় অবস্থিত ১৫টি নদীর মধ্যে পাঁচটি গত ৫০ বছরে হারিয়ে গিয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকাকে ঘিরে ৭৫টি খালের অবস্থান থাকলেও বর্তমানে ৫৮টি খালের অস্তিত্ব রয়েছে বলে নদী রক্ষা কমিটি জানিয়েছে। তবে যেগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগও এখন দখল-ভরাটের কবলে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে যেসব নদী ও খালের অস্তিত্ব রয়েছে, সেগুলোও আকারে অনেক ছোট হয়ে পড়েছে। নদী দখলের পাঁয়তারা চলছে এখনো। কোথাও বালি ফেলে ভরাট করেছে প্রভাবশালী দখলদাররা। আবার কোথাও কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে নদীর পানিসহ আশপাশের পরিবেশ। নদী-খাল বিলীন হয়ে পড়ার পাশাপাশি দখল-দূষণের প্রভাব এরই মধ্যে টের পেতে শুরু করেছে রাজধানীর বাসিন্দারা। রাজধানীর তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যাচ্ছে ঢাকার রাস্তাঘাট। কিছু কিছু এলাকায় পানি জমে থাকছে দিনের পর দিন। বিশেষ করে নিম্নাঞ্চলগুলো ভুগছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতায়। ওয়াসার পানির সংকটও দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। পরিবেশের যে বিপর্যয় শুরু হয়েছে, তা অব্যাহত থাকলে রাজধানী অচিরেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নদীগুলো দখলমুক্ত করতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ভেস্তে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের কারণে। একের পর এক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এখনো দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি।
এছাড়া নদীগুলোকে রক্ষার পাশাপাশি হারানো নদীগুলোকে ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগে সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতিটি নদীর আলাদা চরিত্র আছে। আমাদের ভাবনাচিন্তাগুলো কেবল ঢাকার প্রধান চার নদী ঘিরে। যদিও এ নদীগুলোকে আমরা দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি। সরকারের বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপে সারা দেশের মরে যাওয়া নাম হারানো নদীগুলোকে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য টেকসই পরিকল্পনাভিত্তিক প্রকল্প নেয়া প্রয়োজন।
স্থানীয় সরকার বিভাগ, ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গিয়েছে, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ ও দখল রোধে ১০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১২ জুলাই এ মাস্টারপ্ল্যানের অনুমোদন দিয়েছেন। মাস্টারপ্ল্যানে নদী দূষণের নয়টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নদীগুলো দখলমুক্ত করার কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। গৃহস্থালি ও শিল্প বর্জ্য যাতে নদীতে না যায়, সেজন্যও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বণিক বার্তাকে বলেন, কমিশন শিগগিরই দেশের ৬৪ জেলার সব নদ-নদীর দখল-দূষণ সংক্রান্ত একটি মানচিত্র ও পূর্ণাঙ্গ সুপারিশমালা তৈরি করে সরকারের কাছে জমা দেবে। দেশে এমন কোনো নদী নেই, যা দখল ও দূষণের কবলে পড়েনি। তবে নদী রক্ষা ও খননে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এখন আগের তুলনায় বেশকিছু সংখ্যক উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ চোখে পড়ছে।