বিশ্লেষণ

করোনায় কী কার্যকর আর কী কার্যকর নয়—একটি অর্থমিতিক বিশ্লেষণ

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ০১, ২০২০

ড. সৈয়দ আবুল বাশার , ড. এ. কে. এনামুল হক

করোনায় বিশ্ব আক্রান্ত সেই ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে। গত আট মাসে করোনার ঢেউ বিশ্বের নানা প্রান্তে লেগেছে নানা সময়ে। কোথাও তাতে মৃত্যু হয়েছে লক্ষ প্রাণের। কোথাও একজনও মারা যায়নি। কেন এমন হলো। কী মন্ত্র ছিল তাদের? কোথাও করোনার দুর্ভোগ থেকেছে মাস তিনেক, কোথাও ছয় মাসেও যায়নি। কোথাও দেশকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কোথাও তার কিছুই করা হয়নি। কোনো কোনো দেশের জনগণ না বলতেই মুখোশ পরে দূরত্ব বজায় রেখে কাজে বেরিয়েছে। কোথাও মুখোশকে বলা হয়েছে রাজনৈতিক মতবাদ। করোনা কী করে ছড়ায়, তা নিয়ে চিকিৎসকরা গবেষণায় লিপ্ত। করোনার প্রকোপ দেশে দেশে প্রত্যন্ত স্থানে তো বটেই, করোনা আঘাত হেনেছে ব্রাজিলের আমাজন বনাঞ্চলের আদিবাসীদের মাঝে, এমনকি আন্দামানেও। করোনা আঘাত হেনেছে মাছবাজারে, যুদ্ধজাহাজে কিংবা শহরাঞ্চলে। মোট কথা, কেউই বলতে পারবে না  যে আমি করোনার আঘাতের বাইরে। সম্প্রতি একই লোকের দ্বিতীয়বার করোনা আক্রান্ত হওয়ার খোঁজ পাওয়া গেছে। ফলে যারা একসময় করোনাজয়ী মনে করে ভেবেছিলেন যে আমার আর ভয় নেই, তার জয়ও হার মেনেছে। তবে দেশে দেশে সবার অবস্থা, কার্যক্রম কিংবা আমাদের করোনাবিষয়ক কর্মকাণ্ড এক নয়। তাই এখন সময় হয়েছে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার।

২১৭ দেশের জুন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণের তথ্য, দেশগুলোর সামাজিক বিভিন্ন উপাত্ত, তাদের করোনা মোকাবেলার সক্ষমতার চিত্র, অর্থনৈতিক অবস্থা, জনসাধারণের স্বাস্থ্যগত উপাত্ত, করোনা পরীক্ষার ক্ষমতা, এমনকি কী পরিমাণ জনগণ গত ছয় মাসে গৃহবাসী হয়েছে ইত্যাকার সব উপাত্ত জোগাড় করে আমরা গবেষণা চালিয়েছি। গবেষণার মূল বিষয় ছিলআমরা কী শিখতে পারলাম? কী করলে একটি দেশ এমন একটি বিশাল কালো ছায়ার গ্রাস কমাতে পারে? গবেষণায় ইকোনমেট্রিকস বা অর্থমিতির বিভিন্ন মডেল দিয়ে আমরা যা জানতে পেরেছি তা আপনাদের নজরে আনছি। আমাদের বিশ্বাস, এর ফলে আমাদের নীতিনির্ধারকদের করোনা নিয়ে কিছু নীতি চিন্তা করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বলে রাখা ভালো, গবেষণা করতে গিয়ে আমরা দেখতে পেলাম যে ২১৭ দেশের সবার সব বিষয়ে যথেষ্ট উপাত্ত পাওয়া যায় না, তাই আমাদের গবেষণায় শেষ পর্যন্ত ১৬৩ দেশের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন অভিজ্ঞতার উপাত্ত ব্যবহূত হয়েছে।

আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। প্রথম প্রশ্নটি ছিল, করোনা কি ধনী দেশকে বেশি আক্রমণ করে? যেহেতু করোনা চীনের উহান থেকে সৃষ্টি হয়ে ইউরোপে বড় রকমের আঘাত হানে এবং ইতালির মতো দেশকে কাবু করে ফেলে। তাই অনেকের মনে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে হয়তোবা ধনী দেশের জীবনযাত্রার সঙ্গে তা জড়িত। বলে রাখা ভালো, চীনে যতদিন তা ছিল তখন ধারণা করা হয়েছিল যে তা বাদুড়ের মাধ্যমে আমাদের মাঝে এসেছে। যখন তা ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনকে গ্রাস করল, তখন মনে করা হলো এটি ছড়াচ্ছে দেশ-দেশান্তরে যাতায়াতের মাধ্যমে অর্থাৎ এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণের মাধ্যমে তা ছড়াচ্ছে। যখন তা ইউরোপ ছেড়ে আমেরিকায় আঘাত হানল, তখন মনে করা হলো যে করোনা সম্ভবত উচ্চ জীবনমানের সঙ্গে জড়িত। তাই কেউ কেউ তাকে ধনীদের বিরুদ্ধে সৃষ্টিকর্তার আঘাত বলে মনে করতে লাগলেন। আমাদের গবেষণায় আমরা তার কোনো প্রমাণ পাইনি। আমাদের মনে হয়েছে বিষয়টি ধনী-দরিদ্রের বিষয় নয়। ধনী দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতা বেশি হওয়ায় তারা বেশি পরিমাণে করোনা পরীক্ষা করিয়েছে, তাই অনেকের মনে হয়েছে করোনা ধনীদের বিরুদ্ধে সৃষ্টিকর্তার আঘাত। ১৬৩টি দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা বলতে পারি, বিষয়টি তা নয়। করোনা সবাইকেই আঘাত করবে। ধনী-দরিদ্রভেদে তার আগ্রাসন ভিন্ন নয়। তবে আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে দেশে যত বেশি পরিমাণ পরীক্ষা হবে, সেই দেশে তত বেশিসংখ্যক রোগী পাওয়া যাবে। অর্থাৎ করোনায় আক্রান্তের সঠিক তথ্য জানতে সেই দেশের করোনা পরীক্ষার সক্ষমতা থাকা জরুরি।

করোনার চিকিৎসায় হাসপাতাল তৈরি রাখার প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু হাসপাতালগুলোর ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ইতালি, ব্রিটেন, ফ্রান্স এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নাজুক হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু হাসপাতালের সক্ষমতা যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ, তাই আমাদের গবেষণায় আমরা জানতে চাইছিলাম স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কী করা হলে করোনা মোকাবেলা সহজ হবে। ডাক্তার বাড়িয়ে? হাসপাতাল বাড়িয়ে? নাকি জনগণকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করে? মোট ১৬৩ দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার বিচারে দেখা গেল যে যেসব দেশ যত বেশিসংখ্যক মানুষকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় রেখেছে, সেই দেশে রোগের প্রকোপ কম। অর্থাৎ সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি, যা করোনার মতো বিপজ্জনক অবস্থায়ও কার্যকর পদক্ষেপ। অনেকের মতে, এই নিয়ম চালু থাকলে অনেক তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় করা যায়, তাতে সংক্রমণের হার কমে। 

ম্যালেরিয়ার সঙ্গে করোনার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও বিতর্ক রয়েছে যথেষ্ট। খোদ ট্রাম্প মনে করেন যে ম্যালেরিয়া নিরাময়ের কোনো কোনো ওষুধ করোনা নিরাময়েও কার্যকর হতে পারে। তাই আমরা মনে করেছিলাম যেসব দেশে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি, সেই সব দেশে হয়তোবা সংক্রমণ কম। আমাদের গবেষণায় আমরা তার কোনো সত্যতা পাইনি। অর্থাৎ ম্যালেরিয়ার প্রকোপের সঙ্গে করোনার প্রকোপের কোনো পরিসংখ্যানগত সত্যতা আমরা দেখতে পাইনি।

ট্রাম্পের ধারণার বিপরীতে অনেকেই মনে করেছিলেন জনগণকে গৃহে অন্তরীণ রাখলে হয়তোবা সংক্রমণ কমে যাবে। আমরা এর সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে গুগলের প্রকাশিত জনগণের গতিশীলতার উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছি। তবে তা করতে গিয়ে দেশের সংখ্যা কমে এসেছে। কারণ বহু দেশের জনগণের গতিশীলতার ডাটা গুগলের কাছে নেই। গুগলের এই উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা ১০৮টি দেশের জনগণের গতিশীলতার চিত্র পাই। এসব উপাত্ত সবটুকু সত্য না- হতে পারে। যেমন আপনি যদি আপনার মোবাইল বাড়িতে রেখে ঘরের বাইরে চলে যান, তবে গুগল মনে করবে আপনি বাড়িতেই বসে আছেন কিংবা আপনি যদি কোনো ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছে ট্রাফিক জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকেন, তবে গুগল মনে করতে পারে আপনি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন। তবুও আমরা যদি ধরে নেই যে আপনি বাড়ির বাইরে গেলে আপনার মোবাইলটি নিয়ে বের হন, তবে আমরা বলতে পারি আপনার মোবাইলের অবস্থান পরিবর্তন না হওয়া মানেই আপনি বাড়িতেই অবস্থান করছেন। তাই গুগলের দেয়া উপাত্তের ঘরে বসে থাকার ডাটা দিয়ে আমাদের গবেষণায় দেখেছি, ঘরে বসে অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে সংক্রমণ কমানো যায়নি। অর্থাৎ যেসব দেশ জনগণকে ঘরে বন্দি রেখেছিল আর যারা রাখেনি, তাদের মধ্যে সংক্রমণের হারে কোনো পার্থক্য নেই। তাতে বোঝা গেল যে গৃহান্তরীণ করে দেশগুলো কেবল অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বলে রাখা ভালো, আমরা স্থানীয় সংক্রমণ রোধে পদক্ষেপের কার্যকারিতা পরীক্ষা করিনি। আমরা দেখেছি গোটা দেশকে অন্তরীণ রেখে সংক্রমণ রোধের এই ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। 

তবে আমাদের মনে আরো একটি প্রশ্ন ছিল, মুখোশ দূরত্ব ব্যবস্থাপনা কতটা কার্যকর হয়েছে? সঠিক উপাত্ত না থাকায় আমরা এর আগে যেসব দেশে সার্স রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল, এগুলোর সঙ্গে যেসব দেশে সার্স হয়নি তাদের তুলনা করেছি। আমরা জানি সার্সে আক্রান্ত দেশগুলো এরই মধ্যে সামাজিকভাবে মুখোশে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই আমাদের গবেষণায় আমরা দেখতে চেয়েছিলাম সার্স আক্রান্ত দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব কম ছিল কিনা। গবেষণায় আমরা দেখতে পেলাম যে সার্স আক্রান্ত দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব কম। তাই বলা চলে,

সর্বত্র মুখোশ পরা, দূরত্ব বজায় রাখা

হাত ধোয়া করোনার প্রকোপ রোধে একটি কার্যকর পদ্ধতি।

অনেকের ধারণা ছিল জনঘনত্ব একটি মারাত্মক সমস্যা। অর্থাৎ যেসব দেশে জনঘনত্ব বেশি, সেসব দেশে হয়তোবা করোনার প্রকোপও বেশি হতে পারে। আমরা এর সত্যতা পাইনি। তবে যেসব দেশে অধিকসংখ্যক লোক কর্মক্ষেত্রে যুক্ত অর্থাৎ কাজের জন্য যে দেশে বেশিসংখ্যক লোক একই পরিবার থেকে প্রতিদিন বাইরে যায়, সেসব দেশে করোনার প্রকোপ বেশি। অর্থাৎ যে দেশের পরিবার থেকে প্রতিদিন অধিকসংখ্যক লোক ঘরের বাইরে বের হবে, সে দেশে করোনার প্রকোপ বেশি। তাই বলা চলে, করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের আগে জনগণের ঘর থেকে বের হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে রাখতে পারলে এর প্রকোপ কম হবে। সেই অর্থে আমাদের গবেষণার ফল থেকে বলা চলে যে করোনার সময় যতদূর সম্ভব ঘরে বসে কাজ করার রীতি চালু করলে প্রকোপ কম হবে। তাই অনেক কাজ ডিজিটাল করার বর্তমান নিয়ম চালু রাখা সমীচীন হবে।

করোনা কী করে ছড়ায়, তা নিয়েও নানা মত রয়েছে। কারো ধারণা, করোনা আমাদের হাঁচি-কাশি কিংবা লালা থেকে সৃষ্ট অণুকণার মাধ্যমে ছড়ায়। কারো মতে, তা বাতাসে ছড়ায়। তাই হাত ধোয়া মুখোশ ব্যবহার কার্যকর। আমাদের গবেষণায় আমরা জানতে চেষ্টা করেছি, বায়ুদূষণের সঙ্গে করোনার প্রকোপের কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা। গবেষণায় দেখা গেল, যেসব দেশে বায়ুদূষণ বেশি, সেসব দেশে সংক্রমণের হারও বেশি। পার্থক্য পরিসংখ্যানগতভাবেও নির্ভরযোগ্য। তাই সব দেশেরই আগামীতে বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে একটি সম্মেলনে আমরা আমাদের গবেষণার ফল প্রথম প্রকাশ করি। গবেষণায় বরেণ্য গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন। আরো ছিলেন আমাদের মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী। সম্মেলনের পরে অনেকে আমাদের কয়েকটি প্রশ্ন রেখেছিলেনকেন শহরের চেয়ে গ্রামে করোনার প্রকোপ কম। আমাদের মনে হয়েছে, বায়ুদূষণ একটি প্রধান কারণ। শহরে বায়ুদূষণ বেশি, গ্রামে কম, তাই প্রকোপের মাত্রাও কম। আমাদের কাছে আরো একটি প্রশ্ন ছিলকেন করোনার প্রকোপ শহরের বাসাবাড়ির চেয়ে বস্তিতে কম। আমরা তার গবেষণা করিনি। তবে কি নগরীর বাসভবনগুলোয় বদ্ধ অবস্থায় বাতাস চলাচল কম বলেই বাতাসে একবার করোনা সংক্রমিত হলে বাড়ির সবাইকেই আক্রমণ করে? নাকি বস্তির লোকেরা বদ্ধ পরিবেশ থাকে না, দিনের অধিকাংশ সময়ই বাড়ির বাইরেই কাটায়, তাই তাদের মধ্যে সংক্রমণের হার কম? আমরা এখনই প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগ।  

 

. সৈয়দ আবুল বাশার: ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক

. . কে. এনামুল হক: ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫