তরুণ প্রজন্মের নীতি গবেষণামূলক প্লাটফর্ম 'ইয়ুথ পলিসি ফোরাম' (ওয়াইপিএফ) শুরু করেছে 'রোড টু রিফর্মস' শীর্ষক সেমিনার সিরিজ। যেখানে আলোচনার মূল বিষয় হল বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন জরুরি খাত পুনর্গঠন করা। এই সিরিজের দ্বিতীয় এপিসোড - 'ফরেন পলিসি রিফর্মস-একাডেমিক প্যানেল’ অনুষ্ঠিত হয় গত ২৪ আগস্ট।
এ এপিসোডে প্যানেলিস্ট ছিলেন ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, প্রফেসর- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডিরেক্টর- সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ। আরো ছিলেন ড. লাইলুফার ইয়াসমিন, প্রফেসর- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সংলাপটি সঞ্চালনা করেন মারজুক আহমেদ, ডেপুটি লিড, ওয়াইপিএফ পলিসি অ্যাডভোকেসি।
এই এপিসোডের প্রতিপাদ্য ছিল বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সংস্কারেকল্পে যথাযথ পরামর্শ ও প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা।
আলোচনা শুরু হয় প্রফেসর ইমতিয়াজের দেয়া ‘ইয়ুথ’ শব্দটির একটি আকর্ষণীয় সংজ্ঞা দিয়ে। তিনি বলেন, ইয়ুথ শব্দটি বয়সের সাথে সম্পর্কিত নয়। যে পরিবর্তন করতে চায় সেই ইয়ুথ।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ নানা দেশের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে।
এমনকি মায়ানমারের মতো দেশের সাথেও আমরা আমাদের ফরেন পলিসির মূলনীতি ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়’ বজায় রাখি।
প্রফেসর ইয়াসমিনের মতে, ২০০০ সালের দিকে বাংলাদেশ যেমন ছিল, এখন সেখানে আমূল পরিবর্তন এসেছে।
আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন অন্যতম উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে পাই যে, ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান হামলার পরও জাপান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন ১৯৭১ সালে ভারত আমাদের সহায়তা করেছিল এবং এই বন্ধুত্ব সর্বদা থাকবে। ভারত আমাদের চিরস্থায়ী বন্ধু। এর পাশাপাশি আমরা অন্যান্য দেশের সাথেও সুসম্পর্ক স্থাপনে লক্ষ্য রাখতে পারি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি উঠতি শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান হচ্ছে। সুতরাং আমাদের স্বাগত জানানো উচিত সকল পরাশক্তিদের যারা বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করবে।
চীনের বৃহৎ শক্তিরূপে উত্থান প্রসঙ্গে ড. আহমেদ ‘পুনরুত্থান’ শব্দটি ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ইতিহাস দেখলে আমরা বলতে পারি যে কোন বড় শক্তির উত্থান শান্তিপূর্ণভাবে হয়নি। এখনো আসলে সঠিক বলা সম্ভব নয় যে চীনের ‘পুনরায় উত্থান’ শান্তিপূর্ণভাবে হবে কিনা। এর সাথে তিনি যোগ করেন যে চীনের পুনরুত্থান হয়েছে বিশ্বায়নের মাধ্যমে, কলোনিয়ালিজমের মাধ্যমে নয়। কিন্তু আমাদের এলিটদের মধ্যে এখনো কলোনিয়াল মেন্টালিটি আছে, যেটার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
ড. ইয়াসমিনের মতে, বাংলাদেশের কুটনৈতিক ও অভিবাসীদের রোহিঙ্গা সমস্যাটি বিশ্বের সামনে প্রকটভাবে তুলে ধরা উচিত, প্রচার করা উচিত। যেহেতু বাংলাদেশের ফরেন পলিসির মাঝে অন্তর্নিহিত রয়েছে নিপীড়িত জনগনের পাশে দাড়ানোর লক্ষ্য। সুতরাং, ড. ইয়াসমিন মনে করন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে একটি ‘কন্সার্ট ফর রোহিঙ্গা’ আয়োজন করা যেতে পারে।
তরুণদের কাজ হবে রোহিঙ্গা বিষয় এই সাফল্য বা রিয়েলিটিকে বেশি করে প্রচার করা, এনগেজমেন্ট করা।
আলোচনায় উপস্থিত দুই আলোচকের মতে, ইয়ুথ পলিসি ফোরাম বিশ্বের তরুণ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে এধরনের একটি আয়োজন করতে পারে।
তারা দুজনই মনে করেন যে, রোহিঙ্গা সমস্যার সাথে দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয় ও বৈশ্বিক নানা তাৎপর্য জড়িত আছে। বাংলাদেশ চাইলেই ভৌগলিক ভাবে এই সমস্যা থেকে সড়ে দাঁড়াতে পারে না।
ড. আহমেদ এই প্রসঙ্গে সকলকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ের দুইটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের কথা মনে করিয়ে দেন।
প্রথমতঃ রায়টি সর্বসম্মত ছিল এবং এই রায়ে ‘রোহিঙ্গা’ নামকরণের বিষয়টি উঠে এসেছে। এই দুইটি বিষয় রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে মায়ানমারের অবস্থানে বাধা সৃষ্টি করে। তিনি এখানে যোগ করেন যে, এবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে সময় লাগছে। কারণ, এবার বাংলাদেশ এবং জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এর বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে।
ডানপন্থী সরকারদের ঊর্ধ্বগতি ও বিশ্ব সম্পর্কে প্রফেসর আহমেদ বলেন, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে এবারের মহামারীর সময় বিশ্বের বহু বড় দেশেই ডানপন্থী বা রক্ষণশীল সরকার ক্ষমতায় আছে।
তার মতে, এই সরকারেরা জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে বিশ্বায়ন তাদের জন্য উৎকৃষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন রয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র হয়তোবা জাতিসংঘ থেকে সড়ে যাবে। যদি যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবেই আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে তার বিচরণ কমিয়ে দেয়, তাহলে তার এক বিশাল প্রভাব পুরো বৈশ্বিক রাজনৈতিক কার্যাদির উপর পরিলক্ষিত হবে।
প্রফেসর ইয়াসমিন এখানে যোগ করেন, আমেরিকার মতো একটি প্রভাবশালী দেশ যদি জাতিসংঘের সাথের সম্পর্ক পূণর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি চিন্তার ব্যাপার হবে এবং বহুপাক্ষিকতায় এটি একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
আলোচনার শেষে প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ সকলকে মনে করিয়ে দেন, আমরা উন্নত হচ্ছি, আমাদের শত্রু বাড়বে, কখনো কমবে না। তাই আমাদের স্মার্ট হতে হবে। আমাদের একটা জিনিস সব সময় মাথায় রাখতে হবে যে আমরা বিশ্বের ৭ম বৃহৎ জাতি। ১৬ কোটি মানুষের মার্কেট অনেক বড় একটি শক্তি ও সুবিধা। আমাদের এই স্ট্রং পয়েন্টগুলো মাথায় রাখতে হবে। তাঁর মতে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আমরা কিভাবে দেশে রাখতে পারি তা নিয়ে ভাবতে হবে। তিনি বিশ্বাস করেন যে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে এক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এই ডায়ালগটি ইয়ুথ পলিসি ফোরামের ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেল “Youth Policy Forum’ -এ দেখা যাবে। ‘রোড টু রিফর্ম’ সিরিজের অন্য এপিসোডগুলো পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের ৫০তম জন্মবার্ষিকী পর্যন্ত প্রচারিত করা হবে। আয়োজনের মিডিয়া পার্টনার দৈনিক বণিক বার্তা।
নওশিন নূর: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।