নিজের সাফল্যের রহস্য অন্যকে জানতে দিলে কেউ অসফল হয়ে যায় না

প্রকাশ: আগস্ট ২৬, ২০২০

মোহাম্মদ ফাছিহ-উল ইসলাম শাইয়্যান

অনেক ধনী ব্যক্তিই নিজের সাফল্যের পেছনের কাহিনী গোপন রেখে দেন। অন্য কোনো মানুষকে নিজের সাফল্যের সূত্রটি শোনাতে চান না। তারা বলেন- ‘এদেরকে গরীব রেখে দাও!’

আমি জীবনে অনেক ধাক্কা খেয়েছি। জীবনে অনেকবার অর্থনৈতিক ভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছি। আমাকে একবার শুধু আলু খেয়ে থাকতে হয়েছিল। বন্ধু সেজে কাছে এসে পিছনে ছুরি মেরেছে, এমন ঘটনাও আমার জীবনে ঘটেছে। কিন্তু, কখনো সেইসব মানুষ সম্পর্কে খারাপ ধারণা পর্যন্ত করিনি। কারণ, আমি এরকমই! মানুষকে বিশ্বাস করা আমার জন্মগত স্বভাব।

বেশিরভাগ মানুষই জীবনে সব সময় ভালো থাকতে চান। অথচ, এটা হওয়া সম্ভব নয়। অন্য অনেকের মতোই আমিও এরকম চিন্তার ফাঁদে পড়েছিলাম। সব সময়ই ভালো থাকতে চাইতাম। আমি জানতাম না- আধ্যাত্মিকতা অর্থ মানে শুধু ভালো হবে তা নয়, জীবনে মাঝে মাঝে মন্দের দেখা পাওয়াও আধ্যাত্মিকতার অংশ। সাফল্য লাভ বা অসাফল্যের মুখোমুখি হওয়াও এর বাইরে নয়।

বেশির ভাগ দরিদ্র মানুষই টাকা-পয়সার অভাবে দারিদ্রতার মুখোমুখি হয়। কিন্তু, আমি এমন একটি বংশে জন্মে নিয়েছি, যারা সত্যিকার অর্থে, মানসিক ভাবে দরিদ্র। আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি আসলে কি বলতে চাচ্ছি?

ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু শ্রেণীর ভেদা-ভেদ এইসব কিছুই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। কারা মধ্যম আয়ের লোক আর তাঁদেরকে কেমন ভাবে চলতে হবে, তা আমি আমার পরিবার থেকেই শিক্ষা প্রাপ্ত হয়েছি।

যেসব তরুণ-যুবক ঘরে বসে রয়েছেন, জীবনে কি করতে হবে বুঝতে পারছেন না, বা টাকার অভাবে কোন কিছু করতে পারছি না- এমন চিন্তাধারায় আক্রান্ত -তরুণদের বলছি, এগুলো আপনাদের শিখানো হয়েছে। চাকরি পেতে কঠোর পরিশ্রম করো বা ধনী ব্যক্তিরা ভালো লোক নয়- একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন, এমন চিন্তার সূতিকাগার আপনার পরিবার।

আমাদের স্কুলগুলো কখনোই কিভাবে টাকা আয় করতে হবে তা শেখায় না। আমাদের শিক্ষালয়গুলোতে কীভাবে একজন কর্মচারী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা আইনজীবী হতে হয়, তা শিক্ষা দেওয়া হয়। এটা যদিও আমাদের জীবনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু, এই শিক্ষার অসারতার দিকটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। কারণ, আমাদের স্কুলগুলোতে কিভাবে টাকা আয় করতে হয় তা শিক্ষা দেয় না! আমি অন্ততঃ সেই শিক্ষা পাইনি।

আমাকে হয়তো জিজ্ঞাসা করা হবে, আপনি যে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বলছেন, আপনার বাবাও তো এই একই শিক্ষা ব্যবস্থাতে বড় হয়ে ধনী হয়েছেন। আসলে, আমার বাবা আমার দাদার ১৩ ছেলে-মেয়ের পরিবারে পড়া-লেখার ক্ষেত্রে খুব একটা সহযোগিতা পাননি। জীবনে নিজের বৃত্তির টাকা জমিয়েই পড়া-লেখা করেছেন। পড়া-লেখা করতে কষ্ট করতে হয়, সেই ভাবনা তার মনে এমন ভাবে গেঁড়ে গিয়েছিল যে, আমার ছোট ভাইকে একবার নাইট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন।

আমার বাবার সেই শিক্ষা হয়তো আমাদের জন্যে আশির্বাদ হয়েই দেখা দিয়েছিল। আসলে, মাঝে মাঝে, আমাদের মধ্যে এমনসব জিনিস আশির্বাদ বয়ে নিয়ে আসে, যা বাইরে থেকে দেখলে সেইসব জিনিসকে আশির্বাদ হিসেবে মনে হয় না। আমার নাইট স্কুলে পড়া ভাইটা এখন যুক্তরাজ্যের একটি আই,টি কোম্পানী'র চিফ টেকনোলোজি অফিসার। ঢাকার একটি অখ্যাত কলেজে পড়া আমি এখন একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির বাংলাদেশ পার্টনার হিসেবে ব্যবসা করছি। ঢাকার একটি অখ্যাত স্কুলে পড়া আমার আরেক ছোট ভাই একজন চিকিৎসক।

আমার বাবা শিক্ষক হিসেবে তার বাবার আর্থিক কষ্টকে পেয়েছিলেন। তাই, তার ছেলেরা এভাবে বড় হয়েছে। আর, আমি শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যাদের পেয়েছি, তারা ছিলেন একেকজন শিক্ষক নামের কলংক। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, আমি একবার আমার শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- ‘এই যে ক্যালকুলাস শিখছি, এটা আমার কী কাজে লাগবে?’

আমার শিক্ষক চোখ লাল করে তার সামনের টেবিলকে দেখিয়ে বললেন- এইটার নিচে মাথা দিয়ে বল, গতকালকে পড়ানো ‘এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার’-এর সূত্র মুখস্থ করেছিস কি না?

আমি টেবিলে মাথা ঢুকিয়ে আবারো প্রশ্ন করলাম- ‘স্যার, এটা কি আমার কোন কাজে লাগবে?’

তিনি বলেছিলেন- ‘না।’

‘তাহলে, আমাদেরকে এটা পড়াচ্ছেন কেন!’

তার উত্তর ছিল- ‘কারণ, আমি এটা পড়ানোর জন্যেই বেতন পাই।’

আপনার জীবনে অনেক ধরণের শিক্ষক পাবেন। আপনাকেই খুঁজে নিতে হবে- তাদের মাঝে কে নকল আর কে আসল। নকল শিক্ষকেরা যা বলেন তা নিজে করেন না। একজন আসল শিক্ষক সেটাই করেন যা তিনি অন্য মানুষকে করতে বলেন।

আমি প্রতিটি দিন আমার কাজ করে যাচ্ছি। আমার যেমন অ্যাকাউন্ট্যান্ট আছেন, ঠিক তেমনি আছেন একজন আইনজীবী। সর্বোপরি, আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে আমরা একটি দলের মতো কাজ করে যাচ্ছি।

কিন্তু, সবাই আপনাকে এটা বলবে না। অনেক ধনী এই কথাগুলো লুকিয়ে রাখবেন। দরিদ্রতা আসলে মানসিক সমস্যা। আমাদের মানসিকতাই আমাদের দরিদ্র করে রাখে।

আমরা যা চিন্তা করি তা পরবর্তীতে আমাদের রক্ত-মাংসে মানুষে পরিণত করে। 'আমি গরীব', 'আমার এটা করার সাধ্য নেই'- এই শব্দগুলোর দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে দেখুন। আমার বাবা যদি নিজের কষ্টের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকতেন, তাহলে নিজের ছেলেদের ধনী বানিয়ে যেতে পারতেন না।

দরিদ্র মানুষেরা বলে- ‘আমি এই কাজ করতে পারবো না’, ‘এটা করার মতো এতো টাকা আমার নেই’ -এটা আসলে এক ধরনের আত্মসমর্পণ, জীবনের সকল বাধা দেখে পালিয়ে যাওয়া। ‘এটা করার মতো সাধ্য আমার নেই’- বলাটা আসলে খুব সোজা বলেই দরিদ্র মানুষেরা তা করে।

আসলে, আমার বাবা যদি তার জীবনের প্রথম দিকের ধাক্কার কাছে আত্মসমর্পণ করে আমাদের ঘরে বসিয়ে রাখতেন, তাহলে কী হতো? আমাদেরকে যদি উচ্চ শিক্ষার জন্যে বিদেশ না পাঠাতেন, তাহলে আমাদের কি হতো?

আসলে, তিনি জীবনযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেননি। ‘এটা করার মতো এতো টাকা আমার নেই’- এই কথাটি জীবনে বলেননি। বরং, বলেছেন- ‘আমি কীভাবে আমার সীমিত আয়ের মাঝেও তোমাদের সাহায্য করতে পারি’।

জীবনের এই কোলাহলে, কিছু কিছু চিন্তা আমাদের স্বত্বাকে প্রসারিত হতে দেয় না। আমাদের চিন্তাকে জট পাকিয়ে ফেলে। ‘আমার কিছু নেই’, ‘আমি কিছু করতে পারবো না’ -এমন চিন্তা আমাদেরকে বুদ্ধিহীন জড় পদার্থে পরিণত করে। কিছু প্রশ্ন, আমাদের চিন্তাকে প্রসারিত করে, আবার কোন কোনটি চিন্তার গতিকে থামিয়ে দেয়।

ফুটবল একটি টিম গেইম। ক্রিকেটও তা-ই। কিন্তু, খেলা দুটোর নিয়ম ভিন্ন। প্রতিটি খেলাই ভিন্ন ভিন্ন। মানুষের ক্ষেত্রেও বলতে হবে, তারা একই রকম রক্ত-মাংসে গড়া হলেও, একেকজন চলে একেক রকমের।

আমি তরুণ-যুবাদের বলবো, আপনারা আপনাদের নিজের জীবনের খেলাটি বেছে নিন। 

রবার্ট কাওয়াসাকির একটি সাক্ষাৎকার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা

মোহাম্মদ ফাছিহ-উল ইসলাম শাইয়্যান

হেড অব হিউম্যান রিসোর্সেস, সফট লাইট

[email protected]


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫