করোনায় দেশে ফেরা প্রবাসীরা জীবিকা সংকটে

আর্থিক সুরক্ষা প্রদান ও পুনর্বাসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হোক

প্রকাশ: আগস্ট ১৪, ২০২০

চলমান কভিড-১৯ মহামারীতে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় এবং বৈশ্বিক চলাচলের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অভিবাসী কর্মী রেমিট্যান্সনির্ভর জনগোষ্ঠীর ওপর। কর্মরত দেশে উপার্জন ব্যবস্থা, সামাজিক সেবা, স্বাস্থ্যসেবা সামাজিক সহায়তার নেটওয়ার্কের অভাবে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি-জুন সময়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। দেশে ফিরে  কোনো কাজ না পাওয়ায় জীবিকা সংকটে রয়েছেন ৭০ শতাংশ প্রবাসী কর্মী। আর ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন ৫৫ শতাংশ বিদেশফেরত। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাম্প্রতিক এক গবেষণা জরিপে তথ্য উঠে এসেছে। দেশে আসা প্রবাসীরা যে বর্তমানে এক অনিশ্চয়তাময় কষ্টক্লিষ্ট সময় অতিক্রম করছেন, তা জরিপের ফল থেকেই স্পষ্ট। চলতি দুঃসময়ে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সর্বোতভাবে পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

বলার অপেক্ষা রাখে না, অনেক পরিবারের জীবিকার একমাত্র উৎস প্রবাসীয় আয়। এখন উপার্জনকারী দেশে এসে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ায় পরিবারগুলোকে জীবনযাত্রার মান কমাতে হয়েছে। আগের চেয়ে লক্ষণীয় কমে সংসারের মাসিক খরচ চালাতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে শিশুরা দুধ, ডিম, মাংস কম পাচ্ছে। অনেকের ধারকর্জ করে চলতে হচ্ছে। প্রবাসী আয়ের সুবাদে যেসব পরিবার দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠেছিল, তারা করোনার কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে নামার আশঙ্কায় রয়েছে। অবস্থায় সুষ্ঠুভাবে তালিকা তৈরিপূর্বক সংকটে থাকা বিদেশফেরতদের আর্থিক সহায়তা জোগানো জরুরি। নইলে পরিবারগুলোর দুর্ভোগ আরো দীর্ঘতর হবে বৈকি। তাই বিষয়টি আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তা কাম্য।

লক্ষণীয়, নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর শুরুতে মার্চে কিছুটা হোঁচট খেলেও এর পর থেকে দেশের প্রবাসী আয়ে চলছে ঊর্ধ্বমুখী ধারা। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রেকর্ডের পর কোরবানির ঈদ ঘিরে জুলাইয়ে রেমিট্যান্স নিয়ে প্রত্যাশাও ছাপিয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাইয়ে দেশে ২৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে; যা এক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স ছিল গত জুনে, ১৮৩ কোটি ২৬ লাখ ডলার। অবশ্য রেমিট্যান্স বৃদ্ধিকে অর্থনীতিবিদরা অন্যভাবে দেখছেন। তাদের ভাষ্য, দুর্যোগকালে বেশি অর্থ পাঠানো একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। তদুপরি চাকরি হারানো, ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া, রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রথাগত পদ্ধতিতে আকস্মিক অনিশ্চয়তা, শ্রমিক নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারা হুন্ডির ব্যবহার হ্রাস, আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে অর্থ প্রেরণে প্রণোদনা প্রভৃতি কারণে প্রবাসী আয় বেড়েছে। উল্লেখ করা দরকার, একবারে বিদেশ থেকে অর্থ পাঠানো কঠিন। ধাপে ধাপে পাঠানোর কারণে হয়তো আরো কয়েক মাস ঊর্ধ্বমুখী ধারা বজায় থাকার সম্ভাবনা আছে। তাই রেমিট্যান্সের আপাত উল্লম্ফনকে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে অনাগত খারাপ সময়ের জন্য রাষ্ট্রকে সার্বিকভাবে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।

এদিকে আইওএম পরিচালিত জরিপে অংশ নেয়া ৭৫ শতাংশ কর্মী জানিয়েছেন, বিদেশেই কর্মসংস্থানে আগ্রহী তারা। ৯৭ শতাংশ ফিরতে চান আগের কাজে। তার মানে ফের কর্মস্থলে ফিরে যাওয়াকেই তারা প্রাধিকার দিচ্ছেন। এই আগ্রহ গভীরভাবে বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে তাদের কর্মরত দেশগুলোয় পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ওইসব দেশের সরকারের সঙ্গে জোরদার করতে হবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে।

অভিযোগ রয়েছে, অর্থনৈতিক অভিঘাতে শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ায় কিছু দেশ জবরদস্তি করে প্রবাসী শ্রমিকদের ফেরত পাঠাচ্ছেন। অনেক সময় তারা পাওনাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। বিনা পাওনায় শ্রমিকদের পাঠানো বন্ধ করতে দূতাবাসগুলোর ভূমিকা রাখতে হবে, দরকষাকষির ক্ষমতা বাড়াতে হবে। উপরন্তু, প্রত্যাগতদের সুষ্ঠু পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। উপযুক্তরূপে দক্ষ করে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়ে আসা এবং কাজের ব্যবস্থা করা জরুরি। কিছু দেশ রয়েছে, যারা অত্যধিক অভিবাসীনির্ভর। আপাতভাবে চাহিদা কমলেও পূর্ণমাত্রায় অর্থনীতিগুলো সচল হলে সেসব দেশে পর্যায়ক্রমে শ্রমিকের চাহিদা তৈরি হবে। সেটি মাথায় রেখে ত্বরিত, বাস্তবধর্মী সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের জনশক্তি রফতানি বাজারের পর্যালোচনাও এখন সময়ের দাবি। করোনা মহামারী বিশ্ব জনস্বাস্থ্যে নজিরবিহীন বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। সুতরাং করোনা-পরবর্তী সময়ে সব দেশই যে জনস্বাস্থ্যে নজর দেবে, সেটি খুবই যুক্তিসংগত। সুতরাং নতুন শ্রমবাজার খুঁজতে চাইলে দেশের বিদ্যমান প্রবাসী শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে স্বাস্থ্যকর্মীমুখী হিসেবে তৈরি করতে হবে। পাঠ্যক্রমে আনতে হবে সংস্কার, সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে কারিগরি প্রশিক্ষণে। দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রাধিকার দিলে আমাদের জন্য নতুন বাজার পেতে অসুবিধা হবে না। সহায়ক দীর্ঘমেয়াদি নীতি নিয়ে সরকার জনশক্তি রফতানির ধারা বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে এবং চলমান সংকট দূরদর্শিতার সঙ্গে মোকাবেলা করবে, এটিই প্রত্যাশা।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫