করোনাকালে আমানত প্রবৃদ্ধির শীর্ষে ট্রাস্ট, সিটি ও ব্র্যাক ব্যাংক

প্রকাশ: আগস্ট ১২, ২০২০

হাছান আদনান

সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ইসলামী ব্যাংকের

করোনাভাইরাসের কারণে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। পরিস্থিতির মধ্যেই এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে ঋণে আমানতে শতাংশ সুদহার। দুইয়ের প্রভাবে গ্রাহক হারিয়েছে কিছু ব্যাংক। আবার উল্টোটাও ঘটেছে অনেক ব্যাংকের ক্ষেত্রে, বেড়েছে আমানত প্রবৃদ্ধি। করোনাকালে আমানত প্রবৃদ্ধির শীর্ষে রয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংক, দ্য সিটি ব্যাংক ব্র্যাক ব্যাংক। তবে টাকার পরিমাণের দিক দিয়ে সময়ে সবচেয়ে বেশি আমানত বেড়েছে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের।

দেশের বেসরকারি খাতের ৩০টি ব্যাংকের আমানতের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছে বণিক বার্তা। ব্যাংকগুলোর জুনভিত্তিক আর্থিক প্রতিবেদন, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের তথ্য শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে আমানতে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে বড় ভালো ভাবমূর্তিতে থাকা ব্যাংকগুলোর। সময়ে ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমানতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংকের।

পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে ট্রাস্ট ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ২৪ হাজার ১৮২ কোটি থেকে বেড়ে ২৭ হাজার ২৮৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। সরকারি কিছু প্রকল্পের বড় অংকের অর্থ জমা হওয়ায় ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে বলে জানা গেছে।

তবে ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক মঈনউদ্দীন বণিক বার্তাকে বলেন, ট্রাস্ট ব্যাংকের করপোরেট সুশাসন অত্যন্ত শক্তিশালী। সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ব্যাংকের উদ্যোক্তা হওয়ায় বরাবরই ব্যাংকটির প্রতি গ্রাহকদের আস্থা বিশ্বাস দৃঢ়। এজন্য করোনাকালেও সাধারণ গ্রাহকরা ট্রাস্ট ব্যাংকে আমানত রাখতে আসছেন। আমাদের ব্যাংকের এডি রেশিও ৮০ শতাংশের নিচে। স্থায়ী আমানতের জন্য আমরা সাড়ে শতাংশের বেশি সুদও দিচ্ছি না। তার পরও ট্রাস্ট ব্যাংকে টাকা রাখার জন্য গ্রাহকরা আসছেন। অন্য ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া আমানতও আমাদের ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট হচ্ছে। তবে এটি ঠিক যে আমানতে বড় প্রবৃদ্ধি হওয়ার পেছনে সরকারি কিছু প্রকল্পের অর্থ জমা হওয়াও ভূমিকা রেখেছে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আমানতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে দ্য সিটি ব্যাংকের। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে হাজার ৮২১ কোটি টাকা। আমানত প্রবৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দ্য সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, করোনাকালীন দুঃসময়েও সিটি ব্যাংকের আমানতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটি ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থারই বহিঃপ্রকাশ। ঋণের সুদহার শতাংশ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমরা কস্ট অব ফান্ড কমানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এজন্য আমানতের সুদহারও কমিয়ে আনা হয়েছে। তার পরও সিটি ব্যাংকের আমানত বাড়ছে।

তিনি জানান, অনেক ব্যাংকে থাকা বেশি সুদের আমানতও কম সুদে সিটি ব্যাংকে আসছে। গ্রাহকরা ভালো ভিত মজবুত এমন ব্যাংকে আমানত রাখতে বেশি নিরাপদ বোধ করছেন।

করোনাকালে আমানত প্রবৃদ্ধিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। আমানত প্রবৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ২০ শতাংশ।

আমানত প্রবৃদ্ধির হার দশমিক ৮৪ শতাংশ হলেও টাকার পরিমাণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত বেড়েছে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের। চলতি বছরের প্রথমার্ধে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। জুলাই মাসে ব্যাংকটির আমানত প্রবৃদ্ধি আরো বেড়েছে। বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আহরণ এজেন্ট ব্যাংকিং ইসলামী ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধির বড় কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আমানত সংগ্রহে ভালো অবস্থায় থাকা অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে পূবালী ব্যাংকের দশমিক ৭৮ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ার দশমিক ৮১ শতাংশ এবং প্রাইম ব্যাংকের দশমিক ৪৬ শতাংশ আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এছাড়া শতাংশের বেশি আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে উত্তরা, সাউথইস্ট, এসআইবিএল এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের। আর শতাংশের বেশি আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রিমিয়ার, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউসিবি, এনসিসি শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের।

নয়-ছয় কার্যকর হওয়ার আগে বেশি সুদ দিয়েই করপোরেট ব্যক্তি শ্রেণীর গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করত ছোট দুর্বল ব্যাংকগুলো। কিন্তু এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কম সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এতেই ছোট ব্যাংকগুলো থেকে আমানত বেরিয়ে যাওয়ার হিড়িক পড়েছে।

গত পাঁচ মাসে চতুর্থ প্রজন্মের প্রায় প্রতিটি ব্যাংকের আমানত কমেছে। চতুর্থ প্রজন্মের সাউথ বাংলা এগিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) আমানত কমেছে দশমিক ৪৫ শতাংশ। ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী তারিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সাধারণত ডিসেম্বরে ব্যাংকের আমানত কিছুটা বাড়ে। আমাদের ব্যাংক থেকে জানুয়ারিতেই বড় অংকের আমানত বেরিয়ে গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে চাহিবামাত্র আমরা গ্রাহকদের আমানতের টাকা বুঝিয়ে দিয়েছি। বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ সময় গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেছেন। কারণে আমাদের ব্যাংকের আমানত কিছুটা কমেছে। তবে নতুন ব্যাংক হিসেবে ঋণ আমানতের সুদহার কমাতে গিয়ে আমাদের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

নতুন ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি দেশের পুরোনো প্রতিষ্ঠিত কিছু বেসরকারি ব্যাংকেরও আমানত চলতি বছরে কমেছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আমানত কমেছে দশমিক শূন্য শতাংশ। যদিও কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক উন্নতি করছে ব্যাংকটি।

আমানত কমে যাওয়ার বিষয়ে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বড় কিছু করপোরেটের উচ্চসুদের আমানত আমরা ছেড়ে দিয়েছি। এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। অথচ ওই গ্রাহকরা আমানতের সুদ কমানোর পক্ষে ছিলেন না। কস্ট অব ফান্ড কমানোর তাগিদ থেকেই আমাদের কিছু উচ্চসুদের আমানত ছাড়তে হয়েছে। আমানত কমার পরও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এডি রেশিও ৮২ শতাংশের নিচে আছে। এজন্য আপাতত শঙ্কার কিছু দেখছি না। মার্কেন্টাইল ব্যাংক বরাবরই ছোট গ্রাহকদের আস্থা ভালোবাসায় সামনে এগিয়েছে।

বেসরকারি খাতের অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে মেঘনা ব্যাংকের শতাংশ, এবি ব্যাংকের দশমিক ৭৭, মধুমতি ব্যাংকের দশমিক ৯০, যমুনা ব্যাংকের দশমিক ৬৮ এবং ওয়ান ব্যাংকের দশমিক ৫৮ শতাংশ আমানত কমেছে।

আমানত কমার দিক থেকে সবার নিচে আছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) চলতি বছরের প্রথমার্ধে ব্যাংকটির ৭৪ কোটি টাকার আমানত কমেছে। প্রসঙ্গে এমটিবির শীর্ষ নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কস্ট অব ফান্ড কমানোর স্বার্থেই আমরা কিছু উচ্চসুদের স্থায়ী আমানত ছেড়ে দিয়েছি। তবে এখনো কিছু ব্যাংক বাজার থেকে উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহ করছে। আমি জানি না, উচ্চসুদে সংগৃহীত আমানত দিয়ে ওই ব্যাংকগুলো কী করবে। যেখানে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার শতাংশে নির্ধারিত।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যানের ভাষ্য, ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণ ফিরে আসছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক করোনার কারণে ঋণের কিস্তি ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেছে। এজন্য সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও গ্রাহকরা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছে না। আমরা জানি না, ৩০ সেপ্টেম্বরের পর ঠিক কতজন গ্রাহক ব্যাংকের টাকা ফেরত দেবে। বিনিয়োগের অর্থ ফেরত না পেলে দেশের অনেক ব্যাংকই গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হবে। এর ফলে আর্থিক খাতে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে, সেটির জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া দরকার।

দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে দশমিক ৬১ শতাংশে, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেক। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। যদিও দেশের ব্যাংকগুলোর হাতে জমা হয়েছে বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্য। জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর হাতে বিনিয়োগযোগ্য তারল্য ছিল লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। আমানতের প্রবৃদ্ধির চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য জমা হয়েছে। জুন মাসে ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ, বিপরীতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দশমিক ৬১ শতাংশে নেমেছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫