‘পাশ্চাত্যে থাকলে শুধু বেহালাবাদক হিসেবেও খুব নাম করতেন’

প্রকাশ: আগস্ট ১২, ২০২০

দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে আগস্ট প্রয়াত হলেন দেশের কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী তিনি বাংলা গান বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রে অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান তৈরি করেছেন তিনি একই সঙ্গে সুরকার, সংগীত পরিচালক, বেহালাবাদক গীতিকার আলাউদ্দিন আলী সংগীত পরিচালনা করে বেশ প্রশংসিত হন গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, কসাই যোগাযোগ চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৮৮ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন ১৯৮৫ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান এছাড়া তিনি খ্যাতিমান পরিচালক গৌতম ঘোষ পরিচালিত পদ্মা নদীর মাঝি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন তার সুর করা গানের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও বেশি জীবদ্দশায় আলাউদ্দিন আলী আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন

আলীউদ্দিন আলীর সুরে দেশের অনেক বরেণ্য শিল্পী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা, মিতালী মুখার্জী, সৈয়দ আবদুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমিনসহ আরো অনেকে তালিকায় প্রবীণ সংগীতশিল্পী খুরশীদ আলমও রয়েছেন তিনি আলাউদ্দিন আলীর সুর করা প্রায় ২০টির মতো গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে খুরশিদ আলমের পরিচয় ঘটে ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী খুরশীদ আলম টকিজের কাছে কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা আলাউদ্দিন আলীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন পাঠকদের জন্য স্মৃতিচারণ তুলে ধরা হলো

 আলাউদ্দিন আলী আমাদের সংগীতাঙ্গনে এককথায় নক্ষত্র ছিলেন তিনি সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তার বাবা সংগীত সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন, ভাইয়েরাও সংগীতের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন প্রথম দিকে আলাউদ্দিন আলী থাকতেন মতিঝিলে সেখানে থেকে রেডিওতে বিভিন্ন রেকর্ডিংয়ের ছোটখাটো কাজ করতেন তারপর আস্তে আস্তে টেলিভিশনের কাজ করেন একটা সময় তিনি আলতাফ মাহমুদকে সহযোগিতা করতেন সবসময় বলতেন, আলতাফ মাহমুদ আমার গানের জগতের গুরু অর্কেস্ট্রেশন বলতে যা বোঝায়, সেটা তিনি আলতাফ ভাইয়ের কাছ থেকেই খুব ভালো করে আয়ত্ত করেছিলেন তিনি সমর দাস, সত্য সাহা, আলি হোসেন শেষ দিকে দীর্ঘ সময় আনোয়ার পারভেজ সাহেবের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন


আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে মনিরুজ্জামান মনির নামে একজন বেশ ভালো কিছু কাজ করেছেন তারা একসঙ্গে কাজ করতেন, তখন আলাউদ্দিন আলী থাকতেন মতিঝিল কলোনিতে সেখানে একটা স্কুল আছে, সে স্কুলে নাটক হতো সেসব নাটকের সুরকার হিসেবে থাকতেন আলাউদ্দিন আলী গান গাইতাম আমি আর লিখতেন মনিরুজ্জামান মনির পরে আলাউদ্দিন আলী যখন বেতারে গান করেন, তখন আমারও কিছু গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল প্রায় ১৫-২০টি চলচ্চিত্রে তার সঙ্গে গান করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে তার সঙ্গে গান করা একটি চলচ্চিত্রের নাম ছিল ঝুমকা নায়ক ছিলেন আলমগীর সাহেব একটু চটকদার গান ছিল, খবর আছে গরম গরম/নারীর নাকী দিল নরম/ তবে তারা কেনো বেশরম/ এই কলি কালেতে/ আল্লাহ হেদায়েত কইরা দে ... এরপর আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আজাদ রহমান সাহেব, আলম খান, আনোয়ার পারভেজের সঙ্গে অনেক কাজ করি আলাউদ্দিন আলী মাঝে আবদুল হাদী ভাইকে পেলেন হাদী ভাইকে দিয়ে তিনি অনবদ্য কিছু গান করালেন যেমন আছেন আমার মোক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার, এই মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে, সূর্যোদয়ে তুমি সুর্যাস্তেও তুমিসহ অনেক ভালো গান করিয়েছেন মিতালী মুখার্জী আলাউদ্দিন আলীর সুর করা অন্তত ১০-১৫টা গান করেছেন গানগুলো অতুলনীয়, আমাদের জন্য অনেক বড় সম্পদ

আমি যদি ভুল না করি, ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন পরিচালক আমজাদ হোসেন সাহেবের ছবিতে এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বাংলাদেশ বা ভারতের শিল্পীদের দিয়ে তিনি তার কৃতিত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন

নায়ক জাফর ইকবালের সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল জাফর ইকবালের বোন শাহনাজ রহমতুল্লাহকে দিয়ে তিনি কিছু গান করিয়েছিলেন আমাদের স্মৃতিতে গানগুলো উজ্জ্বল হয়ে আছে যেমন একটি গান, যেভাবে আছি বেঁচে তো আছি এটি নুরুজ্জামান শেখের লেখা আলাউদ্দিন আলীর সুর করা সে সময় এটি ছিল একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী গান গানটা পরে আবার জাফর ইকবাল গেয়েছিলেন ওনার পরে লিনু বিল্লাহ গান এখনকার কাকরাইলের কর ভবনের ওখানে ইপসা স্টুডিও ছিল, সাফায়েত সাহেবের সেখানে গানটা রেকর্ড হয়েছিল


অনেকেই জানেন না, আলাউদ্দিন আলীর একটি গান করার অনেক শখ ছিল সোহরাব হাসান, সুধীন দাসের মতো জ্যেষ্ঠ শিল্পী থেকে শুরু করে একদম জুনিয়র ১০০ শিল্পীকে দিয়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ার ভাইয়ের লেখা চলমান পৃথিবীতে চলছে সবই, শুধু থেমে আছে কেন মানবতা গানটি করাতে চেয়েছিলেন আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে ১০০ জন শিল্পীকে দিয়ে গান করানো খুব দুরূহ ছিল পরে তিনি গানটি ১০ জন করে নারী পুরুষ শিল্পীকে দিয়ে করিয়েছিলেন আলাউদ্দিন আলী চলচ্চিত্রের বাইরেও বড় বড় অর্কেস্ট্রেশনের কাজ করেছেন

আলাউদ্দিন আলী শুরুর দিকে বেহালা বাজাতেন পরের দিকে তিনি কিবোর্ড বাজান তিনি যদি পাশ্চাত্যে থাকতেন, শুধু বেহালাবাদক হিসেবেও খুব নাম করতেন বলেই আমার বিশ্বাস তিনি যা- বাজাতেন, খুব নিষ্ঠা নিয়ে বাজাতেন তার হাত ছিল খুব ভালো তার হাতে যেকোনো যন্ত্র সুন্দর বাজত

আলাউদ্দিন আলী খুব ভোজনরসিক মানুষ ছিলেন তিনি দল বেঁধে খাওয়াতে খেতে পছন্দ করতেন এখনকার মতো আগে তো অত রেস্টুরেন্ট ছিল না অনেকেই তার জিনিসটা পছন্দ করতেন না

আলাউদ্দিন আলী হাসিখুশি মন খোলা মানুষ ছিলেন হিংসা-বিদ্বেষ কী জিনিস, তিনি জানতেন না কিন্তু যখন কাজ করতেন, তখন তিনি রাসভারী হয়ে যেতেন সুরের ভেতরে ঢুকে যেতেন একটা গানের হয়তো তিন-চার দিনব্যাপী সুর হচ্ছে; তখন তার আসল রূপটা দেখা যেত, কাজে কোনো ধরনের বিরক্তি পছন্দ করতেন না

আলাউদ্দিন আলী আটবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন একজন সংগীতজ্ঞের জন্য এটি অনন্য প্রাপ্তি আমার যদি ভুল না হয়, পাঁচটি পেয়েছেন গানের জন্য, তিনটি গীতিকার হিসেবে আমি বলব, আলাউদ্দিন আলীর চলে যাওয়া খুব বড় ক্ষতি, যে ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয় আল্লাহ তাকে নিয়ে গেছেন তার অনন্ত যাত্রা শান্তিময় হোক

শ্রুতলিখন: ফিচার প্রতিবেদক

 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫