কভিড-১৯ মহামারীর শুরুর দিকের দিনগুলোতে জনস্বাস্থ্য কর্তারা বিশ্বাস করতেন ভাইরাসের বিস্তুতি রোধ করতে সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর একটি হচ্ছে পৃষ্ঠতল জীবাণুমুক্তকরণ। যা চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, স্পেন এবং আরো অনেক দেশকে চালিত করেছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে জীবাণুনাশক স্প্রে করার দিকে। ট্রাকের বহর, ড্রোন এমনকি রোবট ব্যবহার করে রাস্তা, পার্ক, খেলার মাঠ এবং অন্যান্য জনপরিসরে ভাইরাস মারার এসব রাসায়নিক পদার্থ ছিটানো হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় ড্রোন দিয়ে ছিটানো জীবাণুনাশকে ঘরগুলো পর্যন্ত ভিজে গিয়েছিল। স্পেনের একটি গ্রামে ট্রাক্টর দিয়ে পাবলিক বিচে শত শত গ্যালন ব্লিচ ফেলা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা এই চর্চাকে জনগণের জন্য অকার্যকর ও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করে নিন্দা করেছিলেন। বিশেষ করে রাসায়নিক পদার্থগুলো নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করার ফলে শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতা তৈরি হয়। জীবাণুনাশক মিশ্রিত করার মাধ্যমে যেমন ব্লিচ ও অ্যামোনিয়া মারাত্মক গ্যাস ছড়াতে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
এই মাসে জীববিজ্ঞানীরা এনভায়রনমেন্টাল জার্নালে যৌথভাবে দাবি করেছিলেন যে নির্বিচারে এ ধরনের উপাদান শহুরে পরিবেশে ব্যবহারের কারণে বন্যপ্রাণীরা বেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
চীন প্রথম দেশ হিসেবে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শহরগুলোকে স্যানিটাইজ করা শুরু করে। এটা করার অল্প সময়ের ভেতরেই খবর আসতে থাকে যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত প্রাণীগুলো বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারিতে চোংকিং ফরেস্ট্রি ব্যুরোর একটি তদন্তে দেখা গেছে, চোংকিংয়ে বন্য শূকর, সাইবেরিয়ান বেজি ও ব্ল্যাকবার্ডসসহ ১৭টি প্রজাতির অন্তত ১৩৫টি প্রাণী মারা গেছে জীবাণুনাশকের সংস্পর্শে আসার পর। এই খবরটি প্রকাশ করেছে চীনের নিউজ এজেন্সি জিনহুয়া।
জীবাণুনাশক উপাদান যেমন সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট, ক্লোরিন এবং ব্লিচ ডাঙ্গা ও জল উভয় ধরনের প্রাণীর জন্য মারাত্মকভাবে বিষাক্ত বলে মন্তব্য করেছেন হেবেই নরমাল ইউনিভার্সিটির ইকোলজির প্রফেসর ডোংমিং লি। যিনি ‘এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ’-এর বিশ্লেষণের সহলেখকও, যা কিনা চোংকিং ফরেস্ট্রি ব্যুরোর তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল। লি বিশ্বাস করেন, জীবাণুনাশকের উচ্চ ব্যবহার বন্যপ্রাণীর আবাসকে সংক্রমিত করেছে।
লির দল এখন বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন যত্রতত্র জীবাণুনাশক ছিটানোর কাজটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তারা বলছেন, বৈজ্ঞানিক সমাজের কোনো ধরনের অংশগ্রহণ ছাড়াই কাজটি করা হচ্ছে।
ইকোলজি ১০১
রাসায়নিক জীবাণুনাশক ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য জীবাণুনাশককে তাদের কোষ ধ্বংস করে এবং প্রোটিন ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে হত্যা করে। যদি এটি মানুষ কিংবা প্রাণী নিঃশ্বাসে গ্রহণ করে কিংবা কোনোভাবে পাকস্থলীতে প্রবেশ করে, তবে এই উপাদান শ্বাসতন্ত্রের মিউকাস মেমব্রেনের ক্ষতি সাধন করতে পারে বা অস্বস্তি তৈরি করতে পারে। মারাত্মক অবস্থায় সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি মারা পর্যন্ত যেতে পারে।
চোংকিংয়ের মতো তদন্ত যেহেতু চীনের বাইরে পরিচালিত হয়নি, তাই এটা পরিষ্কার নয় যে কীভাবে বাইরের পরিবেশে জীবাণুনাশক ছড়িয়ে দেয়ার ফলে অন্য দেশগুলোর বন্যপ্রাণী এবং বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও এটা অনুমান করা একেবারে কঠিন নয়। আরবান ইকোলজির প্রফেসর ক্রিস্টোফার জে. শেল বলেন, যদি আপনি পরিবেশের মধ্যে বিষাক্ত পদার্থ রাখেন, তবে তা খাদ্যজালের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করবে।
যদিও চোংকিংয়ে মৃত্যুর ঘটনা জীবাণুনাশক দ্বারা বন্যপ্রাণীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বহুল পরিচিত উদাহরণ, তবে এমন ঘটনার আরো একটি উদাহরণ পাওয়া গেছে। মিয়ামির একটি আর্টিফিশিয়াল আইল্যান্ডে ওখানকার অ্যাসোসিয়েশন আউটডোরে স্যানিটেশন প্রোগ্রাম পরিচালনা করার পর সেখান অধিবাসী ও কুকুরগুলো অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।
এই প্রোগ্রাম শুরুর এক সপ্তাহ পর সেখানকার অনেক অধিবাসী যন্ত্রণাময় মাথাব্যথার কথা জানায় এবং অন্তত দুটি কুকুরের বমির সমস্যা দেখা দিয়েছিল বলে জানা গেছে। তবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের অনুরোধ সত্ত্বেও অ্যাসোসিয়েশনের কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সংরক্ষণ করুন, স্প্রে করবেন না
শুরুতে বলা হচ্ছিল বারবার স্পর্শ করা হয় এমন পৃষ্ঠতল স্যানিটাইজ করার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি কমানো যায়। কিন্তু এখন আমরা জানি যে বেশির ভাগ মানুষ অসুস্থ হয় নিঃশ্বাসের মাধ্যমে বাতাস থেকে আক্রান্তের ড্রপলেট গ্রহণের মধ্য দিয়ে।
এ কারণে মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাইরের পরিবেশে জীবাণুনাশক স্প্রে করার বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন। এ মত দেয়া হয় রাস্তা ও ফুটপাথকে সংক্রমণ ছড়ানোর রুট নয় এই বিবেচনায় এবং এ ধরনের কেমিক্যাল স্প্রের ফলে মানুষের চোখ, শ্বাসতন্ত্র ও ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে। যদিও ভিয়েতনাম ও ব্রাজিলের মতো দেশ এখনো জীবাণুনাশক স্প্রে করে যাচ্ছে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক