আপনাকে মনে রাখব

প্রকাশ: আগস্ট ১১, ২০২০

মানুষটা চলেই গেল। করোনার মহামারীর মধ্যেই তাকে যেতে হলো। ঘাতক ক্যান্সারে আক্রান্ত না হলে হয়তো তিনি আরো কিছুদিন গানের জগতে, আমাদের ভাবনায় রাজত্ব করতেন। নিশ্চিন্তে আরো নতুন নতুন গানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতেন। পরিবার ভক্তকুলের শ্রদ্ধা-ভালোবাসাতেও সিক্ত হতেন। মনের অজান্তে এমন কত কথা-ভাবনার উদয় হয়। কিন্তু কিংবদন্তি আলাউদ্দিন আলীকে নিয়ে আফসোসের শেষ হয় না। এক জীবনে কতকিছু করে গেলেন, মনে রাখার জন্য কতকিছু রেখে গেলেনসবই বিস্ময়ের। বেহালার করুণ সুরের সুরকার বেহালায় আটকে না থেকে কীভাবে চলচ্চিত্রের সংগীতজগতের সম্রাট বনে গেলেন সেটা আরো বিস্ময়ের।

সংগীতে ছোট চাচা সাদেক আলীর কাছে প্রথম হাতেখড়ি পাওয়া আমাদের আলাউদ্দিন আলী বাদ্যযন্ত্রেও সমান পারদর্শী ছিলেন। ছোটবেলাতেই বেহালা বাজানোর জন্য অল পাকিস্তান চিলড্রেনস প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। ফলে চলচ্চিত্রজগতে স্বভাবতই পা রাখেন বাদ্যযন্ত্রশিল্পী হিসেবেই। ঘটনাটি ১৯৬৮ সালের। ওই যাত্রায় আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে বেহালাবাদক হিসেবে যাত্রা হয় তার। একসময় চলচ্চিত্রের সংগীতে বেহালা বাজাতে বাজাতে সংগীত পরিচালনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে শুরুতে তিনি ব্যর্থ হন। ১৯৭৪ সালে মীর মোহাম্মদ হালিম পরিচালিত সন্ধিক্ষণ চলচ্চিত্রে তিনি সফলতা পাননি। সাফল্যের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে কয়েক বছর। কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের দেখা মেলে ১৯৭৭ সালে গোলাপি এখন ট্রেনে মাধ্যমে। তার তৈরি করা গান পায় বিপুল জনপ্রিয়তা। পরপর তিন বছর তিনি সংগীতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।


এতকিছুর পরও কোথায় যেন অপূর্ণতা থেকে যায়। আশির দশকের প্রথম দিকে নিজেই লিখে সুর করলেন একবার যদি কেউ ভালোবাসতো, আমার নয়ন দুটি জলে ভাসতো আর ভালোবাসতো হয়তো একসময় আলাউদ্দিন আলী অনুভব করলেন তিনি যথেষ্ট পেয়েছেন। দেশ-মাটি-মানুষের জন্য গান করেছেন; চলচ্চিত্র, বেতার, টেলিভিশনে সুরকার, গীতিকার সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করেছেন, অভাবনীয় খ্যাতি-যশ পেয়েছেন। এখন তার আর কি-বা পাওয়ার আছে! ভালোবাসায় আপ্লুত মানুষটি নব্বই দশকে জানালেন, ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়

চলচ্চিত্রে সংগীতের জন্য মোট আটবার জাতীয় পুরস্কার পাওয়া আলাউদ্দিন আলী একদিনের চেষ্টায় পর্যায়ে আসেননি। তার জন্য সাধনা করেছেন। সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন। নিজের কাজের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি এক সাক্ষাত্কারে জানিয়েছিলেন, আমি একটু বেশি খুঁতখুঁতে, কিন্তু আমি শিল্পীদের বেশি কষ্ট দিই না। আমি একটু ফোক, ক্ল্যাসিক্যাল মিলিয়ে অন্যরকম একটা কিছু সুর করার চেষ্টা করি। তাই শিল্পীরা কিছুটা তটস্থ থাকে। আমি মনে করি অনেক কিছু গান, শিল্প-সাহিত্যে আনা উচিত না। আনলে সাময়িক হইচইয়ে সস্তা জনপ্রিয় হয় ঠিকই কিন্তু তার স্থায়িত্ব থাকে না।


কীভাবে প্রকৃত শিল্পের দুনিয়ায় টিকে থাকতে হয়, মানুষের মনে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিতে হয়, সেটা আলাউদ্দিন আলী হূদয়ঙ্গম করেছিলেন। একই সঙ্গে সে অনুযায়ী পথও চলেছেন। চলচ্চিত্র, বেতার, টেলিভিশন মিলে প্রায় পাঁচ হাজার গান তৈরি করে গেছেন আমাদের সুরকার, গীতিকার সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী। নিজের এসব কাজ মনের মতো করে সম্পন্ন করেছেন। যখন তার মন সায় দিয়েছে, তখনই তিনি তৃপ্ত হয়েছেন। ফলে যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, দুঃখ ভালোবেসে প্রেমের খেলা খেলতে হয়, প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, হয় যদি বদনাম হোক আরও, আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার, সুখে থাকো আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি, সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি আমার বাংলাদেশ, বন্ধু তিনদিন তোর বাড়ি গেলাম দেখা পাইলাম না, যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে মনে হয় দেহে প্রাণ আছে, এমনও তো প্রেম হয় চোখের জলে কথা কয়, কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না, কিংবা হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ; এমন অসংখ্য কালজয়ী গান রেখে যেতে পেরেছেন তিনি।

নশ্বর পৃথিবীতে টিকে থাকা, কোনো শৈল্পিক সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখা কিংবা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মানুষের হূদয়ে বেঁচে থাকা আজকাল বড় দুর্লভ কঠিন। তবু আলাউদ্দিন আলীকে তার গান, সুরের জন্যই কেবল বাংলাদেশীরা নয়, বাংলাভাষী যেকোনো মানুষই তাকে মনে রাখবে। তাকে মনে রাখতেই হবে।

 

ইব্রাহীম খলিল: চলচ্চিত্রকর্মী সহযোগী সম্পাদক, ম্যাজিক লণ্ঠন


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫