এই সময়ে

ঢাকার জলজট নিরসনে সাতটি করণীয়

প্রকাশ: জুলাই ২৭, ২০২০

আকতার মাহমুদ

ভূমিকা: ঢাকার জলজটের কারণ নিয়ে আলোচনার বিশেষ কিছু নেই। প্রতি বছর সময় এত বেশি আলোচনা হয় যে বিষয়গুলো এখন মোটামুটিভাবে চিহ্নিত। কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছি, শহরের জল নিষ্কাশনের সক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। মাত্র ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে ঢাকা শহরের অনেক এলাকা পানির নিচে চলে যেতে দেখা যাচ্ছে। মৌসুমি আবহাওয়ার কারণে প্রতি বছর জুন, জুলাই, আগস্ট সেপ্টেম্বরে প্রতি মাসে গড়ে ১২-১৮ দিন বৃষ্টিপাত হয়। সময় প্রতি মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ গড়ে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি হয়। সুতরাং দেশের উন্নয়ন পরিক্রমায় ধরনের বৃষ্টির পানি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা পরিকল্পনার বাস্তবায়ন থাকা প্রয়োজন। বিশেষত বড় শহরগুলোয় পানি নিষ্কাশনে বিশেষ যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন, যেখানে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতার কারণে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। শহরে ২০০৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর একদিনে বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৩৪১ মিলিমিটার, যা পর্যন্ত সর্বোচ্চ বারিপাত। ওই সময় ঢাকা শহরের দুই-তৃতীয়াংশ পানির নিচে ডুবে গিয়েছিল।

শহরের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা তার নিয়ন্ত্রণ রাজউকের হাতে। রাজউক তার প্রণীত পরিকল্পনা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে পানি নিষ্কাশনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান খাল, নদীনালা, নিম্ন ভূমি দ্রুত উন্নয়নের নামে শহর থেকে বেদখল উধাও হয়ে গেল। ওয়াসা ড্রেনেজ বিষয়ে অনেক সমীক্ষা মহাপরিকল্পনা তৈরি করলেও বাস্তবায়নের তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে পারল না। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, ঢাকা শহরে ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা থাকলেও অনেক বছর ধরে তার প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। প্রতি বছর বর্ষার আগে সিটি করপোরেশন ওয়াসা কিছু খাল বড় ড্রেনের ময়লা পরিষ্কার করে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর দৈনন্দিনের নিয়মিত কাজ। কিন্তু ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের সামান্য কাজও হচ্ছে না। ওয়াসা শুধু পানি সরবরাহের কাজের দায়িত্বে আগ্রহী থাকলেও ড্রেনেজ জল নিষ্কাশনের কাজে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। যদিও ম্যান্ডেট অনুযায়ী সেটিও তাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। ফলে দীর্ঘদিন ধরে শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বড় কোনো অগ্রগতি নেই। আবার জল নিষ্কাশনের কিছু খণ্ডিত দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হাতেও আছে।

অবস্থায় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের সভাকক্ষে একটি আন্তঃবিভাগ সভায় বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে নীতিগত একটি সিদ্ধান্ত হয়এখন থেকে ঢাকা শহরের সমন্বিত ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন, বাস্তবায়ন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ঢাকা সিটি করপোরেশন করবে, যেহেতু তাদের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা আছে। ওয়াসা তার ড্রেনেজের জনবল, অর্থ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে দেবে। একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলেও সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

ঢাকা শহরের জল নিষ্কাশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বর্তমানে ঢাকা শহরে সুপেয় পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন পানি নিষ্কাশনের কাজ ঢাকা ওয়াসা করলেও শুরুতে পানি নিষ্কাশনের কাজটি তাদের কাছে ছিল না। নবাব খাজা আব্দুল গনি ১৮৭৮ সালে ঢাকা শহরের চাদিনাঘাটে একটি পানি শোধনের প্লান্ট পানি সরবরাহের নেটওয়ার্কের কাজ শুরু করেন। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর দেশের নগর গ্রামীণ সব এলাকার জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন জনস্বাস্থ্যের দায়িত্ব দিয়েজনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরচালু করে। এসব কাজের সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের অংশ হিসেবে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক তৈরির দায়িত্বও দেয়া হয় এই সদ্য প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটিকে। মাত্র ১৬ বছর পার হতে না হতেই তত্কালীন সরকার মনে করল, ঢাকা শহরের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ পয়োনিষ্কাশনের জন্য ওয়াসা নামে একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান করা প্রয়োজন। তাই একটি বিশেষায়িতকর্তৃপক্ষহিসেবে ১৯৬৩ সালে ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক তৈরি বর্ষার পানি নিষ্কাশনের কাজ জনস্বাস্থ্য স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাছে রয়ে গেল। তারা তখনকার ঢাকা শহর, নারায়ণগঞ্জ শহর, মিরপুর পৌরসভা গুলশান পৌরসভার শহর এলাকায় টাউন কমিটির সঙ্গে একযোগে কাজটি করে আসছিল। কিন্তু ১৯৮৮ সালে একটি বড় বন্যার পর ঢাকা শহরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ জল নিষ্কাশনের বড় বড় প্রকল্প হতে লাগল, বিদেশী দাতা সংস্থার অর্থ আসতে শুরু হলো। তত্কালীন রাষ্ট্রপ্রধানের ইচ্ছায় পানি নিষ্কাশনের দায়িত্বও জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছ থেকে ওয়াসার কাছে চলে এল। সেই থেকে ঢাকা ওয়াসা সুপেয় পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন পানি নিষ্কাশন তিনটি কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত। এখন প্রশ্ন হতে পারে, তিনটি বিষয়ের মধ্যে কোনটিতে ওয়াসার সাফল্য-ব্যর্থতা কতটুকু? সেই বিষয়ে অন্য সময় লেখা যেতে পারে। 

বিভিন্ন সময়ে প্রণীত বন্যা নিয়ন্ত্রণ জল নিষ্কাশন প্রকল্পগুলো

ঢাকা শহরে জল নিষ্কাশনের জন্য সমীক্ষা পরিকল্পনা নিতান্তই কম হয়নি। নিচে একটি তালিকাও দেয়া হলো:

* ঐতিহাসিকভাবে ঢাকা শহরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ জল নিষ্কাশনের কাজটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দেয়া হয়। ১৯৬৮ সালে সংস্থাটি ঢাকা শহরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ অভ্যন্তরীণ জল নিষ্কাশনের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তত্কালীন ওয়াপদাকে দায়িত্ব দেয়া হয় বাঁধ পাম্পিং স্টেশন নির্মাণের জন্য এবং জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেয়া হয় শহরের আভ্যন্তরীণ জল নিষ্কাশনের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের।

* ১৯৭৮ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর আগের ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের রিভিউ করে।

* একই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ১৯৮০ সালে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে একটিক্রাশ প্রোগ্রামনেয়া হয়। সেই আলোকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ১৯৮৩ ১৯৮৫ সালে নানা ধরনের সমীক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে।   

* প্রায় একই সময় জাইকাসুইজStudz on Storm Water Drainage Szstem Improvement Project in Dhaka Cityনামে আরো একটি সমীক্ষা প্রস্তুত করে।

* ১৯৮৭ ১৯৮৮ সালে দেশব্যাপী বড় দুটি বন্যার পরফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান (এফএপি)’-এর অধীন বন্যা নিয়ন্ত্রণ জল নিষ্কাশনের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যেখানে জাইকা বৃহত্তর ঢাকা, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সাভারসহ মোট ৮৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য গ্রেটার ঢাকা প্রটেকশন প্রজেক্ট (এফএপি ৮বি) এবং ঢাকা শহরের জন্যঢাকা সিটি ইন্টিগ্রেটেড ফ্লাড প্রটেকশন প্রজেক্ট (এফএপি ৮এ) প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়।

* রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ১৯৯৫-২০১৫ সাল মেয়াদিঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (ডিএমডিপি)’ প্রস্তুত করে, যেখানে আগের সমীক্ষা ব্যবহার করা হয় এবং ১২ দশমিক শতাংশ জলাধার রেখে ঢাকার জন্য ড্রেনেজ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। 

* ২০০৬ সালে ওয়াসাStudz on Drainage Master Plan for Dhaka Cityনামে একটি সমীক্ষা প্রকল্প সম্পন্ন করে।

* ২০১৬ সালে ওয়াসাStormwater Drainage Master Plan for Dhaka Cityনামে আরেকটি ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে।

জল নিষ্কাশনে এতগুলো সমীক্ষা মহাপরিকল্পনা থেকে আমাদের প্রাপ্তি কী? একটা পর্যালোচনার দাবি রাখে। পরিকল্পনার কত শতাংশ বাস্তবায়ন করা গেল, না করা গেলে তার সমস্যা কোথায়এসব প্রশ্নের উত্তর জানা না গেলে ভবিষ্যতে পানি নিষ্কাশনে অগ্রগতি হবে না।  

মানচিত্র: ঢাকার খাল নদী ও লেকগুলোর অবস্থান


ঢাকার পানি নিষ্কাশন পদ্ধতি

পানি নিষ্কাশন বিবেচনায় ঢাকাকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। ঢাকা শহরের উত্তরে আবদুল্লাহপুর থেকে এয়ারপোর্ট রোড, প্রগতি সরণি হয়ে ডেমরা পর্যন্ত প্রধান সড়কটির একপাশে ঢাকা পশ্চিমাংশ (১৪৩ বর্গ কিমি), অন্যপাশে ঢাকা পূর্বাংশ (১১৮ বর্গ কিমি) এবং ডিএনডি (৫৭ বর্গ কিমি) এলাকা। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালে বন্যার পর বুড়িগঙ্গা তুরাগের পাশে বাঁধ দিয়ে ঘের দেয়ার মাধ্যমে নদীর স্ফীতজনিত বন্যার পানি, ঢাকার পশ্চিমাংশকে বহিঃস্থ বন্যা থেকে মুক্ত করা হয়। অন্যান্য সময় বৃষ্টির পানি প্রাকৃতিক প্রবাহের নিয়মেই খাল থেকে নদীতে চলে গেলেও নদীতে পানির উচ্চতা বেশি হলে ঢাকা পশ্চিমাংশের পানি ধোলাই খাল, কল্যাণপুর গোরানচাঁদ বাড়িতে অবস্থিত পাম্পের সাহায্যে তুরাগ বুড়িগঙ্গায় পাম্প করে ফেলে দেয়া হয়। এই অংশের প্রধান প্রধান খাল হলো: দিগুন খাল, দিয়াবাড়ি খাল, আব্দুল্লাহপুর খাল, বাউনিয়া খাল, কল্যাণপুর খাল তার শাখা খাল, হাজারীবাগ খাল, ধোলাই খাল ইত্যাদি।

ঢাকা পূর্বাংশের প্রধান খালগুলো হলো: গোবিন্দপুর খাল, বাওথার খাল, বোয়ালিয়া খাল, ডুমিনি খাল, সুতিভোলা খাল, শাহজাদপুর খাল, বেগুনবাড়ি খাল, মেরাদিয়া খাল, জিরানি খাল, মান্ডা খাল, নড়াইল খাল এবং তাদের শাখা-প্রশাখা। এই অংশের পানি প্রাকৃতিক প্রবাহে এসব খালের মাধ্যমে বালু নদে গিয়ে পড়ে।

আর ডিএনডি এলাকার উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা অবহেলার কারণে ১১টি খাল বেদখল হয়েছে এবং এই এলাকায় জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। এই এলাকা থেকে পানি শীতলক্ষ্যা নদীতে পড়ে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে সাতটি অগ্রাধিকার কাজ

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সাতটি অত্যাবশ্যকীয় কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা দরকার। নিম্নে তা আলোকপাত করা হলো:

. পানিপ্রবাহের পথ নিরবচ্ছিন্ন নির্বিঘ্ন রাখা

বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি প্রথমে বাড়িঘর রাস্তার পাশের ছোট ড্রেন থেকে বড় ড্রেন, সেখান থেকে প্রাকৃতিক খাল হয়ে আশপাশের লেক, জলাশয় কিংবা ঢাকা শহরের চারপাশের নিম্নাঞ্চল এলাকায় সাময়িকভাবে অবস্থান করে। অবশেষে সেখান থেকে নদীতে চলে যায়। কিন্তু বর্ষায় নদীর পানির উচ্চতা যখন বেশি থাকে, তখন এই পানি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নদীতে যেতে পারে না। তখন পাম্প করার প্রয়োজন হয়। শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রথম শর্ত হলো, রাস্তার পাশের ড্রেন থেকে শুরু করে একেবারে নদী পর্যন্ত পুরো পথ প্রয়োজনমতো প্রশস্ত গভীর হতে হবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, পানির পথ নিরবচ্ছিন্নভাবে নির্বিঘ্ন হতে হবে।

পানি চলাচল নিয়ন্ত্রণে যেখানে স্লুইস গেট আছে, তার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, সময়মতো খোলা বন্ধ করা। যেসব  স্থানে পাম্প স্টেশন আছে, সেখানে জলাধার সৃষ্টি করা এবং উপযুক্ত সময়ে সঠিক সক্ষমতায় পাম্প চালানো।

খাল পুনরুদ্ধার সংরক্ষণের লক্ষ্যে ঢাকা শহরের সিএস/আরএস/এসএ ম্যাপ অনুযায়ী সব খালের সীমানা চিহ্নিত করা এবং সব দখলকারীকে উচ্ছেদ করে খালের দুই পাড় বাঁধাই করতে হবে এবং দুপাশে হাঁটার মতো রাস্তা করে দিতে হবে। খালকে মানুষের নিয়মিত চোখের সামনে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে পরবর্তী সময়ে আবার নতুন করে খাল দখল হওয়ার সুযোগ তৈরি না হয়। কাজটি টেকসই করার লক্ষ্যে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।   

. বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নতি করতে হবে

ঢাকা শহরে দৈনিক মোট উৎপাদিত বর্জ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ ঢাকা সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করে তাদের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতে পারে। বাকি প্রায় হাজার ৫০০ টন বর্জ্য প্রতিদিন জমা হয় ড্রেন, খাল, বিল, নিচু এলাকা নদীতে। ফলে পানির গতিপথ বন্ধ হয়ে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয় এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। উত্তর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তাদের বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে শুধু একটি পরিষ্কার ঢাকা শহরই পাব না, এটি শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সেই সঙ্গে জনগণকে দায়িত্বশীল সুনাগরিকের আচরণ করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়ম মেনে চলতে হবে। প্লাস্টিক ব্যাগের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং যত্রতত্র ফেলার কারণে ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যায়। প্লাস্টিক ব্যাগের উৎপাদন, বাজারজাত, সংরক্ষণ ব্যবহার বন্ধে সরকারি সিদ্ধান্তের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।

. উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খালের ব্যবহার  

ঢাকার যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা বেশি দেখা যায়, লক্ষ করলে দেখা যাবে সেসব এলাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা শহরে আশির দশকে নির্মিত কিছু বক্স কালভার্টের সঙ্গে সংযুক্ত। ধোলাই খাল, সেগুন বাগিচা খাল এবং পান্থপথের ওপর নির্মিত বক্স কালভার্টের ভেতরে পরিষ্কারের অভাবে ময়লা জমে শক্ত হয়ে গেছে। এদের পানি নিষ্কাশনের সক্ষমতা ৮০ শতাংশ কমে গেছে। একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে এসব বক্স কালভার্ট ভেঙে ফেলতে হবে। পুরনো ভুলকে স্বীকার করে নিয়ে এসব খাল উন্মুক্ত করে দিতে হবে। খালগুলো জনগণের চোখের সামনে থাকলে তা রক্ষণাবেক্ষণে সুবিধাজনক হবে। এসব খাল পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে কাঁঠালবাগান, রাজাবাজার, কলাবাগান, মগবাজার, শান্তিনগর, সেগুনবাগিচা, পুরান ঢাকার জলাবদ্ধতার উন্নতি ঘটবে। তাছাড়া শহরের সব খালকে ভবনের পেছনে রেখে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং খালকে উন্মুক্ত রেখে ভবন তৈরি ব্যবহার করতে হবে, যাতে খালগুলো কেউ অপব্যবহার করতে না পারে। 

. ওয়াটার রিটেনশন পন্ড (জলাধার) তৈরি  

ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান, ঢাকা মহানগরী উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) স্ট্রাকচার প্ল্যান ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুযায়ী চিহ্নিত ওয়াটার রিটেনশন পন্ড (জলাধার) হাজার ৫৪২ একর জমি এখনই অধিগ্রহণ করে বৃষ্টির পানি ধারণের জন্য জলাধার সৃষ্টি করতে হবে। বালু নদের তীর ধরে গোবিন্দপুর খাল বাউথার খালের সংযোগস্থলে একটি (৬২০ একর),  ডুমিনী খালের শেষ প্রান্তে একটি (৯৪৯ একর), নড়াইল খালের শেষ প্রান্তে একটি (১১০৮ একর), তুরাগ নদের তীর ধরে গোরান চাটবাড়িতে একটি (৬৩২ একর) এবং কল্যাণপুর খালের শেষ প্রান্তে একটি (২৩৩ একর) মোট পাঁচটি জলাধারের বাস্তবায়ন ঢাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণে অত্যন্ত জরুরি। যেভাবে নিচু এলাকা ভরাট করে নগরায়ণ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে, তাতে এসব এলাকায় চিহ্নিত ওয়াটার রিটেনশন এলাকা ভরাট হয়ে যাবে। পরে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আর জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে ভবিষ্যতে শহর স্থায়ী জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে যাবে।

. বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা

বৃষ্টির সময় প্রাকৃতিক পরিবেশে পানি কিছু সময় দাঁড়ানোর সুযোগ পায়, আবার অনেক পানি মাটির ভেতর দিয়ে ভূগর্ভস্থ একোয়ফারে চলে যায়। কিন্তু ঢাকা শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ উপরিভাগ এখন কংক্রিটের শক্ত আবরণে ঢেকে গেছে। কংক্রিটে পানির রান-অফ বেশি হওয়ায় বৃষ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পানি রাস্তার ওপর চলে আসে। শহরের ব্যক্তিগত প্রাতিষ্ঠানিক সব ইমারতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে মোট বৃষ্টির পানির বড় একটা অংশ সরাসরি রাস্তায় আসবে না। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের নির্দেশনাবাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডেদেয়া আছে। তাছাড়া রাজউকের ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হবে। আইনের প্রয়োগ পরিকপ্লনার বাস্তবায়ন জরুরি। 

. পরিকল্পনার বাস্তবায়ন আইনের প্রয়োগ   

ঢাকা শহরের দ্রুত নগরায়ণ সেই সঙ্গে নিম্নাঞ্চল ভরাট হয়ে যাওয়ার বাস্তবতাকে অনুধাবন করে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা মহানগরী মহাপরিকল্পনায় চিহ্নিত সব খাল, লেক-জলাশয় রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে অতি দ্রুত এগুলো রক্ষা করা না গেলে ঢাকা শহরের অস্তিত্ব রক্ষা করা যাবে না।  ‘জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০’-এর নং ধারা অনুযায়ী ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) চিহ্নিত এসব খাল, লেক-জলাশয়ের কোনোভাবে শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না, এমনকি অন্য কোনো কাজে ব্যবহারও করা যাবে না। এছাড়া পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেপরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ধারা নং অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে এসব গুরুত্বপূর্ণ জলাশয়ের হারিয়ে যাওয়া রোধে  প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকাঘোষণা করে রক্ষা করা যেতে পারে। সব ধরনের আইনি সহায়তা থাকা সত্ত্বেও শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা উদ্যোগের অভাবে ঢাকা শহরের খাল, নদী, পুকুর, লেক জলাধার রক্ষা করা যাচ্ছে না।

ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের প্রস্তাবনাগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে হবে। নব্বইয়ের দশক থেকে অনেক ড্রেনেজ সমীক্ষা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হলেও বাস্তবায়নের কাজটা যৎসামান্য।

. নগর সরকার/সমন্বিত কমিটি প্রবর্তন

জলাবদ্ধতা দূর করতে হারিয়ে যাওয়া খাল পুনরুদ্ধার, সচলতা ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। শহরের ভূ-উপরস্থ ড্রেন, ভূগর্ভস্থ স্টর্ম ওয়াটার ড্রেন খালগুলোর মালিকানা বিভিন্ন সংস্থার অধীনে ন্যস্ত আছে। সিটি করপোরেশনের ভেতরের সব খালের উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা মেয়র অফিসের অধীনে হওয়া উচিত। বর্তমানে এসব খাল ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত জনবল, অর্থ যন্ত্রপাতি সেই অনুযায়ী মেয়রের অধীনে স্থানান্তর করা যেতে পারে।

শহরের যেসব স্থানে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির বড় প্রকল্প চলমান, সেসব প্রকল্পের কারণে ড্রেনেজ ব্যবস্থা যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সিটি করপোরেশনকে নিয়মিতভাবে অবগত করবেন। মেয়রদেরপ্রধান সমন্বয়কভূমিকায় রেখে ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন পেশাজীবী সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠন করা প্রয়োজন। নগর সরকার প্রবর্তন করা গেলে কাজটি আরো সহজ হয়ে যায়।

অবশেষে একথা বলা যায় যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা সুশাসন ছাড়া ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব নয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে মহানগরের ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের প্রস্তাবনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। যথাসময়ে প্রকল্পগুলো না নিতে পারলে পরবর্তী সময়ে সমাধান করতে গেলে অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে যায়। ঢাকা শহরের বসবাসযোগ্যতা আজকে হুমকির সম্মুখীন। তাই জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসন ব্যতীত আমাদের প্রিয় শহরের বাসযোগ্যতায় উন্নতি করা যাবে না।

   

আকতার মাহমুদ: অধ্যাপক, নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)

 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫