কভিড-১৯ নেগেটিভের ভুয়া সনদ

বহির্বিশ্বে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছেন বাংলাদেশীরা

প্রকাশ: জুলাই ০৯, ২০২০

নিজস্ব প্রতিবেদক

কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ নিয়ে সম্প্রতি ইতালিতে যাওয়া বাংলাদেশীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। ঘটনায় বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের ফ্লাইট এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে ইতালি সরকার। এমনকি গতকাল ঢাকা থেকে রোমে যাওয়া ১২৫ বাংলাদেশীকে বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। অবস্থায় বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে নেয়া কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে বহির্বিশ্বে।

সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো বিমান চলাচল খুলে দিলেও বাংলাদেশের জন্য তা এখনো বন্ধ রয়েছে। করোনা সংক্রমণ নিয়ে ইউরোপে ফেরা যাত্রীদের কারণে সে পথ আরো রুদ্ধ হয়ে গেল।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি বিশেষ ফ্লাইটে সোমবার ঢাকা থেকে রোমে যাওয়া ২১ যাত্রী কভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হন। এর আগেও কভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হন আরেক বিশেষ ফ্লাইটের ১৮ যাত্রী। এসব যাত্রীর সবাই বাংলাদেশ থেকে কভিড-১৯-এর নেগেটিভ সনদ নিয়ে গিয়েছিলেন। আর ঘটনায় বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের ফ্লাইট এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে ইতালি সরকার।

সর্বশেষ গতকাল ঢাকা থেকে রোমে যাওয়া ১২৫ বাংলাদেশীকে পুনরায় দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে ইতালি সরকার। এমনকি কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে যাওয়া ওই বাংলাদেশীদের উড়োজাহাজ থেকে রোম বিমানবন্দরেই নামতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। এমনকি কাতার এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজটিকেও ১৬ দিনের জন্য গ্রাউন্ডেড রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অবস্থায় বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে নেয়া কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে বহির্বিশ্বে।

বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতও। এতদিন কভিড-১৯ নেগেটিভের সনদ ছাড়াই এমিরেটস এয়ারলাইনসে ভ্রমণ করতে পারছিলেন বাংলাদেশীরা। তবে আগামীকাল থেকে এমিরেটস এয়ারলাইনসে ভ্রমণ করা প্রত্যেক বাংলাদেশী যাত্রীকেই সঙ্গে রাখতে হবে কভিড-১৯ নেগেটিভের সনদ। আর সনদ নিতে হবে সরকার স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকেই।

মঙ্গলবার এমিরেটস এয়ারলাইনস থেকে -সংক্রান্ত একটি সার্কুলার বাংলাদেশে অবস্থিত এমিরেটস অফিস, ট্রাভেল এজেন্টদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ ছাড়া কোনো যাত্রীকে ফ্লাইটে ওঠানো যাবে না। ওই যাত্রী সুস্থ থাকলেও সনদ লাগবে। আর করোনা নেগেটিভ সনদ অবশ্যই ভ্রমণের ৭২ ঘণ্টা আগের হতে হবে। এর বেশি আগের সনদ গ্রহণযোগ্য হবে না। এছাড়া কভিড-১৯ নেগেটিভ সনদ অবশ্য সরকার স্বীকৃত কোনো ইনস্টিটিউট বা প্রতিষ্ঠান কিংবা হাসপাতাল থেকে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণ কোনো হাসপাতালের সনদ গ্রহণযোগ্য হবে না। সনদে অবশ্যই পাসপোর্ট অনুযায়ী পুরো নাম, পিতার নাম থাকতে হবে, পাসপোর্ট নম্বর জন্ম তারিখ থাকতে হবে। ২০ জুলাই পর্যন্ত নির্দেশনা কার্যকর থাকবে।

ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলছে, কভিড-১৯ নেগেটিভে বিভিন্ন হাসপাতাল যে সনদ দিচ্ছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। একই সঙ্গে বাংলাদেশের দেয়া করোনা নেগেটিভ সনদ বহির্বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। বাংলাদেশের নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার মান যদি ভালো না হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ বিপাকে পড়তে পারে।

ইতালির জনপ্রিয় গণমাধ্যম ইল ম্যাসাগারো তাদের স্থানীয় ভাষায় শিরোনাম করেছে, ডাল বাংলাদেশ কন টেস্ট ফলসি, যার অর্থ বাংলাদেশ নভেল করোনাভাইরাসের যে সনদ দিচ্ছে সেটি মিথ্যা।

এর আগে ইতালির আরেকটি গণমাধ্যম রোমা টুডে এক খবরে জানায়, তারা বিমানবন্দরে একটি ভাইরাল বোমা নিষ্ক্রিয় করেছে। বাংলাদেশ থেকে করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়ে যাওয়া এসব যাত্রীকে ভাইরাল বোমা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে সংবাদপত্রটি।

ইতালিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে এক সপ্তাহের জন্য সব ধরনের ফ্লাইট স্থগিত করে ইতালি সরকার।

তবে বাংলাদেশের করোনা নেগেটিভের ভুয়া সনদ যে শুধু ইতালিতে ধরা পড়েছে এমন নয়। এর আগে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এমনকি চীনও বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্লাইট স্থগিত করেছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে গমন করা বাংলাদেশীরা করোনা নেগেটিভ সনদ নিয়ে গেলেও সেখানে পৌঁছানোর পর তাদের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে।

এপ্রিলে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জাপান ফেরাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ ভাড়া করে তিন-চারটি চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। ওইসব ফ্লাইটে যাওয়া যাত্রীদের বাংলাদেশে পরীক্ষা চালিয়ে করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু জাপান যাওয়ার পর পরীক্ষা করলে তাদের মধ্যে চারজনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে মে মাসের প্রথমদিকে শর্ত আরোপ করে দেশটি। কারণে বাংলাদেশী কোনো নাগরিক এখন জাপানে যেতে পারছেন না।

একই ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়াগামী চার্টার্ড ফ্লাইটের আরোহী যাত্রীদের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশে পরীক্ষা চালিয়ে এসব যাত্রীর সংক্রমণ শনাক্ত না হলেও দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়া অন্তত ছয়জন বাংলাদেশী এবং একজন কোরীয় নাগরিকের শরীরে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ জুন দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আগত মানুষের মাধ্যমে নতুন করে সেদেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অনেক বেড়ে যাওয়ায় দুই দেশের নাগরিকদের কোরিয়ার ভিসা এবং প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে, যা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করেছে দেশটি। তবে কূটনৈতিক জরুরি ব্যবসায়িক কাজের ক্ষেত্রে অবশ্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে।

এদিকে গত ১১ জুন ঢাকা থেকে চীনের গুয়াংঝু শহরে যাওয়া চায়না সাউদার্নের একটি ফ্লাইটের ১৭ জন যাত্রীর নমুনা পরীক্ষায় নভেল করোনাভাইরাস পজিটিভ শনাক্ত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে চায়না সাউদার্নের ঢাকার ফ্লাইট চার সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছে চীনের বেসামরিক বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। নিষেধাজ্ঞার ফলে গত ২২ জুন থেকে চার সপ্তাহ চীনের উড়োজাহাজ সংস্থা ঢাকায় ফ্লাইট চালাতে পারছে না।

এদিকে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনা নেগেটিভের ভুয়া সনদ দিতে তত্পর হয় রাজধানীসহ সারা দেশের হাসপাতালগুলো। এরই মধ্যে একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরীক্ষা না করেই ভুয়া সনদ দেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতাল করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ দিয়েছে বলে সম্প্রতি প্রমাণ পেয়েছে র্যাব। উত্তরা মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে কমপক্ষে আটজনকে আটক করে র্যাবের মোবাইল কোর্ট। পরীক্ষা না করেই কভিড-১৯-এর সনদ দেয়ায় হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

রিজেন্ট হাসপাতাল করোনা রোগীদের ভুয়া সনদ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এসব যাত্রীর মধ্যে যারা বিদেশে নিজ কর্মস্থলে ফিরেছেন তারাও ভুক্তভোগী হয়েছেন। করোনার ভুয়া সনদের ব্যবসা করে এমন জালিয়াতি চক্রকে আটক করে র্যাব। সে সময় র্যাব জানিয়েছিল, করোনার নেগেটিভ সনদ নিতে সবচেয়ে বেশি তত্পর ছিলেন বিদেশ গমনেচ্ছুরা, যারা ভুয়া সনদ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫