পর্যালোচনা

স্থাপত্য, জীবনযাপন ও আমাদের অর্থনীতি

প্রকাশ: জুলাই ০৩, ২০২০

সজল চৌধুরী

করোনা মহামারীর সময়ে মানুষের জীবনযাত্রা জীবনবোধের পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিশেষ করে জীবনযাপনের খরচের বিবেচনায়। সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে অনেক বেশি সঞ্চয়ী হতে শিখেছে। বর্তমান সময়ে অপচয় আগের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে কমে এসেছে। দি ইকোনমিকসের (১১ জুন) তথ্যমতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর হিসাব অনুযায়ী গত কয়েক মাসে সাধারণের আয়ের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সঞ্চিত হয়েছে -যাবত্কালের মধ্যে। এমন পরিস্থিতি ব্রিটেন, জাপানসহ ইউরোপের বেশির ভাগ দেশেই হয়েছে। খাবার দোকানসহ মার্কেটগুলো বন্ধ থাকায় জ্বালানির ব্যবহার, গাড়ি ব্যবহার কমে যাওয়া, বাড়িভাড়া কমে যাওয়া এবং খাদ্যের অপচয় কমে যাওয়া এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এই মহামারী পরিবারগুলোকে নিজেদের অদূর ভবিষ্যতের জন্য নগদ সংরক্ষণে অনুপ্রাণিত করছে। কিন্তু সঙ্গে এটিও ধারণা করা হয়েছে, এই নতুন জীবনধারা হয়তো খুব বেশিদিন টিকবে না! আর ধারণা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য যে কতখানি সঠিক, তা বর্তমান অবস্থায় খুব বেশি বলার প্রয়োজন পড়ে না। অন্যদিকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্যানুযায়ী লকডাউনে পরিবারগুলোর বাসস্থানের বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ অনেকাংশে বেড়ে গেছে বর্তমান সময়ে। গবেষণাটি ২০১৮ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চলতি, যা নিউইয়র্কের ৪০০ অ্যাপার্টমেন্টের ওপর করা হচ্ছে। তারা দেখিয়েছেন প্রায় ২৩ শতাংশ বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ বেড়ে গেছে অন্য সময়ের চেয়ে। যদিও অন্যান্য সেক্টর যেমন অফিস-কারখানা বন্ধ থাকায় সেখানে বিদ্যুতের ব্যবহার কমেছে বিশাল পরিমাণে।

লক্ষণীয় বিষয়, দিনের বেলায় সাধারণত ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে থাকে, অন্যরা অফিস কিংবা বাইরে থাকে। এখন যেহেতু তাদের বাড়িতে থেকেই সব কাজ করতে হচ্ছে, সেহেতু বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়িগুলোয় অনেকাংশে বেড়ে  গেছে; যার খরচ আগে অফিস কিংবা কারখানাগুলো বহন করত। এখন সেই খরচ ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে এসেছে, যা তাদের মানসিক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত শ্রেণীর পরিবারগুলোর মধ্যে সমস্যা অত্যন্ত প্রকট আমাদের শহরগুলোয়। গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোর জন্য ব্যয়ভার অনেক চাপে ফেলবে সাধারণ নাগরিকদের বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ বাড়িতে থাকার কারণে সবসময় তাদের বাসস্থানের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ধরনের তাপ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হচ্ছে। যদিও এই মহামারীতে এসি ব্যবহার না করার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, যা তাদের মাসিক খরচ অনেকাংশে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এবার আসা যাক শুধু আমাদের ঢাকা শহরের কথায়। যেখানে জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসে। যাদের মাসিক আয় পরিবারগুলোয় ১০ থেকে ২৫ হাজারের মধ্যে। আর শহরের বর্তমান হিসাব অনুযায়ী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, যারা দেশের অর্থায়নে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন বিভিন্ন কলকারখানা, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে। যাদের বলা হয় অর্থনীতির চালিকাশক্তি। যাদের আয়ের প্রায় ৩০ থেকে থেকে ৩৫ শতাংশ চলে যায় বাড়িভাড়ায়। এমনকি ঢাকা শহরের অনেক এলাকাতেই বাড়িভাড়তেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি পরিবারের আয়ের প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশই ব্যয়িত হয় সাকল্যে। অবস্থায় দিনের পর দিন ধরে তারা জীবনযাত্রার বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের সংকুচিত করে জীবন ধারণ করে। খরচ বাঁচায় তাদের পোশাক, খাবার, চলাফেরা, যানবাহন, চিত্তবিনোদনসহ অন্যান্য অতিপ্রয়োজনীয় খাত থেকে সংকোচনের মাধ্যমে, নিজেদের পরিবর্তনের মাধ্যমেব্র্যাকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় এটি উঠে এসেছে। এভাবে চলতে চলতে মাস শেষে তাদের হাতে সঞ্চয় করার মতো খুব বেশি কিছু থাকে না, যা দিয়ে তারা ভবিষ্যতের কথা ভাববে! অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের প্রয়োজনে ভালো চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। কথাগুলো কারণেই বলা হচ্ছে, এই মহামারী একদিকে যেমন আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব। অল্প নিয়েও কীভাবে জীবনধারণ করা যায়, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বর্তমান সময়ে। কারণ সম্পদের অপ্রাচুর্য আমাদের রয়েছে। তাই এই স্বল্প সম্পদ কীভাবে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে সবচেয়ে বেশি উপকারিতা পাওয়া যায়, সে বিষয়টি ভাবা এখন অত্যন্ত জরুরি।

অবস্থায় আমাদের ভাবতে হবে মানুষগুলোর বাসস্থানের কথা। বিশেষ করে বাসস্থানের শক্তি নিরাপত্তা জ্বালানি ব্যবহারের কথা। বাসস্থানগুলোকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেন সেখানে শক্তির অপচয় কম হয়। আবাসন খাতগুলোকে বর্তমান পরিস্থিতি-নির্দেশনায় নতুন করে ভাবতে হবে। যেসব স্থাপনা নতুন করে তৈরি করা হবে, সেগুলোকে একটি নির্দিষ্ট রেটিং সিস্টেমের আওতায় আনা যেতে পারে। একেকটি স্থাপনাভেদে রেটিং সিস্টেম ভিন্নতর হতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো আরো সুনির্দিষ্টভাবে আবাসন শিল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের চিন্তা এবং পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। নইলে একদিকে যেমন আবাসন শিল্প সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে বসবাসের ব্যয়ভার অর্থনৈতিকভাবে আমাদের আরো মুমূর্ষু করে তুলবে। তাছাড়া বর্তমানে ব্যবহূত বাসস্থানের কথা ভাবতে হবে। সেখানে কীভাবে এনার্জি রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে শক্তির অপচয় কমানো সম্ভব, তার পরিকল্পনা করতে হবে। এমনকি স্থাপনা নির্মাণে ফ্যাব্রিকেশন বিষয়টিকে আরো সামনের দিকে আনা যেতে পারে। যাতে প্রতিটি স্থাপনার পরবর্তী উপকরণ মূল্য বজায় থাকে। আর এটি করতে সক্ষম হলে একদিকে যেমন আমাদের অর্থনীতি আরো বেশি শক্তিশালী হবে, অন্যদিকে তেমনি শহরের সাধারণ নাগরিকের ওপর থেকে ব্যয়ভারের বোঝা কিছুটা হলেও কমবে।

 

সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত

[email protected]  


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫