কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাতিঘর

প্রকাশ: জুলাই ০২, ২০২০

ফজলে কবির

সর্বজন শ্রদ্ধেয় আল্লাহ মালিক কাজেমী আজ আমাদের মাঝে নেই বাস্তব সত্যটি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। ২০১২ সালে অর্থ সচিব হিসেবে যোগদানের পর থেকে তার মৃত্যু অবধি আর্থিক খাত কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং বিষয়ে আমি তার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পরামর্শ পেয়েছি। তার পরামর্শ ছাড়া মুদ্রানীতি প্রণয়ন বাস্তবায়ন, বৈদেশিক মুদ্রা বিষয়ক নীতি, বিনিময় হার নীতি, ঋণ নীতি, তারল্য ব্যবস্থাপনাসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি সবসময় এসব নীতি প্রণয়ন বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ব্যাংকিং সংক্রান্ত অনেক বিধি-বিধান, নিয়ম-কানুন সংস্কার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেন। অর্থনীতির বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণপূর্বক বাজেটের পরিপূরক মুদ্রানীতি প্রণয়নে তার অন্তঃগভীর জ্ঞান ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। তাই আমি পেশাগতভাবে তার কাছে অনেক ঋণী। তার আকস্মিক মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হলো।

আমার মতে, মরহুম কাজেমী ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাতিঘর। ছিলেন দেশের আর্থিক ব্যাংকিং খাতের একজন কিংবদন্তি। তিনি শুধু একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক দক্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকারই ছিলেন না, ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাত বিষয়ে অসামান্য প্রজ্ঞাবান। তিনি বহুমাত্রিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা মুদ্রানীতি বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল অপরিসীম। অর্থনীতি, ব্যাংকিংয়ের বাইরে তিনি দর্শন, সাহিত্য বিষয়েও প্রচুর লেখাপড়া করতেন। জ্ঞান আহরণে তিনি কখনো ক্লান্তি বোধ করতেন না।

২০১৬ সালের ২০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগদানের পর থেকেই দেখেছি, তার ওপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যেমন দৃঢ় আস্থা ছিল, ঠিক তেমনি অধস্তনদের কাছে তিনি ছিলেন শিক্ষকের মতো। আর্থিক খাতের যেকোনো জটিল বিষয়ে তার কাছ থেকে সহজ সমাধান পাওয়া যেত। বাংলাদেশ ব্যাংকের আধুনিকায়নে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই অর্থায়ন কৌশল প্রণয়নেও ছিল তার একচ্ছত্র ভূমিকা। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এএফআইসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে আলোচনাকালে আমি সবসময় তাকে পাশে রাখতাম। এসব আলোচনাতে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিতেন। ১৯৭৬ সাল থেকে পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৪ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খুঁটিনাটি যাবতীয় বিষয়ে যার অগাধ জ্ঞান তার ওপর ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে তার প্রয়োজন ছিল বলেই তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এমনকি মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছেন। ব্যক্তিগতভাবে প্রচারবিমুখ কাজেমী ছিলেন বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্রীয় ব্যাংকার। তার পরামর্শ সহযোগিতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আমার পথচলা অনেক সহজ হয়েছে।

জনাব কাজেমী কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যবান সম্পদ ছিলেন। ব্যাংকিং খাতের যেকোনো সমস্যা, নতুন নীতি প্রণয়নে তিনি পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবসায়ীরাও তার কাছে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ নিতেন। তিনি নিয়ম-কানুন ঠিক রেখে ব্যবসায়ীবান্ধব নীতি প্রণয়নে পরামর্শ দিতেন। তার এই অসময়ে চলে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা ব্যাংকিং খাতে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তবে আমি মনে করি, কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। তিনি তার কাজের মাধ্যমে আমাদের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন। তিনি সবার জন্য পেশাদারিত্বের অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।

 

ফজলে কবির: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫