কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ৪৪ বছর সফরের সমাপ্তি

প্রকাশ: জুলাই ০২, ২০২০

১৯৪৯ সালের ৩১ মে। মা সামসুন্নেসা বেগমের কোল আলো করে ভূমিষ্ঠ হলো একটি শিশু। স্থান কুমিল্লার তৎকালীন কোতোয়ালি থানার ছোটরা গ্রাম। অন্য দশটি শিশুর মতো হূষ্টপুষ্ট নয়, বরং অপেক্ষাকৃত কম ওজনের। শিশুকে নিয়ে স্বজনদের উদ্বেগের শেষ নেই। পিতা আজাদ গোলাম মোস্তাফা তার দ্বিতীয় সন্তানের নাম রাখলেন আল্লাহ মালিক। কি অদ্ভুত এক নাম। তার চেয়েও অদ্ভুত নাম ছিল প্রথম সন্তানের। আল্লাহ মালিকের বড় ভাইয়ের নাম আল্লাহ হাফিজ!

জন্মের পর পরই সন্তানদের সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে উৎসর্গ করে দেয়ার উপলক্ষেই নামকরণ। পিতা ছিলেন আবহমান বাংলার পীর-মুর্শিদি তরিকার অনুসারী। চাকরি করতেন সরকারের ভূমি জরিপ বিভাগে। সেই সূত্রে ছোটকাল থেকেই ঢাকায় বড় হয়েছেন আল্লাহ মালিক।

কাজেমী শব্দটি যুক্ত হয়েছে দাদার নাম থেকে। তার দাদার নাম ছিল কাজেম আলী নাজির। এই কাজেম আলী থেকেই সব নাতিদের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কাজেমী। চাচা, ফুপু, ভাই-বোন মিলিয়ে বিস্তৃত এক পরিবার ছিল কাজেমীদের।

১৯৬৫ সালে ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণী পেয়ে মাধ্যমিক শেষ করলেন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৬৭ সালে প্রথম শ্রেণী পেলেন উচ্চ মাধ্যমিকে। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরিচালিত শহীদ সোহরাওয়ার্দী মহাবিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে স্নাতকে প্রথম শ্রেণীতে পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হন। ১৯৭৩ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন।

পদার্থবিজ্ঞানে গোল্ড মেডেলিস্ট কাজেমী চাকরি নিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। ১৯৭৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রথম শ্রেণীর অফিসার পদে যোগ দেন। সেদিন থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তার ৪৪ বছরের কর্মজীবন শুরু।

ধারাবাহিক পদোন্নতি পেয়ে ১৯৮৫ সালে যুগ্ম পরিচালক, ১৯৮৯ সালে উপমহাব্যবস্থাপক, ১৯৯৩ সালে মহাব্যবস্থাপক ১৯৯৯ সালে নির্বাহী পরিচালক হন। তারপর ২০০২ সালে পদোন্নতি পেলেন ডেপুটি গভর্নর পদে। পদে কাজ করেছেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। ২০০৮ থেকে দুই মেয়াদে ২০১২ সাল পর্যন্ত সিনিয়র কনসালট্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। ২০১২ সালের এপ্রিল যোগ দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইজার পদে। পদে তার মেয়াদ বাড়ানো হয় আটবার। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তার চাকরি শুরু হয়েছিল প্রশাসন বিভাগে। এরপর ব্যাংকিং কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট, সিলেট অফিস; বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ বিভাগ, রাজশাহী অফিস; রংপুর অফিসেও দায়িত্ব পালন করেন। মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ বিভাগে। নির্বাহী পরিচালক হিসেবে তিনি ব্যাংকিং প্রবিধি নীতি বিভাগ, এমএমটিইউ (বর্তমানে মানিটারি পলিসি ডিপার্টমেন্ট), আন্তর্জাতিক বিভাগ (বর্তমানে ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট), বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগ, বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগ, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নিরীক্ষা পরিদর্শন বিভাগ, ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ- ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-, আইন বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের দেখভাল করেন। তারপর দায়িত্ব পালন করেন ডেপুটি গভর্নর হিসেবে। কেন্দ্রীয় এমন কম বিভাগই ছিল, যেখানে আল্লাহ মালিক কাজেমীর ছায়া পড়েনি।

১৯৪৯ সালের ৩১ মে যে শিশুটির সফর শুরু হয়েছিল, তার পরিসমাপ্তি ঘটল গত ২৬ জুন শুক্রবার বিকাল ৫টা মিনিটে। মহান মানুষটি করোনাভাইরাসের কাছে হার মেনে পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছেন। রেখে গেছেন স্ত্রী কামরুন নেসা, দুই কন্যা সামিরা বিনতে কাজেমী সামিয়া বিনতে কাজেমী এবং পুত্র কাসিফ আহনাফ বিন কাজেমীকে।

আল্লাহ মালিক কাজেমী সারা জীবনই শারীরিক উচ্চতা ওজনে অন্যদের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু মেধা, মনন, পেশাদারিত্ব সততায় ছিলেন সবার ঊর্ধ্বে। নামটি যেমন ছিল তার অদ্ভুত, কর্মেও তিনি ছিলেন সবার চেয়ে ব্যতিক্রম। তার সঙ্গে কাজ করা জীবিত পাঁচ গভর্নরসহ সহকর্মীরা বলছেন, কাজেমীর তুলনা তিনি নিজেই। কোনোদিন কোনো পদ পদবির জন্য কারো কাছে তদবির করেননি। এজন্য একজন কাজেমীর যোগ্যতার সবটুকুও হয়তো পরস্ফুিটিত হতে পারেনি। ৭১ বছর জীবনের ৪৪ বছরই তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দিয়ে গেছেন। তার দেখানো পথে এগিয়ে চলুক বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫