স্যারের যতটুকু স্নেহ পেয়েছি তা লেখালেখির জন্য

প্রকাশ: জুলাই ০২, ২০২০

মাশরুর আরেফিন

কাজেমী স্যারের আমি যে অনেক ঘনিষ্ঠ কেউ ছিলাম, তা নয়। তবু এই ইন্ডাস্ট্রিতে যেহেতু ২৫ বছর হয়ে গেছে, তাই তার সঙ্গে জানাশোনা না থাকা তো অসম্ভবই ছিল। ক্রেডিট কার্ড ব্যবসার বিভিন্ন দিক, বিশেষ করে ফরেন কারেন্সি লিমিট বিষয়টা নিয়ে এবং পরে আমাদের ব্যাংকের ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোজার, হংকংয়ে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি খোলা ন্যানো লোনের অনুমতির পেছনে দৌড়াতে গিয়ে বেশ কবার তার কাছে গিয়েছি। আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যবসায়ের দ্বিতীয় টার্মের অনুমতির জন্যও তার দ্বারস্থ হয়েছিলাম। তিনি সবসময়য়েই চেহারায় উত্সুক দৃষ্টি নিয়ে বলেছেন, ‘বসো।তারপর অবধারিত প্রশ্ন, ‘তুমি এত লেখালেখি করো কখন?’

এখানেই বলি আসল কথাটা। তিনি আমাকে যেটুকু স্নেহ বা পছন্দ করতেন, তা আমার ওই লেখালেখির জন্যই। ২০১৫-এর দিকে হোমারের ইলিয়াডের অনুবাদ বের হলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, “তোমার বইটা দেখলাম, ৯৫০ পৃষ্ঠা, ঢাকা ভার্সিটির একজন আমাকে বললেন, ‘ব্যাংকার মানুষ এত বড় কাজ করেছে’?”

ওইদিন আমি জানলাম তিনি আমার সাহিত্যিক দিকটার বিষয়ে জানেন। আমি কাঁচুমাচু হয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “স্যার, আপনি কি আমারফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্রদেখেছেন?” তিনি বললেন, ‘দেখিনি, পড়েছিও। গভর্নর (আতিউর রহমান) সেদিন বলেছিলেন, কাফকা তো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই কঠিন লাগত। ওই ছেলে এত কঠিন বিষয় বাংলায় করল কী করে? তোমারটা কিন্তু আমার কঠিন লাগেনি। ভূমিকা অত বড় দিয়ে ভালো করেছ।

ওই আমি জানলাম, তিনি সাহিত্য পড়েন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার মতোই তিনি সাহিত্য ভালো বোঝেনও।

শেষবার তাকে দেখি তার রুমে, গভর্নর বিল্ডিংয়ে। তিনি আমাকে বসতে বললেন এবং আমার সাবেক বস (সোহেল হুসেইন, বর্তমানে মেঘনা ব্যাংকের এমডি) কেমন আছেন তা জানতে চাইলেন। তার সঙ্গে দেখা হলেই তিনি সোহেল ভাইয়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, তার প্রতি তার ভালোবাসাটা আমি বুঝতাম। ওই প্রসঙ্গ শেষ হলে বললেন, ‘বলো।আমি বললাম, ‘স্যার, হংকং।তারপর যখন আমি তাকে বললাম যে, ‘স্যার, আমি কিন্তু ন্যানো লোন নিয়ে লেগে আছি।তিনি বললেন, ‘লেগে থাকো...আইএফসি তোমাদের বোর্ডে কেমন করছে...আর এখন কী লিখছ?’

আমি তখন যেইমাত্র বললাম যে স্যার আমি তো এর মধ্যেই অনুবাদ বাদ দিয়ে একদম মৌলিক উপন্যাস লিখে ফেলেছি, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার এক বই, প্রথমা থেকে বেরিয়েছে সেটা। শুনে তিনি একটু হাসলেন আর বললেন, ‘আগস্ট আবছায়া?’ আমার পড়া শেষ। তোমার কাছে মার্সেল প্রুস্ত ওই নতুন অনুবাদে থাকলে (মানে যেটার রেফারেন্স আছে আমার উপন্যাসে) আমাকে একসময় দিয়ো তো।

তার ফোন এল। আমি তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি এই অসম্ভব মেধাবী বিনয়ী মানুষটার দিকে, যার সাহিত্যপ্রীতির কথা ইন্ডাস্ট্রিতে আমি ছাড়া আর কজন জানেন, তা আমি জানি না। ফোন রেখে তিনি আমাকে বললেন, ‘বশির (বর্তমান গভর্নর অফিসের জয়েন্ট ডিরেক্টর জয়নুল আবেদীন বশির) তোমাকে খুঁজছে, গভর্নর ডাকছেন, যাও। কিন্তু বিল্ডিংয়ে এলে চেষ্টা করো দেখা করে যেতে।

আর দেখা হয়নি কখনো। তার পরও বারবারই মনে হয় যে ওটা শেষ দেখা ছিল না। মনে হয় যে স্যারের সঙ্গে এর পরে আরো একবার দেখা হয়েছিল। সম্ভবতবিকাশসিইও কামাল কাদিরকে নিয়ে স্যারের ওই একই রুমে সামান্য একটু খানিকের জন্য, যখন আমি বুঝেছিলাম যে স্যার কামাল ভাইয়ের ভালোই ঘনিষ্ঠ এবং যখন তিনি আবার আমাকে, ওই এক-দুই মিনিটের মধ্যেই, কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছিলেন, সেই সাহিত্য নিয়েই।

আমার দুঃখ যে কিলমার্টিন এনরাইটের রিভিশন করা মনক্রিয়েফ অনুবাদের নতুন মার্সেল প্রুস্ত আমার আর কাজেমী স্যারকে কোনো দিন দেয়া হয়ে ওঠেনি। এটা নিজের কাছেই মনে হচ্ছে একটা ক্ষমার অযোগ্য কাজ করেছিলাম আমি।

 মাসরুর আরেফিন: ব্যবস্থাপনা পরিচালক দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫