সবার আস্থা অর্জন করেছিলেন

প্রকাশ: জুলাই ০২, ২০২০

নজরুল হুদা

আল্লাহ মালিক কাজেমী ছিলেন লিজেন্ডারি ব্যক্তিত্ব। শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থাই নয়, দেশের আর্থিক খাতে তার অবদান অনস্বীকার্য। পদার্থবিদ্যার একজন ছাত্র হয়েও অর্থনীতি, সাহিত্য, ইতিহাস প্রতিটিতে তার জ্ঞান ছিল আশ্চর্যজনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরির পরীক্ষায় অর্থনীতির ছাত্রদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রথম হয়ে জয়েন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, নিয়োগের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশিক্ষণেও তিনি প্রথম হয়েছিলেন। অর্থনীতিতে তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন, অথচ ওই ব্যাচে অন্তত ২০ জন অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে প্রথম হওয়া ছাত্রও ছিলেন ওই ব্যাচে। তার থেকেও কাজেমী ভালো করেছেন এবং প্রথম হয়েছেন। উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় তিনি কতটা মেধাবী ছিলেন।

কাজেমী সাহেব ছিলেন আমার কলিগ। চাকরিজীবনে আমাদের সম্পর্কটি ছিল অন্য রকম। যদিও আমরা সহকর্মী ছিলাম, তার পরও তিনি ছিলেন আমাদেরবড় ভাই’-এর মতো। যেকোনো সমস্যায় তার কাছে ছুটে যেতাম। তার কাছ থেকে আমরা বুদ্ধি-পরামর্শ পেতাম। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও অর্থনীতি বিশেষত আর্থিক খাত বিষয়ে তার দক্ষতা-পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ, যা অনেক অর্থনীতি-বাণিজ্য পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ছিল না। মুদ্রানীতি প্রণয়ন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন কাজে তিনি ছিলেন অনন্য। তবে তার প্রকৃত দক্ষতা বা পাণ্ডিত্য ছিল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায়। বৈদেশিক মুদ্রার দেশীয় আন্তর্জাতিক আইনকানুন থেকে শুরু করে নীতি সবকিছুই তার দখলে ছিল। এককথায় তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাদার অব ফরেন এক্সচেঞ্জ বলা যেতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই তার যাত্রা। শেষ পর্যন্ত তিনি এটিই দেখভাল করতেন। মুদ্রানীতি প্রণয়নে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। কাজেমীকে ছাড়া মুদ্রানীতি করা কঠিন বিষয় ছিল বলা চলে। সবার সহযোগিতা নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণীত হলেও তিনি ছিলেন এর নেতা।

প্রতিটি গভর্নর তাকে সমীহ করে চলেছেন। এমনকি ফখরুদ্দিন আহমদও আমাকে নাম ধরে ডাকতেন, কিন্তু কাজেমীকে সাহেব বলে সম্বোধন করতেন। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা বা সংশ্লিষ্ট নীতি প্রণয়নে তার প্রয়োজনীয়তা সব গভর্নরই অনুধাবন করেছেন। কারণে রিটায়ার্ড করার পরও পরামর্শক হিসেবে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকে রেখে দেয়া হয়েছে। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কারণে তার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। ভুললে চলবে না, কাজেমীর নিয়োগ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে প্রথম কোনো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। তার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো পদে কোনো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হয়নি। কাজেমীর চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই তত্কালীন গভর্নর . সালেহউদ্দিন আহমেদ তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন। শুধু তাই নয়, পরবর্তী গভর্নরদ্বয় . আতিউর রহমান বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরও কাজেমী সাহেবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ বাড়িয়ে গেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি কখনই মেয়াদ বৃদ্ধি চাননি। গেল বছরের ডিসেম্বরে তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বর্তমান গভর্নর বলেছিলেন, ভবিষ্যতে যে গভর্নর আসবেন, তিনি যেন মনে না করেন তিনি সাহায্যহীন, সেজন্য কাজেমী সাহেবের মেয়াদ আরো বাড়াতে চাই। প্রতিটি গভর্নরই তার প্রয়োজনীয়তাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি।

কাজেমী সাহেবের জ্ঞান পাণ্ডিত্য, সর্বোপরি নির্ভরতা এত বেশি ছিল যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক বা এডিবি অথবা জাইকা মিটিং করে গেলেই কাজেমীর ডাক পড়ত। গভর্নরদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। গভর্নর বিদেশ সফরে গেলে তার ডাক পড়ত। তিনি বিদেশ যেতে চাইতেন না এবং গিয়েছেনও কম। কিন্তু সেখানে গিয়ে গভর্নরের রোল বা কাজ কী হবে, সে সম্পর্কে কাজেমী সাহেবের দ্বারস্থ হয়েছেন। এমনকি দেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য রেগুলেটর বা অর্থ মন্ত্রণালয় অথবা সরকারের সঙ্গে আলোচনার সময়ও কাজেমী সাহেবের পরামর্শ নিতেন সবাই। এনবিআরসহ আর্থিক যেকোনো বিষয় নিয়েই তার সঙ্গে আলোচনা করতে দেখেছি।

সন্দেহ নেই, কাজেমীর মৃত্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংক তার একজন অভিভাবককে হারাল। মহূর্তে বিশেষ কভিড পরিস্থিতিতে আর্থিক খাত যে চাপে রয়েছে, মুদ্রানীতি সমন্বয়, সুদের হার থেকে শুরু করে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, রেমিট্যান্স প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার পরামর্শ খুব জরুরি ছিল। এমন একটি সময়ে তার চলে যাওয়ায় সত্যিই অনেক বড় ক্ষতি হলো। 

 

নজরুল হুদা: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সাবেক ডেপুটি গভর্নর


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫