চীনের প্রতিবেশী হয়েও যেভাবে মৃত্যু শূন্য রাখতে পেরেছে ভিয়েতনাম

প্রকাশ: মে ৩০, ২০২০

বণিক বার্তা অনলাইন

নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সফলতম দেশ হিসেবে বারবার সামনে আসছে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও হংকংয়ের নাম। যদিও এ দেশগুলোতে কম হলেও কভিড-১৯-এ মৃত্যুর ঘটনা আছেই। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভিয়েতনামই একমাত্র দেশ যেখানে মৃত্যু শূন্য। অথচ তাদের এই সফলতার গল্প অজানা কারণে উপেক্ষিত।

৯ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার দেশ ভিয়েতনামে এখন পর্যন্ত কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে একজনও মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি এবং আজ শনিবার পর্যন্ত দেশটিতে ৩২৮ জন আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সরকার। 

নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ ভিয়েতনামে এশিয়া অঞ্চলের অন্যদের তুলনায় উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নেই। দেশটিতে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৪ জন চিকিৎসক রয়েছে, যা দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। 

দেশজুড়ে ৩ সপ্তাহের লকডাউনের পর এপ্রিলের শেষ দিকে ভিয়েতনাম সামাজিক দূরত্বের বিধিবিধানগুলো তুলে নেয়। ৪০ দিনের বেশি সময় পরও এখন পর্যন্ত সেখানে কোনো সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিদ্যালয়গুলো আবার চালু হয়েছে এবং ধীরে ধীরে জীবনযাপন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। অনেকের কাছে ভিয়েতনামের আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানগুলো সত্য মনে নাও হতে পারে। কিন্তু কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য ভিয়েতনাম সরকার কর্তৃক নির্ধারিত একটি প্রধান হাসপাতালে কর্মরত সংক্রামক রোগের চিকিৎসক গাই থোয়েটস কভিড-১৯ আক্রান্ত কেউ মারা না যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

হো চি মিন সিটির অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ইউনিটের প্রধান থোয়েটস বলেন, এ সংখ্যা বাস্তবতার সঙ্গে মিলেছে। কারণ আমি প্রতিদিন ওয়ার্ডগুলোতে যাই এবং আক্রান্তদের ঘটনাগুলো জানি। আমি জানি যে তাদের মধ্যে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। অগোচরে যদি কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হতো, তাহলে আমরা হাসপাতালে আক্রান্তদের দেখতাম। এটা কখনো ঘটেনি। 

তাহলে কীভাবে ভিয়েতনাম করোনাভাইরাসের বিপর্যয় থেকে নিজেকে রক্ষা করলো? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তরটি সরকারের দ্রুত প্রতিক্রিয়ার ফল। সংক্রমণের প্রাথমিক স্তরেই শক্ত লকডাউন, কঠোর যোগাযোগ অনুসন্ধান (কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং), কোয়ারেন্টিন করা এবং কার্যকর জনসংযোগের মতো উদ্যোগের সম্মিলিত প্রয়াশই মহামারী থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে দেশটিকে। 

প্রাদুর্ভাবের শুরু

প্রথম আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেই ভিয়েতনাম সুরক্ষা প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল। সেসময় তাদের প্রতিবেশী চীন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) উভয়ই দৃঢ়ভাবে জানিয়েছিল, মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। কিন্তু ভিয়েতমান কোনো ঝুঁকি নেয়নি। 

হ্যানয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড এপিডেমিওলজির ইনফেকশন কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের উপ-প্রধান ফ্যাম কোয়াং থাই বলেন, আমরা ডব্লিউএইচওর দিকনির্দেশনার অপেক্ষা না করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। জানুয়ারির শুরুতেই আমাদের বিমানবন্দরগুলোতে শরীরের তাপমাত্রা স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল এবং জ্বরে আক্রান্ত যাত্রীদের আলাদা করে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। 

জানুয়ারির মাঝামাঝিতে উপ-প্রধানমন্ত্রী ভু দুক দাম সরকারি সংস্থাগুলোকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। এরপর থেকে সীমান্ত পথ, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলোতে মেডিক্যাল কোয়ারেন্টিন জোরদার করা হয়।

২৩ জানুয়ারি ভিয়েতনামে প্রথম দুইজনের করোনাভাইরাস শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। তারা হলেন- ভিয়েতনামে বসবাস করা চীনা নাগরিক ও তার বাবা, যিনি ছেলের সঙ্গে দেখা করার জন্য উহান থেকে এসেছিলেন। এর পরদিনই উহানের সঙ্গে সমস্ত ফ্লাইট বাতিল করা হয়।

ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা

চান্দ্র নববর্ষের ছুটি উদযাপনের দিন ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী নিগুয়েন জুয়ান ফু ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করেন। এরপর ১ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে যখন ৬ জন ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়, তখনই ভিয়েতনাম জাতীয় মহামারী ঘোষণা করে। ওইদিন চীনের সঙ্গে সমস্ত ফ্লাইট বন্ধ করে এবং পরেরদিন চীনা নাগরিকদের ভিসা স্থগিত করা হয়। চীনের পর দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান ও ইতালির মতো দেশে ছড়িয়ে পড়ায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, আক্রান্ত সন্দেহভাজনদের আলাদা করা ও ভিসা বন্ধের পরিধি বাড়ানো হয়। মার্চের শেষে গিয়ে দেশটি বিদেশী প্রবেশে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

ভিয়েতনাম সক্রিয় লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর ছিল। সাতজন আক্রান্তের কারণে ১২ ফেব্রুয়ারি হ্যানয়ের উত্তরের ১০ হাজার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে লকডাউন করা হয়, যা চীনের বাইরে প্রথম বৃহৎ আকারের লকডাউন। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ থোয়েটস বলেন, ভিয়েতনামের প্রতিক্রিয়ার গতিই তার সাফল্যের মূল কারণ। জানুয়ারির শেষ দিক থেকে তাদের পদক্ষেপগুলো অন্যান্য দেশের তুলনায় আগাম ছিল।

কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং

প্রথম দিকের পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে কমিউনিটি সংক্রমণ প্রতিহত করেছে এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছিল মাত্র ১৬ জন। কর্তৃপক্ষ দৃঢ়ভাবে আক্রান্তদের কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে এবং তাদের দুই সপ্তাহের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন করা হয়। মার্চ মাসে যখন ভিয়েতনামের অন্যতম বৃহৎ হাসপাতাল হ্যানয়ের বাখ মাই হাসপাতাল কভিড-১৯ এর হটস্পট হয়ে উঠলো, কর্তৃপক্ষ তখন চিকিৎসক, রোগীসহ হাসপাতালটির সঙ্গে যোগাযোগ হওয়া এক লাখ মানুষকে চিহ্নিত করে। এর মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হয় এবং বাকিদের কোয়ারেন্টিন করা হয়। 

একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ১ মে পর্যন্ত ভিয়েতনামে সরকারি সুযোগ-সুবিধায় ৭০ হাজার নাগরিককে কোয়ারেন্টিন করা হয়েছিল এবং ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষকে বাড়ি ও হোটেলে আইসোলেশনে রাখা হয়।

হাত ধোয়া নিয়ে মিউজিক ভিডিও

শুরু থেকেই ভিয়েতনাম সরকার জনসাধারণের সঙ্গে এই প্রাদুর্ভাব নিয়ে স্পষ্টভাবে তথ্য বিনিময় করেছে। নাগরিকদের কাছে এসব তথ্য পৌঁছে দিতে এবং তাদের সচেতন করতে ওয়েবসাইট, টেলিফোন হটলাইন এবং মোবাইল অ্যাপস চালু করা হয়েছিল। 

এছাড়া নাগরিকদের সচেতন করতে লাউডস্পিকারে ঘোষণা, রাস্তায় পোস্টার, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার চালানো হয়। সঠিকভাবে হাত ধোয়া এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালন করা নিয়ে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভিয়েতনামি হিট পপ গানের প্যারোডি বানিয়ে একটি আকর্ষণীয় মিউজিক ভিডিও প্রকাশ করে। ‘হাত ধোয়ার গান’ হিসেবে পরিচিত মিউজিক ভিডিওটি দ্রæত ভাইরাল হয়ে যায় এবং এখন পর্যন্ত এটি ইউটিউবে প্রায় ৫ কোটিবার দেখা হয়েছে। 

ডা. থোয়েটস বলেন, ২০০২-০৩ সালে সার্স মহামারীর মতো সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা থাকায় সরকার ও জনগণকে কভিড-১৯ মহামারীর জন্য আরো ভালো প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করেছে। আমাদের সরকার ও জনগণ বুঝতে পেরেছে যে এ বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে নেয়া উচিৎ এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলা দরকার।

সিএনএন অবলম্বনে শিহাবুল ইসলাম


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫