ভারতীয় অর্থনীতির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সেবা খাত। দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫৫ শতাংশে অবদান রয়েছে এ খাতের। আর ভারতীয় সেবা খাতে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলো হলো কল সেন্টার, হোটেল ও আকাশসেবা। নভেল করোনাভাইরাস আঘাত হেনেছে এর সবগুলোতেই। বছরের পর বছর যে খাত দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে, মাহামারীর কারণে সে খাতের গতিশীলতাই আজ থমকে গেছে। সেবা খাতের স্থবিরতা কর্মসংস্থানে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে মন্দার মুখে রয়েছে অর্থনীতি। খবর ব্লুমবার্গ।
বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারত। সবচেয়ে জনবহুল তাদেরই এশীয় অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। তবে দুই দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। চীনের অর্থনীতি উৎপাদননির্ভর। ভারতেরটা সেবানির্ভর। জনবহুল দেশে করোনার মতো মারাত্মক সংক্রামক ভাইরাসের বিস্তার রোধে সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় জোর দিতে হবে বেশি। ভারত তা দিয়েছেও। দেশটিতে নজিরবিহীন লকডাউন পালন করা হয়েছে। জনচলাচল সীমিত রেখে উৎপাদন কার্যক্রম চালানো সম্ভব হলেও পর্যটন, হোটেল বা আকাশসেবার মতো সেবা খাত চালু রাখা সম্ভব নয়। কঠোর লকডাউনে ভারতে ভ্রমণ থেকে শুরু করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেবার প্রায় সব খাত।
শুক্রবার প্রকাশিত জিডিপির উপাত্তেও এ দুর্দশা ফুটে উঠেছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ভারতের সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি কমে ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। আগের প্রান্তিকে এ হার ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সেবা খাতের এ অধোগতির কারণে গোল্ডম্যান স্যাকস গ্রুপের মতো বিনিয়োগ ব্যাংকগুলো ধারণা করছে, ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া চলতি অর্থবছরে ভারতের অর্থনীতি রেকর্ড ৫ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে।
এপ্রিলে ভারতের মূল সেবা খাতের সূচক ৫ দশমিক ৪ পয়েন্টে নেমে এসেছে, যা গত মাসে বিশ্বে সবচেয়ে কম। অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ প্রিয়াংকা কিশোর বলেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত সেবা খাতের দুরবস্থা উৎপাদন খাতের মতোই দাঁড়াতে পারে।’
ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আকার প্রায় ১৮ হাজার ১০০ কোটি ডলার। এ খাতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি ইনফোসিস লিমিটেড ও টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস লিমিটেড। সফটওয়্যার তৈরি এবং বিশ্বের প্রথম সারির কয়েকটি ব্যাংক ও রিটেইলারকে সেবা দিয়ে থাকে তারা। ইনফোসিস এখন পর্যন্ত তাদের রাজস্বের হিসাব দেয়নি। তবে টাটা কনসালট্যান্সি তাদের প্রান্তিকীয় মুনাফায় ১ শতাংশ পতন দেখিয়েছে।
লকডাউনের কারণে রাতারাতি ভারতে কল সেন্টারগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এর কারণে কিছু বৈশ্বিক ব্যাংক ভারতে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ে যায়। কেউ কেউ অবশ্য ল্যাপটপের মতো উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে ঘরে বসে কল সেন্টারের কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। জেপি মরগান চেজ অ্যান্ড কোম্পানি, বার্কলেস ও নোমুরা হোল্ডিংস ইনকরপোরেশনের মতো ব্যাংকগুলোকে প্রথম দিকে ভারতে তাদের কার্যক্রম চালু রাখার ক্ষেত্রে বিপাকে পড়তে হয়েছে।
প্রিয়াংকা কিশোর বলেছেন, আতিথেয়তা ও বিনোদনের মতো যেসব সেবা সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল, সেগুলোই লকডাউনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনা সংকটের আগে ভারতে কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে ভূমিকা রেখেছে সেবা খাত। তবে লকডাউনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে রাইড শেয়ারিং, ফুড ডেলিভারি, হোটেল বুকিং ও রিয়েল এস্টেটের মতো খাতগুলোয় বিপুল পরিমাণ কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির হিসাব বলছে, কেবল এপ্রিলেই ভারতের সেবা খাতে ১২ কোটি ২০ লাখ কর্মী তাদের চাকরি হারিয়েছেন।
লেমন ট্রি হোটেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পতঞ্জলি গোবিন্দ কেসোয়ানি বলেছেন, ‘মহামারীর কারণে পর্যটন খাতে কর্মসংস্থান হারানো মানুষের সংখ্যা নজিরবিহীন হবে। বতর্মানে ভারতে ব্র্যান্ডের হোটেলগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বাকি ৪০ শতাংশ যারা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের রাজস্ব ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।’