কভিড-১৯-এ মৃতের প্রকৃত সংখ্যা পেতে যা প্রয়োজন

প্রকাশ: মে ২৯, ২০২০

বণিক বার্তা ডেস্ক

প্রতিদিন সকালে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির মরটালিটি স্ট্যাটিসটিক বিভাগের প্রধান রবার্ট অ্যান্ডারসনকে কভিড-১৯- মৃত ব্যক্তিদের পরিসংখ্যান আপডেটের কাজটি করতে হয়। যারা কিনা মৃতের সংখ্যায় বিশ্বে এখন সবার ওপরে। কখনো শেষ হতে না চাওয়া এই পরিসংখ্যান তৈরি করছে গভীর এক হতাশা। যদিও অ্যান্ডারসনকে এটি মহামারীর বিশৃঙ্খলার মাঝেই এক ধরনের উপলব্ধির মুখোমুখি করেছে, যা একেবারে অর্থহীন নয়।

তিনি বলেন, আমার মনে হয় আমি মৃতদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করছি। এটা নিশ্চিত করছি যে তারা গণনায় আছে। যাতে করে তাদের মৃত্যু এমন কার্যক্রম নীতিনির্ধারণে কাজ করবে যা কিনা অন্যদের বাঁচতে সাহায্য করবে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কভিড-১৯- আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে এবং এই প্রাদুর্ভাব খুব দ্রুত শেষ হবে এমনটাও মনে হচ্ছে না। এই সংখ্যা বিজ্ঞানী সরকারি কর্মকর্তাদের মহামারীর তীব্রতা এর প্রতিকার ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এক ধরনের দিকনির্দেশনা প্রদান করছে। যেখানে পরীক্ষা করা এবং শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করার বিষয়টিও যুক্ত আছে।

কাগজে-কলমে এটিকে স্রেফ মৃতদেহ গণনার কাজ বলে মনে করা হয়। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, খুব ভালো পরিস্থিতিতেও পুরো তালিকা তৈরি করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। অশনাক্ত থেকে যাওয়া, ডাটা ট্র্যাকিংয়ে অসংগতি এবং সরাসরি সম্পর্কিত না থাকা মৃত্যুগুলো মহামারীর প্রকৃত চিত্রকে আড়াল করে রাখতে পারে। প্রায় সবগুলো দেশের চিত্রই অনেকটা একই রকম। যেমন ইতালিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এলাকাগুলোয় মৃতের যে প্রাথমিক সংখ্যা তার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা দেড় গুণ বেশি হতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে মহামারীর পুরো প্রভাব বের করা একটি দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের বিষয় হবে, যেখানে কিনা সবসময় অনিশ্চয়তা থাকবে।

ইয়েল ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজিস্ট ড্যানিয়েল উইনবার্গার বলেন, সবকিছু শান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানতে পারব না। তাই আমাদের তথ্যের অসম্পূর্ণ প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। তবে তথ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে চালিত করবে।

কেন মানুষ মৃতের সংখ্যা গণনা করে

১৬৬৫ সালের গ্রীষ্মে লন্ডনবাসী সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্লেগের মুখোমুখি হয়েছিল। দ্য ব্ল্যাক ডেথ নামের এই রোগে মৃতের হিসাব রাখতে নগর কর্তৃপক্ষ একটি সাপ্তাহিক তালিকা তৈরি করে। এটি করা হয় শহরের ভেতর প্রকৃত মৃতের সংখ্যা কারণসহ হিসাবে রাখতে। ইতিহাসবিদরা এখন জানেন ওই বছর লন্ডনে ৭০ হাজার মানুষ প্লেগে মৃত্যুবরণ করে। এই তালিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের প্রথম কোনো পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ।

যদিও মৃত্যুর পরিসংখ্যান তৈরির পদ্ধতি আধুনিক সময়ে এসে আরো বেশি সুনির্দিষ্ট পরিশীলিত হয়ে উঠেছে। এই ডাটা জনস্বাস্থ্যের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এপিডেমিওলজিস্ট ডমিনিক হেইঙ্কে বলেন, জন্ম-মৃত্যুর সংখ্যা এই ক্ষেত্রটির মৌলিক উপাদান।

যুক্তরাষ্ট্রে একজন ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিচালক, ডাক্তার এবং করোনারদের (সেসব সরকারি কর্মকর্তা যারা মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকেন) হাতে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা সময় থাকে মৃত্যু এবং তার কারণ নিশ্চিত করে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য। পরে রাজ্যের পক্ষ থেকে এটি সিডিসির মরটালিটি স্ট্যাটিসটিক বিভাগে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই মৃত্যু গাড়ি দুর্ঘটনায় হতে পারে, আবার কভিড-১৯-এর কারণেও হতে পারে। প্রক্রিয়াটি মোটা দাগে একই থাকে।

অ্যান্ডারসন বলেন, এখন পরীক্ষার স্বল্পতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি সবাই নিশ্চিতভাবে সার্স-কোভ--এর পরীক্ষার আওতায় আসেনি। যে কারণে সিডিসি এখন মৃত্যুর কারণ জানতে ডাক্তারদের সিদ্ধান্তের ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করছে।

তবে উপায়টির সমস্যা কোথায় তা দেখিয়ে উইনবার্গার বলেন, কিছু রাজ্যই সেসব কভিড-১৯ কেস বিবেচনায় নেয়, যাতে লক্ষণ দেখা গেছে (যা মূলত সম্ভাব্য কেস), বাকিরা তা করে না। এমনকি ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর যে কারণ দেখানো হয় তা ভুলও হতে পারে।

মহামারীর শুরুর দিকে কভিড-১৯- মৃত্যুর কিছু ঘটনা বাদ পড়তে পারে। অনেক ক্ষেত্রে শনাক্তকরণেও ভুল হতে পারে। সিডিসির একটি ডাটা বলছে, মার্চে নিউমোনিয়ায় মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সময় কোনো মৃত্যুর ক্ষেত্রে কভিড-১৯ কে দায়ী করা হয়নি, কারণ তখন পরীক্ষা করাও সেভাবে শুরু হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে উহানের মতো যুক্তরাষ্ট্রেও মৃতের সংখ্যা সঠিকভাবে উল্লেখ করা হয়নি।

ইচ্ছাকৃতভাবে অসংগতিপূর্ণ ট্র্যাকিং নিশ্চিতভাবেই চূড়ান্ত সংখ্যাকে প্রভাবিত করবে, বলছিলেন পরিসংখ্যানবিদ মেগান প্রাইস। উদাহরণস্বরূপ ইরাক যুদ্ধের সময় কর্মকর্তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মৃত্যুর হার গোপন করেছিল। কভিড-১৯-এর পরিস্থিতি যুদ্ধের সময়ের চেয়ে ভিন্নতর হলেও ধরনের কারচুপির সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে নারাজ প্রাইস।

মৃতের সঠিক সংখ্যা বের করা

এসব চ্যালেঞ্জের বাইরে মৃত্যুহার বিবেচনায় কোনো একটি দুর্যোগ প্রায়ই আইসবার্গের কাজ করে। যেমন কভিড-১৯-এর উত্থানের ফলে মানুষের অন্যান্য রোগে মৃত্যুও বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ একজন হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতে পারে, কারণ জরুরি চিকিৎসা না নেয়ার কারণে। মহামারীকে বুঝতে হলে এসব পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যাকে আগের বছর সার্বিক মৃত্যুর হারের সঙ্গে তুলনা করে কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তা দেখতে হবে। উইনবার্গার সহকর্মীদের একটি গবেষণা বলছে, মহামারীর শুরুর দিকে সব ধরনের কারণে নিউইয়র্ক নিউ জার্সিতে মৃতের সংখ্যা বেড়েছে . থেকে গুণ পর্যন্ত। যেখানে শ্বাসযন্ত্রে ভাইরাস সংক্রমণ ছাড়া হার্ট অ্যাটাক স্ট্রোকও রয়েছে।

স্বাস্থ্য গবেষক ইলান কেলমানের মতে, রকম অত্যধিক মৃতের হার কভিড-১৯- সরাসরি মৃত্যুর হিসাবনিকাশকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে। তার পরও এই অত্যধিক মৃত্যু মহামারীর তীব্রতা এবং এর মোকাবেলায় সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কেও একটি পরিষ্কার ধারণা দিচ্ছে। কেলমান বলেন, ভূমিকম্প কোনো দুর্যোগ না। কিন্তু যখন সিস্টেম এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয় তখন এটি দুর্যোগ।

তবে অতিরিক্ত মৃত্যু সত্যিকার অর্থে কভিড-১৯-এর সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা তা বের করা অসম্ভব। যদি চিকিৎসা নিতেন তিনি হার্ট অ্যাটাক থেকে বেঁচে যেতে পারতেন? এটি আসলে যে ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর করছেন তার ওপর নির্ভর করে বলে মনে করেন অ্যান্ডারসন। তার মতে, এটি আসলে তার বিবেচনা এবং ভুলের সঙ্গে সম্পর্কিত। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা প্রতিটি মৃত্যু সংখ্যার বদলে সার্বিকভাবে মহামারীর সময়ে মৃতের সংখ্যা কতটা বেড়েছে তা দেখতে চান। এই পরিবর্তন বোঝার জন্য একটি দেশের মহামারীবিহীন বছরের মৃত্যুহারের অবস্থান বিবেচনা করেন তারা।

এপিডেমিওলজিস্ট জোসেফ বলেন, মহামারীর প্রতিক্রিয়া এসব অনুমানকে অকেজো করে দিতে পারে। যেমন মহামারীর ফলে যে উদ্বেগ অর্থনৈতিক অস্থিরতা তা কার্ডিওভাসকুলার মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে।

এখন হাতে থাকা তথ্য সেরা গাণিতিক মডেলগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করাটাই মূল চ্যালেঞ্জ। তবে সবকিছু শেষ না হওয়া অবধি সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাও সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫