একজন শিক্ষকের জন্য শ্রদ্ধা, অনেক শিক্ষকের জন্য সম্মাননা

প্রকাশ: মে ২৭, ২০২০

মামুন রশীদ

প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিখ্যাত ইকনোমিস্ট পত্রিকার একটি নিবন্ধের বরাত দিয়ে প্রায়ই একবিংশ শতাব্দীতে ষোড়শ শতকের বেঁচে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বর্ণনা দিতেন। কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের গবেষণায় ষোড়শ শতকে জন্ম নেয়া এবং একবিংশ শতকে টিকে থাকা ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৯টিই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়, ২টি চার্চ, ১টি পার্লামেন্ট আর শুধু ১টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না, কেন জ্ঞান বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শতাব্দী পরম্পরায় টিকে থাকে, কেন মুনাফাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলো নয়। 

কারণটা হয়তো বিতরণে জ্ঞান বাড়ে, অর্থ কমে। নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞানচর্চা জ্ঞানের পরিধিকে সম্প্রসারণ করে; মানবতাকে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই মুনি-ঋষিরা জ্ঞানে বিনিয়োগের কথা বলেছেন। আমাদের মহানবী জ্ঞানলাভের জন্য সুদূর চীনে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই একই কারণে যারা বা যে মহান ব্যক্তিরা বিদ্যালয় বা শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন তারাও হয়ে ওঠেন অমর। কারণ বিদ্যালয়ের প্রধান কাজ জ্ঞান বিতরণ, ক্রমাগত আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে শিশুর মেধা ও মনন গড়ে তোলা। তাকে অজানা কিন্তু আকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়া।   

সদ্য প্রয়াত সানবিমস স্কুলের অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর সেই কাজটিই করেছিলেন। তা-ও আবার দেশের সেরা একটি ইংরেজী মাধ্যম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে, তিলে তিলে তাকে বিশ্বমানের একটি বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে। ৭৪ বছর বয়সে মারা যাওয়াটা খুব কম বয়সে চলে যাওয়া নয়। কিন্তু আমরা সবাই বলছি, বেশি বলছেন তার ছাত্র-ছাত্রীরা, তারইতো উচিত ছিল শতায়ু হওয়ার। সেই যে বীরযোদ্ধা নেলসন বলেছিলেন- ‘তোমরা আমাকে ভালো মা দাও, আমি তোমাদের একটি স্বার্থক জাতি উপহার দিবো’। এই দুর্ভাগা দেশে আমরা বলি, কিছু নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক আর আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাই পারে আমাদের জাতিকে এগিয়ে নিতে। প্রয়াত নিলুফার মঞ্জুর ছিলেন তেমনই একজন দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি আর শিক্ষাদ্যোক্তা।

আমরা এতদঞ্চলে একটি হার্ভার্ড, প্রিন্সটন, কলাম্বিয়া বা স্ট্যানফোর্ড গড়ে তুলতে পারিনি,  হয়তো পারবোও না। তবে মিসেস মঞ্জুরের ছাত্র-ছাত্রীরা ঠিকই পৌঁছে গেছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউডব্লিউসি (ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড কলেজ) বা এডেক্সেল সূত্রে নিশ্চিত জানি, পৃথিবীর এমন কোনো বড় দেশের বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যেখানে সানবিমস এর বাচ্চাগুলো (মিসেস মঞ্জুরের ভাষায়) যায়নি কিংবা যেতে পারেনি। বিশ্বায়নের যুগে এটাকেই সম্ভবত বলা উচিত দেশ গঠনে, জাতি গঠনে সহায়তা কিংবা অবদান। 

পাঠকদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই জানেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২-৭৩ সালে ইংরেজি খেদাও, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল খেদাও, ক্যাডেট কলেজ বন্ধ করো- রব উঠেছিল। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি- স্বাধীনতা যুদ্ধের সিপাহশালার জেনারেল এমএজি ওসমানী, বিশেষ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, তাদের দূরদৃষ্টির জন্য। ইংরেজী মাধ্যমে পরিচালিত ক্যাডেট কলেজগুলোকে তারা বন্ধ করেননি। প্রায় একই সময়ে আজকের ম্যাপল লিফ স্কুলের একজন শিক্ষিকা আর একজন ব্যবসায়ীর স্ত্রী- কয়েকজন বন্ধু নিয়ে একটি ইংরেজী মাধ্যম স্কুল গড়ে তোলার উদ্যোগকে অনেকটা দাঁড়িয়ে সম্মান জানানোর মতোই ঘটনা। তাও আবার স্বামী অফিসে চলে যাওয়ার পর লিভিং রুমকে ক্লাসরুমে কনভার্ট করা, আবার স্বামী ফেরার আগেই সবকিছু আগের জায়গায় নিয়ে গিয়ে স্কুল চালানো, চাট্টিখানি কথা নয়। 

জনতা ব্যাংকের ১০ হাজার টাকা ঋণ আর টেবিল-চেয়ারের কথা না হয় বাদই দিলাম। সবচেয়ে কঠিন ছিল, শিক্ষক ও শিক্ষার মান বজায় রেখে গেল ৪৬ বছরে স্কুলটিকে প্রায় সকল বিতর্কের উর্ধ্বে রেখে ‘গ্লোবাল ট্যালেন্টপুলের’ সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারা। 

ইকোনমিস্টের রিপোর্টের কথা চিন্তা করলে ৪৬ বছর তেমন একটা বেশি সময় নয়। কিন্তু শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বিশেষ করে এই ক্রমাগত তদবির আর টাকার বাহাদুরির দেশে সত্যিকারের মেধালালন বা বিকাশের কাজটি অনেক দুরূহ বৈকি। 

আমার বর্ধিত পরিবারের বিশেষ করে ভবিষ্যৎ বংশধরদের অনেকেরই সুযোগ হয়েছে মিসেস মঞ্জুরের ‘ভবিষ্যৎ গড়ার কারখানা’য় যোগ দেয়ার। বাধ্যতামূলক ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। তাদের কাছে ‘মিসেস মঞ্জুর’ একজন যোদ্ধার নাম। বাংলাদেশে বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিতকরণের যোদ্ধা। একজন নিরলস সৈনিক। 

কি দরকার ছিল? ছিলেন একজন অতি সফল ব্যবসায়ীর জীবনসঙ্গী। ডিনার আর পার্টি করেই কাটিয়ে দিতে পারতেন বাকি জীবনটা। না, তিনি সে পথে যাননি। যদিও ছিলেন একজন প্রিয় সহধর্মিণী, দায়িত্বশীল মা। কিন্তু সব ছাপিয়ে ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, বাচ্চাদের প্রিয় শিক্ষয়িত্রী। ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর। 

গতকাল মঙ্গলবার যখন তার প্রয়াণ সংবাদে তার দেশী-প্রবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের মন্তব্য আর বর্তমান ‘বাচ্চাদের’ কান্না দেখেছি, তখন ভেবেছি অনুজপ্রতিম নাসিমকে বলবো- ‘স্বার্থক জনম মাগো’। ব্যবসায়ী মঞ্জুর এলাহীকে কতজন মনে রাখবে জানি না। তিনিও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, সুনামের সঙ্গে সেগুলো চালিয়েছেন এবং চালাচ্ছেন। কিন্তু মিসেস নিলুফার মঞ্জুরকে কেউ ভুলবে না। একজন ভালো শিক্ষককে কেউ ভুলতে পারে না। একজন শিক্ষাবিদ বেঁচে থাকেন তার হাজারো শিক্ষার্থীর মাঝে, তাদের সাফল্যে। জাতির ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে।

শুরু করেছিলাম, স্যার আবেদকে দিয়ে। ব্যাংকের চাকরি ছাড়ার পর তিনি আমাকে দিতে চেয়েছিলেন পুরনো ২০টি জেলা শহরে একটি করে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করার কাজ। তিনি বলেছিলেন- আমাদের নজর দিতে হবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার দিকে। বিশ্বমানের নাগরিক গড়ে তোলার সুতিকাগার হবে আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলো। আজ বলতে দ্বিধা নেই- আমি কাজটিকে খুবই চ্যালেঞ্জিং ভেবে পিছু হটে এসেছিলাম। আর মিসেস মঞ্জুর সব আরাম আয়েশ ত্যাগ করে এগিয়ে গেছেন সম্মুখপানে।

স্কুল চালানোর বিষয়ে তিনি ছিলেন নির্মোহ-কঠিন। তদবির-সুপারিশ তিনি পছন্দ করতেন না। অনেক সময় ভর্তির তদবির করতে চেয়েছি। আত্মীয়-পরিজন আর বন্ধু-বান্ধব সবাই বলেছে, কাজ হবে না। আমিও আর এগোইনি। 

একজন শিক্ষাবিদ বিশেষ করে ভালো শিক্ষক একটি জাতির ভবিষ্যত বিনির্মাণের কাণ্ডারি। তারা বেঁচে থাকেন জাতির সাফল্যে। 

নিলুফার মঞ্জুরও মরেননি, শুধু বাড়ি বদলেছেন। চলে গেছেন সৃষ্টিকর্তার কাছাকাছি, হয়তো একটি জাতিগঠনে সহায়তা করার জন্য পুরস্কার নিতে। মিসেস নিলুফার মঞ্জুরকে শ্রদ্ধা। সকল ভালো শিক্ষককে সম্মান আর অনেক অনেক ভালোবাসা।

মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫