মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কভিড-১৯ মহামারীর উত্পত্তিস্থল অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক তদন্তের ডাক দিয়েছে। তাদের এ উদ্যোগের এক ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। যা কিনা নিজেদের সীমান্তের ভেতর মহামারীর বিপরীতে সাড়া দেয়া ব্যর্থতার দায় আরেকজনের ওপর চাপিয়ে দেয়া। ট্রাম্প প্রশাসন এবং অস্ট্রেলিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্রের
বন্ধুরাষ্ট্রগুলো আঙুল তুলেছে চীনের দিকে।
এটা দুর্ভাগ্যজনক। কারণ নিজেদের স্বার্থেই সবাইকে এখন একসঙ্গে কাজ করতে হবে। চীনের সংকট সামাল দেয়ার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে, নতুন এই সংক্রমণের কারণ খুঁজে বের করতে হবে। যাতে ভবিষ্যৎ বিপর্যয়কে প্রতিহত করা যায়।
আমাদের বুঝতে
হবে কীভাবে সার্স-কোভ-২ নামক করোনাভাইরাসটি মহামারীর জন্য দায়ী, কীভাবে এর অস্তিত্বে ধরা দেয়। পাশাপাশি দেখতে হবে কখন ও কীভাবে আমরা এর অগ্রগতিতে বাধা দিতে পারব। অর্থাৎ ভাইরাসের উত্পত্তিকে পরীক্ষা করে দেখা এবং এর জৈবিক ও পরিবেশগত কারণগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, যা কিনা ভাইরাসকে বিপজ্জনক হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। এটি করতে হলে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক তদন্ত দরকার, যা কিনা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং সংকীর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা থেকে মুক্ত থাকবে।
আমরা কী জানি
বিস্তৃত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বলছে, কভিড-১৯ ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি বা ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়নি কিংবা এটা মহামারী সৃষ্টির কোনো ষড়যন্ত্রের অংশও নয়।। এটা কেউ তৈরি করেনি কিংবা এটা উহানের কোনো জায়গার ল্যাবরেটরি থেকেও ছড়িয়ে পড়েনি। কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার প্রথম কেসটি অবশ্য উহানের বাজার থেকে আসেনি। এটি চীনের অন্য কোথাও থেকে এসেছে, সম্ভবত হুবেই প্রদেশের বাইরে থেকে এসেছে। এমনকি এটি বাজার থেকেও সৃষ্টি হয়নি। যদিও এর ছড়িয়ে পড়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা উহানের মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত, যা চীনের জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে।
সার্স-কোভ-২ প্রাণীর দেহ থেকে মানবদেহে স্থানান্তরিত হয়। এরপর একাধিকবার নিজেকে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটি মানুষের জন্য ভয়ংকর হয়ে দেখা দেয়। মানুষের শরীরে আসার মধ্যবর্তী কোনো প্রাণী বাহক সম্ভবত ভূমিকা রেখেছে। যদিও কোন প্রাণী তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এখানে সম্ভাব্য ঘটনাগুলোকে এভাবে সাজানো যায়—বাদুড়ের মাঝে থাকা করোনাভাইরাস এক বা একাধিক প্রাণীকে নিজেদের বাহক হিসেবে খুঁজে নিয়েছিল। সেটি বনরুই কিংবা কোনো প্রজাতির বিড়াল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এই ঘটনাটি ঘটেছে দক্ষিণ চীনের কোনো একটি জায়গায়। সে সময় এই ভাইরাস মানুষকে সংক্রমিত করার কিংবা মানুষের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো রোগ ছিল না কিংবা আক্রান্ত প্রাণীটির সঙ্গে মানুষের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। পরে অজানা সময় ধরে সম্ভবত কয়েক দশক ধরে এটি নিজেকে বেশ বিপজ্জনকভাবে রূপান্তরিত করে। এরপর এটি কোনোভাবে মানুষকে সংক্রমিত করে। ধারণা করা হচ্ছে সেটি হতে পারে ২০১৯ সালের নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে।
এরপর নতুন এই ভাইরাসটি দ্রুত অন্য মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং হুবেই প্রদেশে যাওয়ার পথটি খুঁজে পেয়েছিল। এরপর আক্রান্ত কোনো এক ব্যক্তি উহানের কোনো বাজারের ভিড়ে গিয়ে হাজির হয়েছিল এবং আরো ২১ জন মানুষের আক্রান্তের কারণ হয়েছিল। পরের দুই সপ্তাহ বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ে, যা ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সতর্কবার্তা ছিল। ৩১ ডিসেম্বর চীন ভয়ংকর এই ভাইরাসটির ব্যাপারে বিশ্বকে সতর্ক করে। মার্কেট বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রান্তদের ও তাদের সংস্পর্শে আসাদের চিহ্নিত করে আইসোলেটেড করে ফেলা হয়।
তিন সপ্তাহ পর বোঝা যায় এ পদক্ষেপগুলো মহামারীকে আটকাতে যথেষ্ট নয়। ২৩ জানুয়ারি চীন সরকার গোটা শহরকেই লকডাউন করে দেয়। এটি চীনে ব্যাপক আকারে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া আটকাতে পারলেও আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়া থামাতে পারেনি। কারণ এরই মধ্যে ভাইরাস তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে যায়।
আমরা কী জানি না
এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের আগের মাস বা বছরগুলোত কী ঘটেছিল এবং পূর্ববর্তী ক্ষেত্রে বা বিপর্যয় রোধ করার জন্য কি কিছুই করা যেত না। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা ভাইরাসটির বিকাশ বুঝতে পেরেছি, এটি অন্যান্য মানবিক রোগের মতো প্রাণী থেকেই সৃষ্ট, এটি বিশৃঙ্খল জৈবিক ঘটনার পাশাপাশি পরিবেশগত চাপের কারণে ঘটেছে। ভাইরাসটি নিজেকে বারবার পরিবর্তন করেছে, মূল বন্য প্রাণীটি অন্যান্য প্রজাতির সংস্পর্শে আসে এবং ভাইরাসটি সেই প্রজাতির মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর পরবর্তী পরিবর্তনগুলোও একে একে ঘটতে থাকে। এক পর্যায়ে সেই প্রাণী মানুষের সন্নিকটে এসেছে। সেই মানুষ নতুন কাউকে সংক্রমিত করেছে।
আলাদা পথের সম্ভাবনা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ভাইরাসের লম্বা তালিকাটি এ ধারায় এগিয়েছে। যেখানে এইচআইভি, সার্স, মার্স, ইবোলা, নিপাহ, লাসা, জিকা, হেন্ড্রা, বিভিন্ন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং সার্স-কোভ-২ও অন্তর্ভুক্ত। এটি বলছে নতুন ফ্যাক্টরগুলো প্রকাশ, অভিযোজন, সংক্রমণ ও বিস্তৃতির সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
আর এ ফ্যাক্টরগুলোর মাঝে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি সম্প্রসারণ, বন্য প্রাণীর আবাস হারানো, প্রচলিত খাদ্য উেসর ক্ষতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রাণীদের প্রজাতির মাঝে এবং মানুষের সঙ্গে প্রাণীর সম্পর্কের পরিবর্তনও ভূমিকা রেখেছে। বনজঙ্গল ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তন এ প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। ঘরে এবং বিদেশে জনসাধারণের চলাচল বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিকভাবে বন্যপ্রাণী ক্রয়-বিক্রয়ের অবৈধ ব্যবসা, ওষুধের অযাচিত ব্যবহার, কীটনাশক এবং সরকারগুলোর একসঙ্গে কাজ করার অনীহা এ অবস্থাকে আরো খারাপ করে তুলেছে।
এখন আমাদের নিশ্চিতভাবে এ ফ্যাক্টরগুলো কীভাবে ভাইরাসের জেনেটিকস প্রভাবিত করে এবং ভূমিকা রাখে তা জানতে হবে, যা কিনা আমাদের সাহায্য করবে এটিকে ব্যর্থ করার উপায় খুঁজে পেতে।
সম্ভাব্য ভয়ংকর রোগগুলো শনাক্ত করার লক্ষ্যে এবং প্রজাতিগুলোর যোগাযোগ নজরে রাখতে আমরা এখন সম্মিলিতভাবে একটি পূর্ব সতর্ক ব্যবস্থা উদ্ভাবন করতে পারি। এছাড়া আমরা যদি প্রাণীদের আদি বাসস্থানগুলো সংরক্ষণ করতে পারি এবং বন্যপ্রাণীদের খাদ্য সংগ্রহে মানুষের আবাসে আসার চাপ কমাতে পারি, সেটিও বেশ কার্যকর হতে পারে।
দ্য কনভরসেশন অবলম্বনে