শোকগাথা

কর্মনিষ্ঠ দুই বীরের প্রয়াণ

প্রকাশ: মে ০৯, ২০২০

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

আমার পরম শ্রদ্ধেয় জাতীয় অধ্যাপক . জামিলুর রেজা চৌধুরী (১৯৪৩-২০২০) . সাদত হুসাইন (১৯৪৬-২০২০)-কে নিয়ে এভাবে শোকগাথা লিখতে হবে এটা কখনো ভাবিনি করোনা সম্মোহিত দুঃসময়ে তাদের মতো জাতীয় ব্যক্তিত্বের এভাবে চলে যাওয়া, তাদের জানাজায় যোগ দিতে না পারা  এবং তাদের জন্য প্রকাশ্য শোক দোয়ার অনুষ্ঠান আয়োজনের কোনো দায়িত্ব সুযোগ না থাকায় বেদনার মুহূর্তে মুহ্যমান আমরা তাঁরা দুজনই করোনায় আক্রান্ত হননি, কিন্তু করোনাকালে তাদের চিরপ্রস্থানে গোটা জাতি কিংকর্তব্যবিমূঢ় গত ১৩ এপ্রিল ব্রেন স্ট্রোক করে সাদত স্যার অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নয়দিন পর চিকিসাধীন অবস্থায় ২২ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টায় ইন্তেকাল করেন আর ২৮ এপ্রিল অতি প্রত্যুষে নিজ বাসভবনে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন স্বনামধন্য প্রকৌশলী, পরামর্শকগবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী তথ্যপ্রযুক্তিবিদ জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী দুজনই ছিলেন দেশ জাতির সম্পদ তাদের তিরোধান বাংলাদেশের  জন্য অপূরণীয় ক্ষতি

৭৮ বছর বয়সে কারো মৃত্যুকে অকালমৃত্যু বলা য়ায় না কিন্তু জেআরসির বেলায় এটি অবশ্যই অকালমৃত্যু কেননা পুরোমাত্রায় বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সচল সজীব এবং কর্মতত্পর ছিলেন তিনি আমাদের কাছে মনে হতো এবং আমরা প্রচণ্ডভাবে প্রত্যাশী ছিলাম জাতিকে অধ্যাপক চৌধুরীর অবদানের আবকাশ ফুরিয়ে যেতে পারে না এই বয়সেও তিনি এমনই কর্মনিষ্ঠ ছিলেন যে যখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনুরোধ নিয়ে তাঁর দ্বারস্থ হয়েছি, তিনি তা রাখতেন এই তো সেদিনের কথা বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে  সোসাইটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেয়ার রেওয়াজ বিশেষ কারণে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবার যোগ দিতে পারছেন না, এটা বঙ্গভবন থেকে আমরা জানতে পাই অনুষ্ঠানের সপ্তাহ দুই আগে অধ্যাপক চৌধুরীকে আমরা ফোনে অনুরোধ রাখতেই তাঁর ডায়েরি চেক করে রাজি হলেন এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথির লিখিত ভাষণের পরিবর্তে যে উন্মুক্ত বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা ছিল অপূর্ব এবং অজানা তথ্যবহুল সে বক্তৃতায় প্রসঙ্গক্রমে তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণের টেকনিক্যাল কিছু বিষয়-আশয় এমনভাবে ব্যাখ্যা করলেন, তাতে মনে হলো এভাবেই হর্সেস মাউথ থেকে সেগুলো জানা দরকার গত অক্টোবরে ঢাকায় সাউথ ইস্ট এশিয়ান কোঅপারেশন (সিয়াকো) এবং ওআইসিএফের যৌথ উদ্যোগে নাইনথ গ্লোবাল ডিসকোর্স: ফোর্থ আইআর: সিজিং পসিবিলিটিস ফর দ্য ফিউচারের বিজ্ঞান প্রযুক্তিবিষয়ক অধিবেশনে প্রধান অতিথি হয়ে  এসেছিলেন স্বল্প সময়ের নোটিসে আমাদের অনুরোধে সে সভায় দক্ষিণ এশিয়ার সাত দেশের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা অধ্যাপক চৌধুরীর পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়েছিলেন

মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি কাউন্সিল সভায় পাশাপাশি বসে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা পালনের পারঙ্গমতা দেখেছি জেআরসি দেশে প্রযুক্তি প্রসারের পথিকৃ ছিলেন আশির দশকে জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিমকে (১৯১১-১৯৮৯) তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন বারডেমে আইটি প্রবর্তনের সমীক্ষা করে দিতে, দেশে যখন কম্পিউটার ব্যবহার পুরোপুরি চালু হয়নি, তখন প্রফেসর ইব্রাহিমের দূরদর্শিতায় তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং বারডেমের আইটি প্লাটফর্ম তাঁর হাতে করা ২০১৮ সালে বারডেমের ইব্রাহিম কার্ডিয়াক ভবনের ওপর কোনো স্ট্রাকচার করা যাবে কিনা, সে  ব্যাপারেও তাঁর বিজ্ঞ পরামর্শ আমরা নিয়েছিলাম উল্লেখের বিষয় এই যে, কোনো কাজে যে কেউ তাঁর দ্বারস্থ হলে তিনি যতটুকু পারতেন করে দিতেন আমরা বুয়েটের বিআরটিসিকে নরসিংদীতে কে খান ইকোনমিক জোনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের কাজ দিয়েছিলাম, ওই কাজের সুপারভাইজিং পরামর্শক হতে তাকে অনুরোধ রাখলে তাঁর সময়ের টানাটানি থাকতেও রাজি হয়েছিলেন অর্থা তিনি সুপারভাইজ করবেন জানলে ওই কাজের গুণগত মান বজায় রাখতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তটস্থ থাকবেএই প্রত্যাশা থাকত সবার তিনি দেশের অতিমূল্যবান সম্পদ ছিলেন তাকে একজন লিভিং এনসাইক্লোপেডিয়া মনে হতো আমাদের এত প্রখর স্মরণশক্তি আমার সঙ্গে সাক্ষা হলেই বলতেন, মজিদ সাহেব আপনার ওই লেখা পড়েছি আপনি ধর্ম বিষয় নিয়েও লেখেন, কবে দেখবেন ওই সেক্টরের লোকেরা হয়তো বলবে আপনি অর্থনীতি সাহিত্য নিয়ে থাকুন আমাদের জগতে না-ইবা এলেন তাঁর কথার মধ্যে সবসময় একটা সরস উপদেশমূলক উষ্ণতা পেতাম তাঁর সামনে একদিন অধ্যাপক ইব্রাহিম তাঁর জুনিয়র সহকর্মীকে সকালে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অক্সিজেন ফ্যাক্টরি হয়ে এসছ?’ চিকিসক বললেন, ‘স্যার আমার কি আজ সেখানে যাওয়ার কথা ছিল?’ উনি বললেন, আরে না, প্রতিদিন বাসা থেকে আসার সময় আমি রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসি, ওটাই আমাদের অক্সিজেন ফ্যাক্টরি সেই থেকে অধ্যাপক চৌধুরী ভোরে রমনা পার্কে হাঁটতে যেতেন (পুরো রমনা পার্ক এক চক্কর দিতে তাঁর সময় লাগত ৩২ মিনিট), প্রতিদিন সুডোকু বা শব্দজট মেলানো, দিনে অন্তত সাত-আটটি সংবাদপত্র পড়া, নিয়মিত -মেইল চেক করা এবং রাতে স্কাইপে নাতির সঙ্গে কথা বলা ছিল অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর দৈনন্দিন অভ্যাস


ব্যবহারে অমায়িক, আন্তরিক মানবিক, তবে পেশাদারিত্বের প্রশ্নে, কোয়ালিটি অ্যাসুয়েরেন্সের ক্ষেত্রে ছিলেন কঠোর এবং নিখুঁত আমার তত্ত্বাবধানে ডায়াবেটিক সমিতির জন্য একজন ওয়েব অফিসার নেয়া হবে ভাইবা নেয়ার সময় আমার অনুরোধে স্যার নিজেই এলেন এক প্রার্থীকে প্রশ্ন করলেন, তার ওয়েব পেজ করার অভিজ্ঞতা আছে কিনা? প্রার্থী তার করা ওয়েব পেজের নাম বললেন অধ্যাপক চৌধুরী তাত্ক্ষণিকভাবে তাঁর মোবাইল থেকে সেই ওয়েব পেজ ডাউনলোড করে এনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এমন সব ভুল বের করলেন যে ওই প্রার্থীর জারিজুরি সব ফাঁস হয়ে গেল ধরনের একটা নিয়োগ কমিটিতেও তাঁর নিষ্ঠা সিরিয়াসনেস দেখে সেদিন বিস্মিত হয়েছিলামএমন কঠোর শাসক, উপদেশক আর কাউকে এভাবে পাওয়া যাবে না, মিলবে না,’ বলতেন ডায়াবেটিক সমিতির বর্তমান ট্রেজারার প্রফেসর এমএইচ খান, বুয়েটের সাবেক ভিসি, প্রফেসর চৌধুরীর শিক্ষক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিল সভায় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় দেখেছি গুরু-শিষ্যের পরস্পরের প্রতি বিনয় স্নেহ-সম্মান, শ্রদ্ধা প্রকাশের ঐশ্বর্যময় পরিবেশ  জটিল বিষয়ে ছাত্রের মতামত পরামর্শকে বড্ড  উপাদেয় পুষ্টিকর মনে মেনে নিতেন এমএইচ খান এবং তাঁরও স্যার (অর্থা জে আর সির স্যারের স্যার) অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দীন আহমদ, যিনি ছিলেন ডায়াবেটিক সমিতির সাবেক সভাপতি ওম্বুডসম্যান বুয়েটের তিন প্রজন্মের এই তিন কৃতী প্রকৌশলী প্রবরের কাছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ শিক্ষক ওয়াহিদ উদ্দীনের পর এখন ছাত্র জামিলুরের তিরোধান এমএইচ খানের জন্য বড় বেদনাবিধুর অভিজ্ঞতা, নিজেকে বড্ড নিঃস্ব বোধ করছেন কেননা এই করোনাকালেই মাত্র কিছুদিন আগে এমএইচ খানের স্ত্রীও পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন 

সততা, কর্মদক্ষতা, নিরপেক্ষতা চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য প্রসিদ্ধ লাভকারী, নিয়মানুবর্তী নীতিপরায়ণ জনপ্রশাসক . সাদত হুসাইন এনবিআরের চেয়ারম্যান, সরকারের মহিলা শিশু, প্রাথমিক গণশিক্ষা, শিক্ষা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রধান তথা বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব (২০০২-০৫) হয়েছিলেন সব শেষে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের মতো সাংবিধানিক পদে (২০০৭-১১) অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তিনি তিনি ছিলেন বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের (বিএনএফ) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এসটিডি) মতো প্রতিষ্ঠানের ১৯৭১ সালে মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা সাদত হুসাইন ছিলেন একজন উড ব্যাজধারী স্কাউট স্কাউট আন্দোলনে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য স্কাউটের সর্বোচ্চ সম্মান দ্য সিলভার টাইগার সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন

. সাদত হুসাইন ছিলেন আমাদের অর্থা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ১৯৭৯, ১৯৮১, ১৯৮২ ব্যাচের নিয়মিত পরবর্তী ব্যাচগুলোর অতিথি বিষেশজ্ঞ প্রশিক্ষক সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমিতে এবং পরে পিএটিসতে, আর সে সূত্রে আমরা তাঁর ছাত্র, শিষ্য, সাগরেদ, সহকর্মী হিসেবে লাভ করেছি অপার সান্নিধ্য তাঁর কাছে সরাসরি কাজ শিখেছি ইআরডিতে, বিএনএফে ক্যাবিনেট সচিব হিসেবে তিনি ছিলেন বিএনএফের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আর আমি ছিলাম  অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব হিসেবে এর প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক এছাড়া সরকারের বহু কমিটিতে সংযুক্ত থেকে কাজ করেছি তাঁর সঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিএসটিডিতে এখনো নিয়মিত প্রশিক্ষক হিসেবে বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ পাই স্যার পিএসসির চেয়ারম্যান থাকার সময় বিসিএস পরীক্ষার লিখিত মৌখিক পরীক্ষক হিসেবে তিনি আমাদের সংযুক্ত রেখে ভরসা পেতেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিএনএফের কখনো সাধারণ পরিষদের সদস্য, কখনো পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে এর প্রধান পরামর্শক ছিলেন এবং নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন বিএনএফ তাঁর মৃত্যুতে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত  হবে

স্যারের সঙ্গে কাজ করার কত স্মৃতি! ইআরডিতে তিনি আইয়ুব কাদরী স্যার অতিরিক্ত সচিব ছিলেন সচিব বিদেশে গেলে (মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দুই বছরের অ্যান্টিডেটেড সিনিয়রিটি পাওয়ার সুবাদে) সাদত স্যার চার্জে থাকতেন স্যার বরাবরই অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ, ম্যাথডিক্যাল মেটিকুলাস ছিলেন একটি গ্রুপ স্টাডিতে আমাদের পাঁচজন কর্মকর্তার বিদেশে যাওয়ার অনুমোদনের নথি আইয়ুব কাদরী স্যারের


হয়ে সাদত স্যারের কাছে গেল স্যার ধরলেন প্রশিক্ষণের সুযোগটি সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে ইআরডি বরাবর বরাদ্দ হয়ে আসতে হবে আমরা বিষটিকে নিতান্ত আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার ভেবেছিলাম এবং হাতে সময় কম, পরশু দিন আমাদের ফ্লাইট ধরনের আপত্তিতে আইয়ুব কাদরী স্যারের বিব্রত হওয়ার কথা, তিনি তাঁর ব্যাচমেট এবং অতি আপন সহকর্মী . সাদতের দৃঢ়তা সম্পর্কে জানতেন আমি দেখলাম তাঁরা উভয়ই ঠিক এবং এটা একটা মনোমালিন্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে তত্ক্ষণা ইআরডির চিঠি নিয়ে আমি বসাক (জেবি বসাক) এস্টাবলিশমেন্টে গেলাম আমাদের ফ্লাইট পরশু, চিন্তায় পড়লাম এস্টাবলিশমেন্ট যদি বরাদ্দের চিঠি দিতে বিলম্ব করে! আমাদের বিদেশ ভ্রমণের চেয়ে দুই অন্তরঙ্গ সিএসপি অফিসারের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের কী হবে! ভাগ্য ভালো, এস্টাবলিশমেন্টে গিয়ে পেয়ে গেলাম অতিরিক্ত সচিব আহসান উদ্দিন সরকারকে তিনি আমাদের অডিট সার্ভিসের এবং এই বরাদ্দ দেয়ার প্রধান ব্যক্তি তিনি ইআরডির চিঠির ওপরই লিখে দিলেন এবং বসাক নিজে টাইপ করে বরাদ্দের চিঠিতে স্যারের সই নিলেন এস্টাবলিশমেন্টের চিঠি নিয়ে  হাজির হলাম, আইয়ুব কাদরী স্যার মনে মনে খুশিই হলেন সাদত স্যারকে দেখালাম চিঠি, তিনি আমাদের কনগ্র্যাচুলেট করলেন এবং বললেন, মজিদ যত ছোট এবং আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার হোক না কেন, কখনো কোনো পদ্ধতি পরিপালনের ক্ষেত্রে তা উপেক্ষা করবেন না নীতি, নিয়ম পদ্ধতি যদি মেনে চলেন তাহলেই আপিনি সঠিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন এবং বিপদে উদ্ধারও পাবেন স্যারের সেই উপদেশ পালনে সচেষ্ট থেকেছি নব্বইয়ের দশকে এনবিআরের চেয়ারম্যান থাকাকালে স্যার এনবিআরে বসতেন না, বসতেন সচিবালয়ে বলতেন, আমি সচিব, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ আগে, এনবিআর পরে এনজিও ফাউন্ডেশনে একবার স্যারের সঙ্গে একটা বিষয়ে আমার মতদ্বৈধতা দেখা গেল স্যার চেয়ারম্যান, আমি এমডি, কী করা যায় সাহস করে বিষয়টি বোর্ডে তুললাম, সেখানে অনেকেই তাঁর সিনিয়র মৃদু অনুযোগের সুরে স্যার বললেন, মজিদ আপনি এটা বোর্ডে আনলেন কেন? শ্রদ্ধেয় মুয়ীদ চৌধুরী স্যার বিলক্ষণ বুঝলেন সাদত সাহেব মাইন্ড করেছেন, আমাকে তাত্ক্ষণিক সেভ করার জন্য মুয়ীদ চৌধুরী স্যার দায়িত্বটা নিজে নিয়ে বললেন, ‘এটা ওকে আমি তুলতে বলেছিবিষয়টি সামান্য কিন্তু আমি দেখি তাঁরা আমাদের মতো জুনিয়রদের কত স্নেহ করতেন পরিস্থিতি সামাল দিতে শেখাতেন

আমি তখন অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব, উন্নয়ন বাজেট বানানোর কাজ প্রায় শেষ বাজেটেরসংক্ষিপ্তসারপুস্তিকায় সেবারই প্রথম কোন খাতে কী বরাদ্দ ইত্যাদি প্রদর্শনের জন্য পাইচার্ট গ্রাফ সংযোজন করতে যাচ্ছি অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সাহেব মাঝে মাঝে জানতে চাইছেন, তোমার ওই কেক বানানো কদ্দূরতাঁর কাছে পাই গ্রাফের প্রয়াসটা অভিনব অর্থবহ মনে হচ্ছিল ঠিক সময় অর্থ সচিব জাকির আহমেদ খানকে ক্যাবিনেট সচিব সাদত স্যার ফোন করে জানতে চাইলেন, ‘মজিদ কোথায়?’ অর্থ সচিবকে কনফিডেনন্সিয়ালি জানালেন, এসবি রিপোর্ট দিয়েছে মজিদ কয়েকবার ফ্রান্সে গিয়েছে সে অর্থ মূর্তি পাচারের সঙ্গে জড়িত, সন্দেহ তাদের এটা খুব ভয়ংকর রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় সত্বর যোগাযোগ করে এফআইআর হওয়ার আগে বিষয়টি ক্লিয়ার হওয়ার দরকার সবার মুখ শুকিয়ে গেল কোথায় বাজেট  বানানো! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপরের দিকে জাকির স্যার বলে দিলেন আমি দৌড়ালাম আমার বা আমাদের ওপর সাদত স্যারের দৃঢ় বিশ্বাস স্নেহ ছিল বলে অমন একটা অতিগোপনীয় বিষয়ে আমাকে উদ্ধারে এগিয়ে এসেছিলেন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে তিনি প্রকৃতপক্ষে ছিলেন সিভিল সার্ভিস অফিসারদের  অভিভাবক সাদত  স্যারের  হস্তক্ষেপে একটা বড় বিপদ থেকে রেহাই পেলাম আসলে ব্যাপারটি হয়েছিল, সে সময় ফ্রান্সের সঙ্গে মূর্তি পাচারসংক্রান্ত একটা সমস্যা চলছিল বাংলাদেশের, ওয়েসিডির এইড হারমোনাইজেশন প্রকল্পে আমি ছিলাম এশীয় প্যাসিফিক অঞ্চলের হয়ে বাংলাদেশের ফোকাল পয়েন্ট, সে সুবাদে বছরে চারবার আমাকে প্যারিসে যেতে হতো আমার প্রত্যেকবার ভ্রমণের সময় ফরেন মিনিস্ট্রি নোট ভারবাল ইসু্যু করত এসবির লোকেরা ফরেন মিনিস্ট্রি থেকে নোট ভারবাল ইসু্যু সূত্রে অনুমান করেছে যে মোহাম্মদ আবদুল মজিদ যেহেতু বেশ কয়েকবার প্যারিসে গিয়েছেন... ধরনের সন্দেহ পোষণ রিপোর্ট করার জন্য সাদত স্যার সংশ্লিষ্টদের বকাঝকাসহ সতর্ক করে দিয়েছিলেন  তিনি আমাকে জানতেন বলে এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং অর্থ সচিবকে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন আমাদের জন্য সাদত স্যার, জাকির স্যারদের এমন অভিভাবকত্ব গ্রহণকে শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতায় রেখে দিয়েছি স্মৃতির ভাণ্ডারে আমি যখন জাপানে, কমার্শিয়াল কাউন্সেলর স্যার সরকারের পক্ষে একটা নেগোসিয়েশন সভায় যোগ দিতে টোকিওতে গিয়েছিলেন আমি স্যারের সঙ্গে ওইসিএফ অফিসে গেলাম, কয়েক ঘণ্টার বৈঠক, জাপানিরা সকালে যা বলবে, তাদের অবস্থান সারা দিন একই থাকবে, তাদের সঙ্গে হাজার তর্ক-বিতর্ক করলেও তাঁরা তাদের অবস্থানে অনড় স্যারও নাছোড়, কিন্তু  দু-এক জায়গায় দু-একটা শব্দের প্রতিশব্দ পাল্টানো ছাড়া তেমন কিছু করা যায়নি জাপানিদের এই অবস্থানকে স্যার প্রগাঢ় উপলব্ধিতে নেন বলেছিলেন, মজিদ আপনি ভাগ্যবান, জাপানিদের কাছ থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছুই এই তো সেদিন, স্যার আর আমি এসএ টিভিতে লেট এডিশন টকশোতে অংশ নিয়েছিলাম সেই শেষ দেখা  

 

. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫