মহামারীতে অভাবনীয় ধস বৈশ্বিক পণ্যবাজারে

প্রকাশ: এপ্রিল ২৫, ২০২০

বণিক বার্তা ডেস্ক

চলতি বছরের শুরু থেকেই নভেল করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপক ধসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক পণ্যবাজার। কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে জানুয়ারির দিকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আকস্মিক ছেদ পড়ে। অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসার পাশাপাশি মহামারী পরিস্থিতিতে ধস নামে পণ্যবাজারের চাহিদা সরবরাহ চেইনে। জানুয়ারি থেকেই বিশ্ববাজারে অধিকাংশ পণ্যের দাম পড়তির দিকে। বিশেষ করে পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট পণ্যের বাজারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

বিশ্বব্যাংকের চলতি মাসের কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক প্রতিবেদনেও বৈশ্বিক পণ্যবাজারের দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থাটির মতে, কভিড-১৯ মহামারীসৃষ্ট বৈশ্বিক স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থায় ব্যাপক সংকটের মোকাবেলা করতে হচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে। সর্বত্র একসঙ্গে প্রায় সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করে দেয়ার প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক পণ্যবাজারে। দুর্দশার চিত্র সামনের মাসগুলোয়ও অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পণ্যবাজারের চাহিদা সরবরাহ উভয়ের ওপরই মারাত্মক প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেছে মহামারী। ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া থামাতে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে লকডাউন কার্যকর করতে হয়েছে। ফলে পণ্যের সরবরাহ চেইন প্রায় ভেঙে পড়েছে। অন্যদিকে মহামারীর কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও মারাত্মক শ্লথ বা সংকুচিত হয়ে পড়েছে, যা পণ্যবাজারের ওপর পরোক্ষ প্রভাব ফেলেছে। একই সঙ্গে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ব।

বৈশ্বিক পণ্যবাজারের সম্ভাব্য ক্ষতির মাত্রা মহামারীর ভয়াবহতার মাত্রার ওপর নির্ভর করছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সংস্থাটি বলছে, একই সঙ্গে মহামারীর স্থায়িত্ব এবং বিশ্বব্যাপী এর মোকাবেলার পদ্ধতির ওপরও বাজারের ক্ষতির সম্ভাব্য মাত্রা নির্ভর করছে।

এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, বৈশ্বিক পণ্যবাজারের সরবরাহ চাহিদার গতিপ্রকৃতিতে স্থায়ী পরিবর্তন এনে দেয়ার সক্ষমতা কভিড-১৯-এর রয়েছে। বিশেষ করে উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভোক্তাদের হাত পর্যন্ত পণ্য পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর সরবরাহ চেইনটিও চিরতরে বদলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

পণ্যবাজারে এরই মধ্যে বেশ নাটকীয় প্রভাব ফেলেছে মহামারী, বিশেষ করে পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট পণ্যের ক্ষেত্রে। জানুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজার নিম্নমুখী রয়েছে। চলতি মাসেই বিভিন্ন সরবরাহ চুক্তিতে পণ্যটির দাম নেমে আসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এর মধ্যে কয়েকটি বাজার আদর্শে পণ্যটির মূল্য এখনো কমতির দিকেই রয়েছে।

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, চাহিদায় ব্যাপক হারে ধস নামার কারণেই অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজারে মূল্যপতন অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশগুলোর উত্তোলনে লাগাম টানা নিয়ে দেখা দেয়া অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। বৈশ্বিক পরিবহন (জল-স্থল আকাশ তিন  পথেই) খাতে ধস নামার কারণে চলতি বছর জ্বালানি তেলের দৈনিক চাহিদা কমতে পারে গত বছরের তুলনায় ৯৩ লাখ ব্যারেল। অন্যদিকে গত বছর পণ্যটির দৈনিক চাহিদা ছিল ১০ কোটি ব্যারেল।

জ্বালানি তেলের চাহিদা যেখানে কয়েক দশক ধরে কমবেশি বাড়তির দিকেই ছিল, সেখানে ধরনের পতন পণ্যটির বাজারে সন্দেহাতীতভাবে অভূতপূর্ব। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় মূল্য প্রতি ব্যারেল ৩৫ ডলারে নেমে আসার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সেক্ষেত্রে ২০১৯ সালের গড় মূল্যের তুলনায় ৪৩ শতাংশ কম হবে পণ্যটির চলতি বছরের গড় মূল্য। গত বছর আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কেনাবেচা হয়েছে ব্যারেলপ্রতি গড় ৬১ ডলার মূল্যে।

শুধু অপরিশোধিত জ্বালানি তেল নয়, পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট অন্য দুটি পণ্য প্রাকৃতিক রাবার প্লাটিনামেরও মূল্যে ধস নামিয়েছে নভেল করোনাভাইরাস।

জ্বালানি তেলের উত্তোলক-রফতানিকারক দেশগুলোর জোট অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজভুক্ত (ওপেক) দেশগুলো সম্প্রতি অন্য উত্তোলকদের সঙ্গে নিয়ে পণ্যটির উত্তোলন কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। চাহিদা কমে আসার প্রতিক্রিয়ায় উদ্যোগ নিয়েছিল দেশগুলো।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, জ্বালানি তেলের বাজারে বিদ্যমান চাপ প্রশমনের ক্ষেত্রে উদ্যোগ কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর কার্যকারিতা সংশ্লিষ্ট আরো অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে যেসব বিষয় উদ্যোগটির কার্যকারিতা নিরূপণে ভূমিকা রাখতে পারে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নতুন উত্তোলনকারী দেশের উত্থান, বিকল্প পণ্যের ব্যবহার, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের উত্তোলন সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। এর মধ্যে শেষোক্ত কারণটি এর আগে জ্বালানি তেলের বাজারের সর্বশেষ ধসে বেশ বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল।

আন্তর্জাতিক বাজারে গতকাল মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট বিক্রি হয়েছে প্রতি ব্যারেল ১৭ ডলারের একটু কম দামে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্ট কেনাবেচা হয়েছে প্রতি ব্যারেল ২১ ডলারের সামান্য বেশি মূল্যে।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর প্রাকৃতিক গ্যাস কয়লাসহ জ্বালানি পণ্যের গড় সার্বিক মূল্য কমবে গত বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ। যদিও আগামী বছর বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। জ্বালানি পণ্যগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম এরই মধ্যে ব্যাপক পতনের শিকার হয়েছে। তবে কয়লার ওপর বাজারের বর্তমান মন্দা পরিস্থিতির প্রভাব তেমন একটা পড়েনি। কারণ পণ্যটি ব্যবহার হয় মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে। অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মহামারীর প্রভাব পড়লেও বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত বেশ ভালোভাবেই সচল রয়েছে। 

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ছেদ পড়ার কারণে তামা দস্তার মতো শিল্পপণ্যের বাজারেও বেশ ধস নেমেছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস, চলতি বছর দুটিসহ ব্যবহারিক সব ধাতুরই সার্বিক মূল্যে বড়সড় ধরনের পতন ঘটবে। বিশেষ করে প্রধানতম ভোক্তাদেশ চীনের অর্থনীতির উল্টোগতি শিল্প ধাতুর বাজারকে মারাত্মক রকমে নিম্নমুখী করে তুলেছে।

প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাপী শিল্প ধাতুর মোট চাহিদার অর্ধেকই সরবরাহ হয় চীনের শিল্প-কারখানাগুলোয়। কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের কারণে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো ব্যাপক সংকুচিত হয়েছে চীনের অর্থনীতি।

অন্যদিকে স্বর্ণের বাজারে এখন ঊর্ধ্বগতি বজায় রয়েছে। মহামারীর কারণে আর্থিক বাজারের বিশৃঙ্খলায় পণ্যটির বিনিয়োগ চাহিদা এখন বেশ বাড়তির দিকে।

নিউইয়র্কের কমোডিটি এক্সচেঞ্জে (কোমেক্স) গতকাল জুনে সরবরাহের চুক্তিতে স্বর্ণের দাম বেড়েছে আউন্সে ১৩ ডলার। আগের দিনের চেয়ে দশমিক শতাংশ বেড়ে গতকাল এখানে মূল্যবান ধাতুটি বিক্রি হয়েছে প্রতি আউন্স হাজার ৭৫৮ ডলার ৪০ সেন্টে। ফ্যাক্টসেট ডাটার পরিসংখ্যান বলছে, গতকাল প্রায় শতাংশ ঊর্ধ্বমুখিতায় শেষ হওয়ার পথে ছিল পণ্যটির সাপ্তাহিক বাজার।

প্রসঙ্গত, সুদমুক্ত বিনিয়োগ হওয়ায় পুঁজিবাজারসহ আর্থিক বাজারের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে স্বর্ণের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। কারণ আপত্কালীন বিনিয়োগ হিসেবে সময় ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্যটির চাহিদা থাকে বাড়তির দিকে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কৃষিপণের বাজারের সম্পর্ক অন্যান্য পণ্যের তুলনায় কিছুটা কম। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বছরের শুরু থেকে পণ্যগুলোর বাজারে পতনের গতিও ছিল তুলনামূলক শ্লথ। তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল প্রাকৃতিক রাবার চালের বাজার। শুরু থেকেই ব্যাপক ধসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক রাবারের দাম। অন্যদিকে চালের দাম এখন বাড়তির দিকে। বৈশ্বিক ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি বাণিজ্যসীমার কারণে পণ্যটির বাজার এখন ঊর্ধ্বমুখী।

চলতি বছর বৈশ্বিক কৃষিপণ্যের বাজার তুলনামূলক অনেক বেশি স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করছে আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সংস্থা। কারণ প্রধান প্রধান খাদ্যশস্যের মধ্যে কয়েকটির উৎপাদন মজুদ এখন রেকর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।

খাদ্যপণ্যের অধিকাংশ বাজারেই সরবরাহ এখন পর্যাপ্ত। এর পরও বিভিন্ন দেশে নির্দিষ্ট কয়েকটি পণ্যের বাণিজ্য সীমিত বা নিষিদ্ধ করে দেয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে গেছে ভোক্তাদের অস্বাভাবিক ক্রয়প্রবণতা।

অন্যদিকে সার-কীটনাশকের মতো কৃষিতে অপরিহার্য পণ্যের বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি শ্রমিক সংকটে আসন্ন উৎপাদন মৌসুমে বিশ্বব্যাপী কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই। সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ায় উদীয়মান বাজার উন্নয়নশীল দেশ থেকে ফল, ফুল সবজির মতো পচনশীল পণ্যের রফতানিও এখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এছাড়া বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও রফতানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে খাদ্যপণ্যের আমদানিকারক দেশগুলোয় খাদ্যনিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অবস্থায় দেশে দেশে খাদ্যের অবাধ বাণিজ্য নিশ্চিত করার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সংস্থা।

বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, পণ্যবাজারে কভিড-১৯ মহামারীর কারণে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। এর কারণে সামনের দিনগুলোয় পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সীমান্ত অতিক্রমের বিষয়টি আরো শর্তযুক্ত হয়ে পড়তে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় পণ্যের পরিবহন খরচও বাড়তে পারে। বাণিজ্য ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষি খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি টেক্সটাইল পণ্য রফতানির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এছাড়া নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের মজুদপ্রবণতাও সামনের দিনগুলোয় বেড়ে যেতে পারে, যা বাণিজ্য প্রবাহে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে পণ্য আমদানিনির্ভর উদীয়মান বাজার উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি মহামারীর কারণে বেশ নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫