নিঃশব্দ শবযাত্রা ও ভাষাহীন আর্তনাদ

প্রকাশ: এপ্রিল ২৩, ২০২০

মো. সাইফুল ইসলাম মাসুম

বাঙালি আবেগের জাতি, ভালোবাসার জাতি। ভালোবাসা হূদ্যতায় জমে থাকা জীবন যখন একটি সময়ের শেষ বিন্দুতে থমকে দাঁড়ায় তখন অশ্রুসিক্ত আবেগময় বিদায় জানানো বাঙালি তথা মানবজাতির চিরচেনা সংস্কৃতি। মানুষের জীবন নাতিদীর্ঘ। স্বল্প জীবনের নানা প্রবাহে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় আরো অন্যান্য জীবন এবং প্রতিটা সম্পৃক্ততায় সৃষ্টি হয় আবেগ ভালোবাসাময় স্মৃতির। স্মৃতির টানেই মানুষ কষ্ট পায় প্রিয়জনের হঠাৎ প্রস্থানে কিংবা অকালপ্রয়াণে, হূদয়ের আঘাতে ক্রন্দনসিক্ত হয়। মানুষের প্রতি প্রিয়জনের টান, ভালোবাসা চিরায়ত শাশ্বত। তাই তো মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রিয়জন হারানোর শোকে। যে গৃহে কোনো মানুষ মারা যায়, সে গৃহে নেমে আসে শোকের মাতম, আহাজারি আর গগনবিদারী আর্তচিত্কার। মৃত্যু অবধারিত, একদিন মৃত্যুর কড়াল গ্রাস সবাইকেই গ্রাস করবেএতে কেনো সন্দেহ নেই এবং থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। কিন্তু অকালমৃত্যু অপ্রত্যাশিত মৃত্যু বড়ই বেদনাদায়ক।

কুল্লু নাফসিন যাইক্বাতুল মাউত’—সুরা আল ইমরান, আয়াত ১৮৫।

উপরে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে, যার অর্থপ্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে।ঐশী গ্রন্থ আল কোরআনের বাণী হলো সারা বিশ্বের প্রতিপালক, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বাণী। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ পাক সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন মৃত্যু সম্পর্কে। যিনি আমাদের স্রষ্টা, তারই ঘোষণা এটা। মৃত্যু অনিবার্য, আজ হোক, কাল হোক মৃত্যুর শিকল বেড়ি আমাদের পরতেই হবে। কিন্তু কেমন মৃত্যু? কেমন মর্মান্তিক মৃত্যুযাত্রা? কেমন শবযাত্রা, যে যাত্রায় কোনো সঙ্গী নেই? কেমন অন্তিম যাত্রা, যে যাত্রায় কোনো শ্রদ্ধার্ঘ্য নেই। কেমন চিরবিদায়, যেখানে প্রিয়জনকে শেষ দেখারও সুযোগ নেই? কেমন মরদেহের মিছিল, যেখানে মরদেহের কোনো সম্মানজনক শেষকৃত্য নেই? কেমন মরণযাত্রা, যেখানে সত্কারেও মানুষের তীব্র সন্দেহ ভয়। ভাইরাসের মরণছোবল আঘাত হানার ভয়ে আপনজন কাছে থাকে না। প্রিয়জন, যাকে ছাড়া একদিনও চলতে পারত না, ভাবতে পারত না, সেই প্রিয়জনকেও শেষ শ্রদ্ধাটুকু জানাতে আসে না মানুষ কেমন ওপারের যাত্রা

সারা বিশ্বে প্রায় একযোগে আঘাত হানা নভেল করোনায় যেমন করে তাজা প্রাণগুলো কেড়ে নিচ্ছে ভয়াবহ মৃত্যুথাবা, যেন মৃত্যুর মহোত্সব চলছে। একদিকে মানুষের আহাজারি, অন্যদিকে প্রকৃতির এমন রুষ্ট আচরণ। সব বৈষম্য ভুলিয়ে এক করে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। পৃথিবীটাকে একটা ভৌতিক ভূখণ্ডে পরিণত করেছে। পুরো পৃথিবী আজ একযোগে স্তব্ধ হয়ে গেছে। পৃথিবীর আকাশ-বাতাস গুমোট হয়ে আছে। শোকে মুহ্যমান বিশ্বের মানুষগুলো। পৃথিবীর বাতাসে লাশের গন্ধ। পৃথিবীর নিঃশ্বাসও আজ যেন বিষাক্ত হয়ে গেছে।

মৃত্যু তো একদিন হবেই, সেটা আমরা সবাই জানি। তাই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার প্রস্তুতি আমাদের সবারই থাকা উচিত।

কবি আল মাহমুদ তারস্মৃতির মেঘলাভোরেকবিতায় বলেছেন

কোন এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে

মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যদি দেয় তাগিদ

অপ্রস্তুত এলোমেলো গৃহের আলো অন্ধকারে

ভাল মন্দ যা ঘটুক মেনে নিব, আমার ঈদ।

মৃত্যু পৃথিবীর অবধারিত অকাট্য একটি বিধান। মৃত্যু শাশ্বত অমোঘ, মৃত্যুর মধ্য দিয়েই একটি জীবনের জাগতিক ব্যক্তিসত্তার অবসান কিংবা চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে। কিন্তু এই শাশ্বত মৃত্যুটা যদি এতটা হূদয়বিদারক হয়, তবে তা মানুষের হূদয়ে চিরস্থায়ী দাগ থেকে যায়। দাগ কোনো দিন মুছবে না। কিন্তু বিদায় মৃত্যু যদি এতটা নির্মমভাবে মানুষকে শেষ কান্নার সুযোগটাও না দেয়, তবে তা দুঃখের ইতিহাসে সুগভীরতম ক্ষতচিহ্ন এঁকে দেয়। এমন অমানবিক মৃত্যু আগে দেখেনি পৃথিবী। মানুষের ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, অবহেলায় কিংবা বাধ্য হয়ে এমন ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। করোনায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মরদেহটি যেন অচ্ছুত। হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে থাকা মরদেহও এখন স্বজনরা আনতে যায় না। অদ্ভুত সময়ের বিপরীতে চলছে পৃথিবী। অদেখা ভাইরাসে মরছে মানুষ। ছোঁয়াচে জীবাণুর কাছে বন্দি এখন সৃষ্টির সেরা জীব আশরফুল মাখলুকাত খ্যাত মানবজীবন। মৃত্যুর পরের মানবজীবনটাই একটা ইতিহাস। কিন্তু এমন ইতিহাস চাই না আর। যে মৃত্যুতে প্রিয়জন মরদেহ ফেলে দূরে চলে যায়, মায়ের মরদেহ জঙ্গলে ফেলে পালিয়েছে সন্তানএমন ঘটনাও ঘটেছে পৃথিবীতে। শেষকৃত্যেও অংশ নেয় না স্বজনরা। এমন দৃষ্টান্ত এখন অনেক দেখা যাচ্ছে। কেমন ইতিহাস!                                                      

কবি আল মাহমুদ তার সোনালী কাবিন কবিতায় লিখেছেন

প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ

মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস

যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন

তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।

কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের বিষাক্ত ছোবলে সহস্র প্রাণের অকালপ্রয়াণ ঘটছে মানবজীবনের বড্ড আকালে। মানবজীবনে এখন বড্ড বিভীষিকাময় সময় যাচ্ছে। অতি সন্তর্পণেই ঘটছে মানুষের শেষ বিদায়। কী নিষ্ঠুর পরিণতি? কেমন ভালোবাসাহীন চিরনিদ্রা? এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব দুর্নীতি দমন কমিশনের সম্মানিত পরিচালক জালাল সাইফুর রহমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের ফেসবুক পেজের একটি পোস্ট ছিল রকম:

কেমন মৃত্যু! যার মৃত্যুর সময় প্রিয়জন কেউ পাশে থাকতে পারে না।

কেমন মৃত্যু! যার মৃত্যুর পর প্রিয়জনরা শেষবারের মতো তার মরা মুখটা দেখতে পারে না।

কেমন মৃত্যু! যার পরিবার তাকে ছুঁয়ে কান্না করতে পারে না।

কেমন মৃত্যু! যার জানাজায় পরিবার-পরিজন-প্রিয়জনরা কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে না।

কেমন মৃত্যু! যার মরদেহ কবরে নামানোর জন্য পরিবারের কেউ থাকে না।

কেমন মৃত্যু! প্রিয়জনরা শবযাত্রায় অংশ নিতে পারে না।

উল্লিখিত লাইনগুলো তার মৃত্যুর সংবাদটি তোলপাড় তুলেছিল বিশ্বের মানুষের হূদয়ে। এমনকি মরহুমের মরদেহ বিকালে আজিমপুর গোরস্তানে দাফন করা হয়েছে। তার পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের ষোলশহরেও তার মরদেহ নেয়া হয়নি। ভগ্নহূদয়ে বাঙালির প্রাণে গুঞ্জরিত হয়েছিল শোকের মাতম। বাংলাদেশের মানুষ বড্ড আঘাত পেয়েছিল এমন মৃত্যুতে। রকম মৃত্যুর ঘটনা ইউরোপ, আমেরিকায় অহরহ। বাংলাদেশেও আরো অনেক ঘটেছিল, ঘটেছে এবং ঘটছে অনবরত। করোনায় মৃত প্রতিটি শবযাত্রার পরিণতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনই করুণ।

বিশ্বমানবতা আজ গুমরে গুমরে কাঁদছে। চারদিকে লাশের মিছিল দেখে আর্তনাদ উঠেছে। মরণঘাতী করোনাভাইরাসের ভয়াবহ ছোবলে আজ হাজারে হাজারে মানুষ মরছে বিশ্বজুড়ে। মৃত ব্যক্তির সত্কার করার লোকও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। কে হবে আগুয়ান এমন ভয়ংকর সংক্রামকের কাছে? মরদেহও কি ছোঁয়াচে? বিষয়টি নিয়ে এখনো ধুম্রজাল আছে। মরদেহের কাছেও যাচ্ছে না এখন আপনজন। ফলে অধিকাংশ মরদেহই এখন নিষ্ঠুরভাবে দাফন করা হচ্ছে। করোনায় মারা যাওয়া মানুষদের নিয়ে সারা বিশ্বে এমনকি বাংলাদেশেও ঘটছে একাধিক মর্মস্পর্শী ঘটনা।

এপ্রিল ভোরে রাজধানীর কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে মারা যাওয়া দুদক পরিচালক উপসচিব জালাল সাইফুর রহমানকে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজা দাফনকালে তার কিছু সহকর্মী মারকাজুল ইসলামের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীকে দেখা যায়। তার কোনো আত্মীয়স্বজন জানাজায় উপস্থিত হতে পারেননি, এমনকি তার মরদেহখানিও পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের ষোলশহরে নেয়া হয়নি (তথ্যসূত্র: জাগোনিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম, তাং: এপ্রিল ২০২০) ঘটনাটি কতটা মর্মান্তিক!

বার্তা সংস্থা এপির ক্যামেরায় ধরা পড়েছে এমন একটি ঘটনা, যা ঘটেছে ভারতে। এক নারীর মরদেহ বহনকারী ভ্যানটি কবরস্থানের একবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছলে  ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে এসে মুখোশ রাবারের গ্লাভস পরা চারজনকে ডাকলেন। তারা হলুদ রঙের একটি প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে ঢাকা মরদেহটি টেনে নিয়ে চুপ করে রইল। একটু দূরেই রাখা একট আর্থ রিমুভার  দিয়ে মাটি খুঁড়ে কোনো রকমে দড়িতে মরদেহটি বেঁধে টেনে সেই গর্তে পুঁতে ফেলা হয়। নারীর মাত্র চারজন পুরুষ প্রতিনিধি এসে আর্থ রিমুভারের চোয়ালটি দিয়ে কবরের গর্তটাও করল। মনে হচ্ছে যেন একটি ময়লার গর্তে মরদেহ পুঁতে ফেলা হয়েছে। এরপর সাইরেন বাজিয়ে সেই ভ্যানটি আবার চলে গেল। কারণ সেখানে আরো তিনটা মরদেহ আছে। আনতে হবে গোরস্তানে।

এভাবেই ঘটছে প্রায় সারা বিশ্বে রকম অসংখ্য ঘটনা। ইতালির মরদেহ বোঝাই করা ট্রাকের সারি দেখলে মনে হবে কোনো ফিল্মের দৃশ্য। কিন্তু না, সেগুলো মানুষের শবদেহ। এসব শবদেহ নিয়ে দূরে কোথাও নিয়ে মাটিচাপা দেয়া হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ থেকে ড্রোনের সাহায্যে তোলা হয় গণকবরের ছবি, যে ছবি ভাইরাল হয় সারা দুনিয়ায়। ট্র্যাজেডি যেন বিশ্বের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। পত্রিকায় এসেছে, ফেসবুকে সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি নভেল করোনাভাইরাসের সর্বনাশা দিকগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রিয়জনের সঙ্গে শেষ দেখারও অনুমতি মেলে না অনেক ক্ষেত্রে। যে হাত ভালোবাসার পরশ বুলায়, সে হাতই আজ সবচেয়ে বড় শত্রু। সে হাতের মাধ্যমে ছড়াতে পারে মরণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস। সেই ভালোবাসার মোলায়েম পরশ দেয়া হাতে হাত বুলানো স্বামী বা সংসারের এত প্রিয় একজন ব্যক্তির মৃত্যুতেও কাছে যাওয়া যাবে না, ছুঁয়ে দেখা যাবে না, শেষ স্পর্শটুকুও করা যাবে না কেমন নিষ্ঠুর মরণব্যাধি?

এখনো বাংলাদেশে বহু ঘটনার নজির মেলে রকম যে করোনায় হাসপাতালে প্রিয়জন মরদেহ নিতে আসেনি। এমনকি দেখতেও আসেনি। বাবার মরদেহ সন্তান কাঁধে নেয়নি। স্বামীর মৃত্যুতে কাছে যেতে পারছেন না প্রিয়তমা স্ত্রী। কেমন মৃত্যু! আমাদের দেশের মানুষ তো এমন ছিল না। ভালোবাসা হূদ্যতাপূর্ণ শেষ বিদায় হতো। কিন্তু আজ কী দৃশ্য দেখছে মানুষ! হাসপাতাল থেকে মরদেহ একটি মাইক্রোবাসে করে খিলগাঁও তালতলা গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটি কাপড়ের টুকরায় চার কোনায় ধরে নামায় স্বেচ্ছাসেবীরা। কোনো খাটিয়া বা কফিনও ব্যবহার করা হচ্ছে না। এমনকি মরদেহটাকে মাটিতে শুইয়ে রেখে যত দ্রুত সম্ভব ওই স্বেচ্ছাসেবীরাই জানাজা পড়ে মাটির প্রকোষ্ঠে পুঁতে দিচ্ছে। এখনো বাংলাদেশে গণকবরের দৃশ্য মেলেনি, তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে সেটিও দেখব হয়তো নিকট ভবিষ্যতে, যদি করোনা আক্রান্তের গ্রাফটা এভাবে ঊর্ধ্বগামী হতে থাকে। সেদিন একটি ভিডিও দেখলাম যে একটি মাইক্রোবাস থেকে মরদেহ নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে খিলগাঁও গোরস্তানের ভেতর। স্বেচ্ছাসেবীরা জানাজায় দাঁড়িয়ে গেছে। পেছন থেকে দৌড়ে পৌঁছলেন মরহুমের ছেলে। হায়রে অভাগা পিতা কিংবা অভাগা ছেলে। আবারো আমার প্রশ্ন কেমন মৃত্যু? কেমন শেষ বিদায় হে বিধাতা? কাকে দুষবে মানুষ এক্ষেত্রে? কে দুষবে? সবার অবস্থাই তো প্রায় এক রকম। 

আমাদের চোখ-কান সয়ে গেছে। আমাদের হূদয় কান্নায় বরফজমা পাহাড় হয়ে গেছে।  আমাদের যেন আর খারাপও লাগে না। দেখতে দেখতে মেনেই নিয়েছি যে এভাবেই হয়তো আমারও মৃত্যু হবে এবং প্রিয়জন কাছে যেতে পারবে না। অনেকে হয়তো শেষ দেখাটাও দেখতে পাবে না। জানি না, কী লেখা আছে ললাটে? বিষাদে ছেয়ে গেছে চারপাশ। ভাবতেই কান্না আসছে দুচোখ বেয়ে।

অথচ বাংলাদেশের মানুষের শেষকৃত্য কতটাই না শ্রদ্ধা আবেগঘন। কান্নায় শুকিয়ে যায় প্রিয় পরিজনদের অশ্রুজল। তার পরও আহাজারি। শ্রদ্ধার ফুলে ভরে যায় চারপাশ। নীরব দাঁড়িয়ে থাকে পাড়ামহল্লার শোকার্ত মানুষগুলো। বন্ধু  মহলেরও আহাজারি। অথচ আজ কেউ পাশে থাকে না। কী আশ্চর্য মৃত্যু। শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় বিনম্র সম্মানে নিজ ঘর থেকে বের হয় মরহুমের নিথর দেহখানি খাটিয়ায় চারজনের কাঁধে সওয়ার হয়ে। অথচ আজ কাগজের ঠোঙার মতো করে মরদেহ কোনো রকমে দাফন করে আসা হয়। প্লাস্টিকের মোড়ানো বা সেলাই করা থলেতে জায়গা হয় মরদেহের। কোথায় মুর্দাখাট আর কোথায় বা টুপি মাথায় বহনকারী মুসল্লি? কোথায় প্রিয়জন, কোথায় পরিজন? কেমন নিস্তব্ধ মহাকালের অনন্ত যাত্রা! হায়রে মানবতা। কত মরদেহ পড়ে থাকে বারান্দায়, কত প্রিয়জনের মরদেহ অচ্ছুত পড়ে থাকে অথচ করোনা সংক্রমণের ভয়ে কোনো প্রিয়জন কাছে যায় না, শেষ শ্রদ্ধাটুকুও জানাতে যায় না। শেষমেশ ভালোবাসার চিরবিদায়টুকুও হয় না। মানবতা আজ বিপন্ন। ঘুণে ধরেছে মানবতার দেয়ালে। সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। গোটা বিশ্বেও বৈশ্বিক পরিস্থিতিটাই বদলে গেছে।

অথচ কী চমত্কার ছিল মানবিক বন্ধন! এক জীবনে কত রকমের বিদায় দিতে হয় আমাদের। একটি চিরবিদায় দর্পণের মতো পেছনে ফেলে আসে কত স্মৃতি, কত ছবি, কত দৃশ্যপট, কত চেনা-অচেনা মুখ, মুখপানে চেয়ে থাকা কত নীরব চাহনি, কত হাসি, কত গান আর কত শত সহস্র বলা না-বলা কথা! হায়রে ভালোবাসা! কোথায় হারাল এত সব মায়ার বাঁধন?

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়

দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, বেলা দ্বিপ্রহর,

 হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হইতেছে প্রখর,

জনশূন্য পল্লীপথে ধূলি উড়ে যায়,

মধ্যাহ্ন বাতাসে...

অনন্ত চরাচরে সবচেয়ে পুরাতন কথা,

সবচেয়ে গভীর ক্রন্দন-

যেতে নাহি দিব হায়

তবু যেতে দিতে হয় তবু চলে যায়।

নিউইয়র্কে দেখেছি তৃষা নামক এক বাংলাদেশী তরুণীর মরদেহ ক্রেন দিয়ে নামানো হচ্ছে কবরে। আহ! কত মর্মান্তিক। ট্র্যাজেডি আর কত? কেমন করে সইবে তৃষার পরিবার দৃশ্য? এর কি কোনো সমাপ্তি নেই? সেই কবে থেকে গুমোট হয়ে আছে পৃথিবীটা। আমাদের হূদয়গুলো মরে গেছে। শুকনো পাতার মতো যেন চৌচির হয়ে গেছে। প্রকৃতির অভিমান ভাঙবে কবে? আমাদের ওপর রুষ্ট প্রকৃতি কবে আবার সদয় হবে? প্রকৃতির অভিমান পৃথিবীর কোনো শক্তি দিয়ে ভাঙা যাবে না। জগতের মস্ত বড় বড় দেশ আজ স্তব্ধ হয়ে গেছে। বিশ্ব চালায় যারা, তারাই আজ সবচেয়ে বেশি অসহায়। প্রকৃতির কাছে আমাদের আত্মসমর্পণই হয়তো আমাদের ওপর প্রকৃতির অভিমান ভাঙতে পারে। মরদেহের সারি আর মৃত্যুর মিছিল আমাদের শেষ করে দিয়েছে। আমাদের অর্ধমৃত করে দিয়েছে। আমাদের জীবনে কালো মেঘের ঘনঘটা হয়তো একদিন চলে যাবে, হয়তো কোনো একদিন স্বচ্ছাকাশে আবারো রোদ ঝিলমিল করবে কিন্তু ততদিনে শেষ হয়ে যাবে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ। 

আজ  বারবার মনে পড়ছে এই গানটি

খেলিছ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।

প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে।

শূন্যে মহা আকাশে

মগ্ন লীলা বিলাসে,

ভাঙ্গিছ গড়িছ নিতি ক্ষণে ক্ষণে।

তারকা রবি শশী খেলনা তব, হে উদাসী,

পড়িয়া আছে রাঙা পায়ের কাছে রাশি রাশি।

নিত্য তুমি, হে উদার

সুখে দুখে অবিকার,

হাসিছ খেলিছ তুমি আপন মনে।

এমন মৃত্যু আর চাই না প্রভু। হে বিধাতা, তুমি আমাদের মুক্তি দাও। মুক্তি দাও বিশ্বমানবতাকে। চারদিকে মরদেহ দেখতে দেখতে  আমরাও  মরে গেছি প্রায়। আর এমন মৃত্যু চাই না। এমন ট্র্যাজেডি বড় ভয়ংকর। আর পারছি না নিতে। প্রিয়জনের নিঃশব্দে চলে যাওয়া, প্রিয়জনের নিঃসঙ্গ শবযাত্রা, ভালোবাসা শ্রদ্ধাবিহীন শেষ বিদায়। সন্তান হয়ে সইতে পারব না জীবনের বটবৃক্ষ, সর্বোচ্চ ছায়ার আশ্রয় বাবার এমন সন্তর্পণে ওপারে চলে যাওয়া, সন্তান হয়ে সইতে পারব না গর্ভধারিণী মায়ের শেষ শ্রদ্ধাবিহীন সত্কার, বাবা হয়ে সইতে পারব না প্রাণের স্পন্দন প্রিয় সন্তানের অভিমানী প্রস্থান, ভাই হয়ে সইতে পারব না জীবনের অন্যতম অকৃত্রিম বন্ধু বোনদের নিঃশব্দে অকালপ্রয়াণ, স্বামী হয়ে সইতে পারব না প্রিয়তমা স্ত্রীর মহাকালের অনন্ত যাত্রা নিঃশব্দে চলে যাওয়া। বন্ধু হয়ে সইতে পারব না প্রিয় কোনো বন্ধুর নিঃসঙ্গ শেষ যাত্রা। হে প্রভু, তুমি শোনো আমার ভাষাহীন আর্তনাদ, হূদয়ের গুমোট কান্না আর শব্দহীন অন্তরের স্তব্ধ আহাজারি। 

লেখক: ব্যাংকার প্রাবন্ধিক


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫