করোনা পরিস্থিতিতে যেমন চলছে এফএমসিজির ব্যবসা

প্রকাশ: এপ্রিল ০২, ২০২০

মেহেদী হাসান রাহাত

দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) রোগী শনাক্তের ঘোষণা আসে গত মার্চ। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ বেড়ে যায় কিছু পণ্যের চাহিদা। খাদ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য মুদি দোকান সুপারশপগুলোয় হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। অস্বাভাবিক বিক্রি বেড়ে যায় কিছু ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডসের (এফএমসিজি), যেমনচাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, নুডলস, সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন জীবাণুনাশক। আবার কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এর উল্টো চিত্রও দেখা দিয়েছে। ব্যাপক হারে কমে গিয়েছে আইসক্রিম কিছু প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বিক্রি। সব মিলিয়ে পণ্যভেদে তেজি মন্দা উভয় অবস্থাই বিরাজ করছে এফএমসিজির বাজারে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের ঘোষণা আসতে পারে এমন চিন্তা থেকে ঘরে খাদ্য মজুদ শুরু করে মানুষ। বিশেষ করে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রবণতা ছিল চোখে পড়ার মতো। এতে হঠাৎ করে বিক্রি বেড়ে যায় বেশকিছু এফএমসিজি পণ্যের। সুযোগ বুঝে কয়েক দিন দামও বাড়িয়ে দেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।

নিয়েলসনের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালে দেশে এফএমসিজির বাজার ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ৪৯ শতাংশ আর খাদ্যপণ্য ৪৮ শতাংশ। দেশের এফএমসিজি পণ্যের প্রস্তুত বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কোম্পানি হচ্ছেফুড বেভারেজ খাতের একমি এ্যাগ্রোভেট অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, এসিআই ফুডস লিমিটেড, আকিজ ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, বিডি ফুডস লিমিটেড, আড়ং, বসুন্ধরা ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বোম্বে সুইটস অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড, কোকোলা ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড, গোল্ডেন হার্ভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, গ্লোব সফট ড্রিংক লিমিটেড, হক গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইফাদ ফুডস লিমিটেড, ইস্পাহানী ফুডস লিমিটেড, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, নেসলে বাংলাদেশ, নিউজিল্যান্ড ডেইরি প্রডাক্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, নাবিস্কো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ফ্যাক্টরি লিমিটেড, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, পারটেক্স বেভারেজ লিমিটেড, পারফেটি ভ্যান মিলে প্রাইভেট লিমিটেড, প্রমি এগ্রো ফুডস লিমিটেড, স্কয়ার ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ, সজিব গ্রুপ, ট্রান্সকম বেভারেজ ইগলু। তামাক খাতে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড (বিএটিবিসি) ঢাকা টোব্যাকো লিমিটেড। গৃহস্থালি সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদন বিপণন করছে ইউনিলিভার, রেকিট বেনকিজার, কোহিনূর কেমিক্যাল, স্কয়ার টয়লেট্রিজ, এসিআই লিমিটেডসহ আরো বেশকিছু কোম্পানি। চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠানের বেশকিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেছে। আবার কিছু পণ্যের চাহিদা কমেছেও। 

দেশে এফএমসিজি পণ্যের বাজারে অন্যতম অংশীদার ইফাদ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইফাদ মাল্টি প্রডাক্টস। বাজারে তাদের সরবরাহ করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে ইফাদ আটা, ময়দা, সুজি, বিস্কুট, নুডলস, চিপস কেক। করোনার কারণে এফএমসিজি ব্যবসায় কী ধরনের প্রভাব পড়েছে জানতে চাইলে ইফাদ মাল্টি প্রডাক্টসের পরিচালক তাসকিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় মৌলিক পণ্য খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুসরণ করেই আটা, ময়দা, নুডলস বিস্কুটের কারখানা চালু রেখেছি। আমাদের কাছে যে পরিমাণ কাঁচামাল মজুদ রয়েছে, তাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে আরো এক মাস পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে চাহিদা না থাকায় চিপস কেকের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে বলে জানান তিনি।

করোনাভাইরাস সংকট দীর্ঘায়িত হতে পারে এমন শঙ্কায় মানুষের মধ্যে আটা, ময়দা, সুজি, তেল, চিনি এসব পণ্য কেনার প্রবণতা বেড়েছে। দেশের বাজারে আটা, ময়দা, সুজি বিপণনে শীর্ষ তিন প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ টিকে গ্রুপ। গত কয়েক দিনে সবকটি প্রতিষ্ঠানেরই ব্যবসা অনেক বেড়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। 

দীর্ঘ সময়ের সাধারণ ছুটি চলছে দেশে। সময় বাড়িতে থাকার কারণে মানুষের মধ্যে স্ন্যাকস জাতীয় বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেছে। তালিকার শীর্ষে রয়েছে নুডলস। দেশের নুডলসের বাজারে শীর্ষ তিন প্রতিষ্ঠান নেসলে বাংলাদেশ, কোকোলা প্রাণ ফুডস। তাদের প্রত্যেকের নুডলস চাহিদা অনেক বেড়েছে। 

বাজারে সেপনিল ব্র্যান্ডের স্যানিটাইজার হ্যান্ডওয়াশ বিক্রি করে থাকে স্কয়ার টয়লেট্রিজ। দেশে করোনাভাইরাস আতঙ্ক শুরু হওয়ার পর থেকেই কোম্পানিটির স্যানিটাইজার পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেছে। তবে কাঁচামাল স্বল্পতা নির্দিষ্ট মাত্রার উৎপাদন সক্ষমতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত স্যানিটাইজার সরবরাহ করতে পারছে না বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তাছাড়া স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস জার্মিসল নামে হ্যান্ড রাব উৎপাদন বিপণন করে থাকে। করোনাভাইরাসের কারণে প্রতিষ্ঠানটির পণ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে গেলেও সে তুলনায় সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

বাজারে জীবাণুনাশক হিসেবে রেকিট বেনকিজারের ডেটল একটি সুপরিচিত ব্র্যান্ড। করোনাভাইরাসের কারণে বাজারে পণ্যটির অত্যধিক চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু কাঁচামালের পর্যাপ্ততা বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা না থাকার কারণে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চাহিদা অনুসারে বাজারে ডেটলের সরবরাহ করতে পারছে না কোম্পানিটি।

দেশে ক্লিনজেল হ্যাক্সিসল নামে হ্যান্ড স্যানিটাইজার হ্যান্ড রাব উৎপাদন বিক্রি করে এসিআই লিমিটেড। তাছাড়া স্যাভলন ব্র্যান্ডের জীবাণুনাশকও বিক্রি করে তারা। করোনাভাইরাসের কারণে কোম্পানিটির স্যানিটাইজারের চাহিদা এখন আকাশচুম্বী। এমনকি প্রথমদিকে অনেক ক্রেতাই আতঙ্কিত হয়ে একসঙ্গে অনেক বেশি স্যানিটাইজার কিনে মজুদ করেছেন। ফলে অনেকেই প্রয়োজনীয় স্যানিটাইজার কিনতে পারেননি। সবাই যাতে পান সেজন্য এসিআইয়ের পক্ষ থেকে জনপ্রতি একটি করে স্যানিটাইজার বিক্রির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে খুচরা বিক্রেতাদের।

এসিআই কনজিউমারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর বলেন, আমাদের অন্যান্য কনজিউমার পণ্যের ব্যবসায় তেমন কোনো হেরফের হয়নি। তবে স্যাভলনসহ স্যানিটাইজেশন পণ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু চাইলেই তো আর হুট করে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো যায় না। তাছাড়া কাঁচামালের সংকটও রয়েছে। ফলে আমরা চাহিদা অনুযায়ী স্যানিটাইজেশন পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। তাছাড়া পণ্য সরবরাহের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ট্রাক পাওয়া যাচ্ছে না।

সংকট আরো দীর্ঘায়িত হলে পণ্য উৎপাদন সরবরাহ ঠিক রাখা সম্ভব হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা চীন সিঙ্গাপুর থেকে কাঁচামাল আনার জন্য এলসি খুলেছি। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতেও আমরা মানুষকে পণ্য সরবরাহ করতে পারব। স্যানিটাইজার পাওয়া না গেলে স্যাভলন অ্যান্টিসেপটিক সাবান দিয়ে হাত ধুলেও জীবাণুমুক্ত থাকা যায় বলেও জানান তিনি।

বিস্কুটের বাজারে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। করোনাভাইরাসের প্রভাবে পণ্য পরিবহন করা নিয়ে সমস্যায় পড়েছে কোম্পানিটি। জানতে চাইলে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের নির্বাহী পরিচালক কোম্পানি সচিব মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, সার্বিকভাবে আমাদের ব্যবসা ভালো চলছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পণ্য পরিবহনের জন্য আমরা পর্যাপ্ত ট্রাক পাচ্ছি না। ফলে কারখানায় অনেক বেশি পণ্য স্টক হয়ে গেছে। কারণে গতকাল থেকে বাধ্য হয়ে উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তবে আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা এখনো চালু রয়েছে এবং বাজারে পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত কাঁচামাল মজুদ আছে। ফলে সংকট আরো দীর্ঘায়িত হলেও কোনো সমস্যা হবে না বলে আশা করছি।

দেশের বাজারে আইসক্রিমের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের হিমায়িত খাদ্য ডোমিনোজ পিত্জার ব্যবসা করছে গোল্ডেন হার্ভেস্ট এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ রাজীব সামদানী জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে আইসক্রিমের বিক্রি একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তবে হিমায়িত খাদ্যপণ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। আমরা চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। অনলাইনে ডোমিনোজ পিত্জার বিক্রিও বেশ বেড়েছে। কারণে আমরা অনলাইনে পিত্জা বিক্রির পরিধিও আগের তুলনায় বাড়িয়েছি।

স্কয়ার ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ বাজারে বিভিন্ন ধরনের মসলাসহ খাদ্যপণ্য বিক্রি করে থাকে। রাঁধুনী, রুচি, চপস্টিক কোম্পানিটির অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড। স্কয়ার ফুডস অ্যান্ড বেভারেজের সিনিয়র মার্কেটিং ম্যানেজার ইমতিয়াজ ফিরোজ জানান, সবার মতোই বর্তমানে আমাদেরও পণ্যের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদের কাছে পর্যাপ্ত কাঁচামালও রয়েছে। ফলে গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহে সমস্যা হবে না।

তামাকপণ্যের ব্যবসায়ও করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দেশের তামাকপণ্যের বাজারে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড (বিএটিবিসি) বিএটিবিসির কোম্পানি সচিব মো. আজিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে সীমিত আকারে আমরা উৎপাদন চালু রেখেছি। তবে দেশব্যাপী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। ফলে খুচরা পর্যায়ে আমাদের বিক্রিতে প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া সংকটকালে সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখাটাও একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা বাসায় থেকেই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালু রেখেছি। কারখানার শ্রমিক কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যথাযথ স্যানিটাইজেশন সুবিধাসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫