নয় মাস ধরে ভর্তুকি বন্ধ কৃষি যান্ত্রিকীকরণে

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২০

নিজস্ব প্রতিবেদক

কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি সহায়তা কার্যক্রম শেষ হয়েছে গত বছরের জুনে। এ সহায়তা কার্যক্রম ধরে রাখতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ৪০০ কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে ১০০ কোটি টাকার অনুমোদন পাওয়া গেলেও এ অর্থের ছাড়করণ শুরু হয়নি এখনো। নয় মাস ধরে ভর্তুকি সহায়তা বন্ধ থাকায় স্থবির হয়ে পড়েছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অগ্রগতি।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে কৃষি যন্ত্রপাতির বিক্রি তেমন একটা নেই। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও এতে অর্থায়নে তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। সরকারি সহায়তা না পেলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে।

এ বিষয়ে এগ্রিকালচারাল মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এএমএমএবি) সভাপতি ও আলীম ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলীমুল এহছান চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, দেশী উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে সবাই এক ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছেন। চলতি অর্থবছরে বোরো মৌসুমের সময় অতিবাহিত হলেও কৃষি যন্ত্রপাতির বিক্রি তেমন একটা নেই। পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও এ খাতে গুরুত্বসহকারে ঋণ বিতরণ করছে না। ফলে কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবহারের উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও প্রস্তুতকরণে এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে অর্থায়ন প্রয়োজন। সরকার সহায়তা না দিলে এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতা নেমে আসবে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত আমন মৌসুম শুরুর আগে সেপ্টেম্বরে কৃষি সচিব বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক। চিঠিতে রাজস্ব বাজেটের আওতায় কৃষি ভর্তুকি খাত থেকে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। ডিএইর চিঠি পাওয়ার পর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা চেয়ে একটি চিঠি অর্থ সচিব বরাবর পাঠান কৃষি সচিব। বিষয়টিতে সাড়া দিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা চেয়ে পাঠায় কৃষি মন্ত্রণালয়।

জবাবে একটি খসড়া নীতিমালা সংযুক্ত করে অর্থ ও মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠান কৃষি সচিব। মন্ত্রিসভা কমিটিতে সে নীতিমালা অনুমোদিতও হয়। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বাবদ ১০০ কোটি টাকার কিছু বেশি পরিমাণ অর্থ ছাড়ের অনুমোদন দেয়া হয়। কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে ত্বরান্বিত করতে হলে এ পরিমাণ বরাদ্দ যথেষ্ট নয় বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন খাতসংশ্লিষ্টদের অনেকেই।

বিষয়টি নিয়ে হতাশার কোনো কারণ নেই বলে জানালেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কৃষি ব্যবস্থাকে বহুমুখীকরণ করতে চায় সরকার। এজন্য উচ্চমূল্যের ফসল আবাদের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সেখানে যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা থোক বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। আমরা প্রায় ৪০০ কোটি টাকা চেয়েছিলাম। মন্ত্রণালয় থেকে ১০০ কোটি টাকার কিছু বেশি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সেটিকে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবহার করব। মাঠ পর্যায়ে যে চাহিদা তৈরি হয়েছে, সেগুলো মেটানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। তবে এ টাকা খরচ করতে পারলে বরাদ্দ আরো বাড়বে। মন্ত্রণালয় থেকে সে ধরনের নির্দেশনাই দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, দেশে ট্রাক্টর ব্যবহার হচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার। পাওয়ার টিলার ব্যবহার হচ্ছে প্রায় সাত লাখ। এসব যন্ত্রের মাধ্যমে মাটি কর্তনের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যবহূত কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের চাহিদা রয়েছে এক লাখের বেশি। কিন্তু দেশে ব্যবহার হচ্ছে ১ হাজারেরও কম। আর ধান বীজ বোনার জন্য রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টারের প্রয়োজন দুই লাখ। অথচ এ যন্ত্রটিরও ব্যবহার হচ্ছে এক হাজারেরও কম। এছাড়া ধান কাটার যন্ত্র রিপারের চাহিদা এক লাখ হলেও দেশে এ যন্ত্র রয়েছে পাঁচ হাজার। ধান বোনার জন্য পিটিও সিডার আছে মাত্র আড়াই হাজার। দেশে এ যন্ত্রের চাহিদা রয়েছে এক লাখ।

কৃষকরা বলছেন, একটি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের দাম ২৫-৩০ লাখ টাকার মধ্যে। বপন ও কর্তন যন্ত্রের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকদের জন্য সেগুলো কেনা বেশ কষ্টসাধ্য। সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়ায় কৃষকদের মধ্যে এ নিয়ে কিছুটা আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেটিও গত নয় মাস ধরে বন্ধ।

অন্যদিকে কৃষি যন্ত্রের বিক্রিতেও এখন বড় ধরনের ভাটা পড়েছে বলে জানালেন বিপণনকারীরা। তারা বলছেন, কিছু মাঝারি ও হালকা কৃষিযন্ত্রের বিক্রি হলেও বড় কৃষিযন্ত্র বিক্রি প্রায় শূন্যের কোটায় পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) তথ্য অনুযায়ী, চাষাবাদে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার উৎপাদন খরচ কমানো ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া ট্রাক্টর ও কম্বাইন্ড হারভেস্টর সময় বাঁচানোতেও কার্যকর। কম্বাইন্ড হারভেস্টারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে ধান কাটা, মাড়াই, পরিষ্কার ও প্যাকেটজাত করা যায়। এর সঠিক ব্যবহারে একরপ্রতি কৃষি উৎপাদন খরচ ৫ হাজার টাকা থেকে মাত্র দেড় হাজার টাকায় নামিয়ে আনাও সম্ভব।

এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, কয়েক দশকের ব্যবধানে কৃষিতে বেড়েছে শ্রমিক সংকট, তেমনি ধারাবাহিকভাবে কমছে কৃষি জমি। এ অবস্থায় বাড়তি মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণের পাশাপাশি শ্রম ও সময় সাশ্রয়ের জন্য কৃষি যন্ত্রপাতির গুরুত্ব বাড়ছে। তবে সেটি করতে হলে প্রয়োজন কৃষি যন্ত্রগুলোকে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা। সেজন্য প্রয়োজন ভর্তুকি সহায়তা। সার্বিকভাবে কৃষিতে শ্রমিকসংকট ও উৎপাদন বাড়াতে যান্ত্রিকীকরণের স্বার্থেই অর্থের বরাদ্দ উন্মুক্ত রাখতে হবে। তবে সেটির যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা, সেটিও কর্তৃপক্ষকে দেখতে হবে।

এদিকে সরকারের ২০ বছর মেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় গুরুত্ব পাচ্ছে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) . শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ফসলের উৎপাদন শক্তি বাড়াতে যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। কৃষিতে যতটা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন রয়েছে, সেগুলোকে যৌক্তিকভাবে মেটাতে হবে। কৃষককে সর্বোচ্চ সহায়তা দিলে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা আরো জোরালো হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫