ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স নিয়ে
রাষ্ট্রপতির উষ্মা প্রকাশের পর এসব কোর্স বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়
মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। ডিনদের নিয়ে গঠিত যৌক্তিকতা যাচাই কমিটিও সব ধরনের সান্ধ্য
কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে। কিন্তু তাদের এ
সুপারিশ মানতে রাজি নয় শিক্ষকদের একটি অংশ। এরই মধ্যে সান্ধ্য কোর্সের পক্ষে-বিপক্ষে দুটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ অবস্থায় বিভিন্ন বিভাগে
চালু থাকা সান্ধ্য কোর্স নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, সান্ধ্য কোর্সের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক
কাউন্সিলের একটি বিশেষ সভা আহ্বান করা হয়েছে। এদিকে একাডেমিক কাউন্সিলের সভার
একদিন আগেই (আজ) বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে বৈঠক ডেকেছে সান্ধ্য কোর্সের পক্ষে থাকা
শিক্ষকদের একটি গ্রুপ। তারা যেকোনোভাবেই সান্ধ্য কোর্স চালু রাখতে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো.
আখতারুজ্জামান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সান্ধ্য কোর্স নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠায় গত বছরের মে মাসে ডিনদের সমন্বয়ে একটি
যৌক্তিকতা যাচাই কমিটি করে দেয়া হয়। সম্প্রতি যৌক্তিকতা যাচাই-বাছাই করে কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশও উঠে
এসেছে। সান্ধ্য কোর্সের বিষয়টি সম্পূর্ণ একাডেমিক। একাডেমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের
জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল রয়েছে। আগামীকাল সান্ধ্য কোর্স বিষয়ে
সিদ্ধান্ত নিতে একাডেমিক কাউন্সিলের একটি বিশেষ সভা আহ্বান করা হয়েছে। সেখানে এ
বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’
২০০১ সালে ইভিনিং মাস্টার অব বিজনেস
অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইএমবিএ) কোর্স চালু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের চারটি বিভাগ। উদ্দেশ্য
ছিল মানসম্মত জনবল সৃষ্টিতে উদীয়মান বেসরকারি খাতকে সহায়তা করা। মূলত এর মধ্য দিয়ে
ইভিনিং প্রোগ্রাম বা সান্ধ্য কোর্স শুরু হয় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট পরিসরে শুরু হলেও খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এসব সান্ধ্য
কোর্স। ভর্তিচ্ছুদের ব্যাপক চাহিদা ও মোটা অংকের সম্মানীর সুযোগ থাকায় শিক্ষকরাও
বেশ সাড়া দেন এতে। বাণিজ্য অনুষদের দেখাদেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগ
ও ইনস্টিটিউটেও একে একে চালু হতে থাকে সান্ধ্য কোর্স। এক পর্যায়ে বাণিজ্যিক কোর্সে
রূপ নেয় এসব প্রোগ্রাম। অভিযোগ উঠতে থাকে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের। বর্তমানে প্রায়
২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় শতাধিক সান্ধ্য প্রোগ্রাম চালু আছে।
অবকাঠামো ও শিক্ষক সংকটের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে
পরিচালিত এসব কোর্স চালুর প্রতিবাদ শুরু থেকেই করে আসছিল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের
একটি অংশ। সান্ধ্য কোর্স চালুর উদ্যোগ নিয়েও অনেক বিভাগকে আন্দোলনের কারণে পিছু
হটতে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সান্ধ্য কোর্স চালুর উদ্যোগ নিয়েও পিছু
হটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং বাংলা বিভাগ। তা সত্ত্বেও অনেক বিভাগ
সান্ধ্য কোর্স চালু করতে সমর্থ হয়।
অবকাঠামো ও শিক্ষক সংখ্যা বিবেচনায় না নিয়ে
বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করানোয় প্রশ্ন ওঠে সান্ধ্য কোর্সের মান নিয়েও। বিশ্ববিদ্যালয়ের
সিনেট অধিবেশনসহ বিভিন্ন পর্ষদেও এর সমালোচনা হয়। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সমাবর্তনে যোগ দিয়ে সান্ধ্য কোর্স বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য
করেন রাষ্ট্রপতি। এরপর সান্ধ্য কোর্স বন্ধে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্যকে চিঠি দেয় ইউজিসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্সের যৌক্তিকতা
যাচাইয়ে ডিন পর্যায়ের কমিটিও এসব কোর্স সাময়িক বন্ধের সুপারিশ করেছে।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬টি বিভাগ ও নয়টি ইনস্টিটিউটে ৬৯টি সান্ধ্য প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। নিয়মিত প্রোগ্রামের বাইরে পরিচালিত এ ধরনের সব সান্ধ্য কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে সুপারিশ করা হয়েছে যৌক্তিকতা যাচাই কমিটির প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে সান্ধ্য কোর্স পরিচালনায় বেশকিছু অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সান্ধ্য প্রোগ্রামে ভর্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতার মানদণ্ড অনুসৃত হয় না। এসব প্রোগ্রামের ক্লাসে শিক্ষার্থী উপস্থিতিও নগণ্য। পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন ও মূল্যায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা সংবিধি যে অনুসৃত হয় না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সব মিলিয়ে সান্ধ্য কোর্সের কারণে বিভাগের নিয়মিত কার্যক্রম প্রভাবিত হয়।
বেশ কয়েকটি বিভাগ চাকরির বাজারে চাহিদা না থাকা
সত্ত্বেও এবং শিক্ষকস্বল্পতার মধ্য দিয়ে সান্ধ্য কোর্স পরিচালনা করছে বলে
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড
লিডারশিপ;
টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি; ক্রিমিনোলজি; কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস; প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন; ইসলামিক স্টাডিজ
ও জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি
অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালে। বিভাগটি চালুর পর গত তিন
শিক্ষাবর্ষে স্নাতক পর্যায়ে ১৭০ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। নতুন বিভাগ
হওয়ায় এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পাঠদানে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব
হয়নি। মাত্র ছয়জন শিক্ষক দিয়েই চালিয়ে নিতে হচ্ছে বিভাগটির শিক্ষা কার্যক্রম। যদিও
নিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকলেও প্রতি বছর সান্ধ্য ইএমবিএ
প্রোগ্রামে ২১০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে এ বিভাগে। কমিউনিকেশন
ডিজঅর্ডারস বিভাগে স্নাতকের চারটি ও মাস্টার্সের একটি ব্যাচে নিয়মিত শিক্ষার্থী
সংখ্যা ১৪৯ জন। শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র পাঁচজন। শিক্ষকস্বল্পতার
মধ্যেও প্রফেশনালস মাস্টার্স ইন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথলজি (পিএমএসএলপি) নামের পেশাগত কোর্স চালু রয়েছে এ বিভাগে। এ প্রোগ্রামে
প্রতি বছর ৫০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক নিয়ে
নিয়মিতের বাইরে পেশাগত প্রোগ্রাম বিষয়ে কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভাগটির শিক্ষক সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত ও বিভাগের
বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক ছাড়াই এ ধরনের একাডেমিক প্রোগ্রাম চালুর বিষয়টি
মূল্যায়ন প্রয়োজন। টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড
ফটোগ্রাফি বিভাগে স্নাতকের চারটি ও মাস্টার্সের একটি ব্যাচে নিয়মিত শিক্ষার্থী
রয়েছেন ১৫৯ জন। শিক্ষার্থীদের পাঠদানে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ছয়জন। আর প্রতি
শিক্ষাবর্ষে সান্ধ্য প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় ৩২০ জন করে। এ বিভাগে
সান্ধ্য প্রোগ্রাম বিষয়ে কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খণ্ডকালীন বা শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাহীন জনবল দিয়ে এ প্রোগ্রাম চালুর পেছনে
যৌক্তিকতা অত্যন্ত দুর্বল।
প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন বিভাগে স্নাতকের
তিনটি ও মাস্টার্সের একটি ব্যাচে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৮০ জন। এর বিপরীতে শিক্ষক
রয়েছেন মাত্র পাঁচজন। এ বিভাগেও সান্ধ্য কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। এছাড়া
ইসলামিক স্টাডিজ ও প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশনসহ বেশ কয়েকটি বিভাগের চাকরির
বাজারে চাহিদা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের
ডিন ও যৌক্তিকতা যাচাই কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, সান্ধ্য প্রোগ্রামের যৌক্তিকতা নিরূপণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
আমাদের বেশকিছু নির্দেশনা দেয়। সে আলোকে বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে
তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, কিছু বিভাগে নিয়মিত আসনের কয়েক গুণ বেশি শিক্ষার্থী সান্ধ্য প্রোগ্রামে ভর্তি
করানো হচ্ছে। আবার কয়েকটি বিভাগ অপেক্ষাকৃত নতুন হওয়া সত্ত্বেও সান্ধ্য কোর্স
চালাচ্ছে। আমরা প্রতিবেদনে এসব বিভাগে সান্ধ্য প্রোগ্রাম পরিচালনার ক্যাপাসিটির
বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছি।
সান্ধ্য কোর্স পরিচালনায় একটি নীতিমালা করার
সুপারিশ করেছে যৌক্তিকতা যাচাই কমিটি। প্রতিবেদনে একটি খসড়া নীতিমালাও জমা দিয়েছে
তারা। নীতিমালায় বলা হয়েছে, নিয়মিত একাডেমিক প্রোগ্রাম (অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল ও পিএইচডি) বহির্ভূত সব অতিরিক্ত
প্রোগ্রামের (ডিগ্রি, ডিপ্লোমা, ট্রেনিং ও সার্টিফিকেট কোর্স) আবশ্যকতা অনুভূত হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের চাহিদা প্রস্তাব আকারে
বিভাগীয় একাডেমিক কমিটি ও অনুষদ সভার সুপারিশসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে
পাঠানো হবে। কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ডিনস কমিটির সভায় উপস্থাপনের
জন্য পাঠাবে। পরে একাডেমিক কাউন্সিলের সুপারিশ সিন্ডিকেটে অনুমোদিত হবে। এ ধরনের
একাডেমিক প্রোগ্রাম থেকে প্রাপ্য অর্থ সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় কোষাগারে জমা হবে।
পরবর্তী সময়ে নিয়মিত প্রোগ্রামের নিয়মেই শিক্ষকদের সম্মানী দেয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত একাডেমিক প্রোগ্রাম ও গবেষণা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার
আশঙ্কা দেখা দিলে উপাচার্য সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম স্থগিত করতে পারবেন বলে খসড়া
নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।