সৌদি আরবের শ্রমবাজার

প্রতারিত হচ্ছেন শ্রমিক, তবু মোহ কাটে না বিদেশের

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০

আবু তাহের

প্রলোভনে পড়ে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোহাম্মদ শাহ আলম। সেখানে অবস্থানরত নিকটাত্মীয়রা তাকে বলেছিলেন, সেখানে যেতে পারলে ভালো কাজ পাবেন তিনি। বেতনও পাবেন ১ হাজার ২০০ রিয়ালের (প্রায় ২৭ হাজার টাকা) মতো। এ কথা জেনে ওই আত্মীয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সৌদি যান তিনি। এজন্য এক দালালের হাতে তুলে দেন ভিটেমাটি বিক্রি করে জোগাড় করা সাড়ে ৪ লাখ টাকা। এরপর গত বছরের ১ নভেম্বর সৌদি আরবে পা রাখেন তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়ে নিয়োগকর্তাকে (কফিল) খুঁজেই পাননি তিনি। ফোন ধরেনি সেই দালালও। বর্তমানে কফিল ও ইকামাবিহীন অবস্থায় অবৈধভাবে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন তিনি। যৎসামান্য মজুরির বিনিময়ে সেখানকার এক দোকানে কাজ করলেও দিন কাটছে গ্রেফতার ও নির্যাতনের ভয়ে। 

শাহ আলমের মতো একই ফাঁদে পড়েছেন কিশোরগঞ্জ সদরের মোবারক হোসেনও। গত বছরের জুলাইয়ে দালালের মাধ্যমে সৌদি আরব যান তিনি। কথা ছিল সেখানে তাকে বাবুর্চির কাজ দেয়া হবে। কিন্তু সেখানে কফিলকে খুঁজে পাননি তিনিও। একই অবস্থা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের আব্দুর রহমানেরও। তারা দুজনেই এখন দাম্মামে অবৈধভাবে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করছেন। ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে দুজনের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে নিয়েছিল দালাল।

মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। যদিও দেশটিতে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য এখন আর আগের মতো কাজ নেই। যারা সেখানে আছেন, তারাও ভালো নেই। নির্যাতন-নিগ্রহের শিকার হয়ে প্রতিনিয়তই ফিরে আসছেন শ্রমিকরা। দেশের নাগরিকদের প্রবাস গমনে প্রতারিত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে নিয়মিত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। সোচ্চার গণমাধ্যমগুলোও। অথচ দালাল-মধ্যস্বত্বভোগীদের ফাঁদে পড়ে এখনো বিদেশের মোহে সৌদি আরবে যাচ্ছেন অনেক বাংলাদেশী। কাজ না থাকার পরও কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাহ আলম-মোবারকদের মতো হাজার হাজার বাংলাদেশীকে নিয়ে যাচ্ছে দালালরা। এ প্রতারণার বিষয়টি অনুধাবন করতে করতেই সর্বস্ব হারাচ্ছেন শ্রমিকরা। কফিল ও ইকামাবিহীন এসব বাংলাদেশী শ্রমিকের পরবাসে দিন কাটছে অনাহার-দুশ্চিন্তা আর গ্রেফতারের ভয়ে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা প্রচার-প্রচারণা সত্ত্বেও বাংলাদেশ থেকে এভাবে সৌদি আরব যাওয়ার পেছনে মূলত বিদেশের প্রতি মোহই দায়ী। এখনো অনেকের বিশ্বাস, সেখানে গেলেই উচ্চ বেতনে কাজ পাওয়া যাবে। অথচ সেখানে গিয়ে তারা কী করবেন, সে বিষয়ে তাদের নিম্নতম কোনো ধারণা নেই। সরল বিশ্বাসে দালালদের মাধ্যমে সেখানে যাচ্ছেন তারা।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে সৌদি সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রবাসীদের ১২ ধরনের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এরপর দেশটির শ্রমবাজারে শ্রমিক যাওয়ার গতি শ্লথ হয়। ওই বছরই দেশটি থেকে ৪ লাখ ৬৬ হাজার কর্মী সৌদি আরব ছেড়ে নিজ নিজ দেশে চলে যান বলে সেখানকার শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এরপর গত তিন বছরে অন্তত ২০ লাখ বিদেশী কর্মী সৌদি আরব ছেড়ে চলে গেছেন। তবে তাদের মধ্যে ঠিক কী পরিমাণ বাংলাদেশী রয়েছেন, তা জানা যায়নি। 

 

তথ্যমতে, গত তিন বছরে প্রতারণা, হয়রানি আর নির্যাতনে শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন অন্তত ৬৫ হাজার বাংলাদেশী। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সৌদিতে অন্তত সাড়ে সাত লাখ বাংলাদেশী ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। যাদের ইকামা, ওয়ার্ক পারমিট ও রেসিডেন্সি ভিসা নবায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেই তাদের দেশে ফিরে আসতে হবে।

বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) যৌথভাবে পরিচালিত এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন না করেই কিংবা বিনা প্রশিক্ষণে বিদেশ যেতে পারলেই হয়এ ধরনের প্রবণতা বাংলাদেশীদের সবচেয়ে বেশি। বিদেশফেরত ও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ওপর জরিপের ভিত্তিতে গবেষণাটি চালানো হয়।

দালালের প্রতারণার শিকার হয়ে সৌদি আরব গিয়ে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় দিন পার করছেন বাংলাদেশী শ্রমিকদের অনেকেই। শেষ পর্যন্ত সেখানে আর থাকতে চাচ্ছেন না তারা। সেখান থেকে ফিরে আসা শ্রমিকদের পরিসংখ্যানও তা-ই বলছে। বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, গত মাসেও সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন ৩ হাজার ৬৩৫ বাংলাদেশী। চলতি মাসেও ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফিরেছেন ১ হাজার ৯৯৫ জন। এ লাইন আরো দীর্ঘ হচ্ছে।

এ বিষয়ে মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট ফর রিসার্চ (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও অধ্যাপক ড. তাসনীম সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, যেহেতু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে কাজের ভিসা আনতে পারছে না, সেহেতু তারা ব্যক্তিগত ভিসাগুলোর মাধ্যমে এক প্রকার দালালি করে টাকা তোলার চেষ্টা করছে। তারা এখানেক্লিয়ারেন্স এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। যারা ওই দেশে থাকা মধ্যস্বত্বভোগী হতে পারে। তাছাড়া সেখানে থাকা বাংলাদেশী বিভিন্ন পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমেও ভিসা আসছে। যারা ওই দেশের মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে ভিসা কিনে দেশে পাঠাচ্ছে। এই ভিসাগুলোর মাধ্যমেই প্রবাসীরা দেশটিতে যাচ্ছেন সবচেয়ে বেশি।

নানা প্রচার-প্রচারণা সত্ত্বেও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের এভাবে সৌদি আরব যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ড. তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, যে মানুষগুলো বিদেশ যাচ্ছেন, তারা অবশ্যই বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন। সুতরাং ভিসা প্রক্রিয়ায় কর্মীদের কাজের সঠিক তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করা বিএমইটির দায়িত্ব। তাহলে কোনো কর্মী বিপদে পড়লে অন্তত সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি এবং ওই মধ্যস্বত্বভোগীকে চিহ্নিত করেব্ল্যাকলিস্ট করা যেতে পারে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫