দ. কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের হানা, আলোচনায় রহস্যময় ধর্মীয় গোষ্ঠী

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০

বণিক বার্তা অনলাইন

চীনের বাইরে করোনাভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক বাড়ছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। হঠাৎ করে এদেশে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। শনিবার কর্মকর্তারা শুক্রবার থেকে এ পর্যন্ত নতুন করে ২২৯ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন। এতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৩৩-এ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ পরিস্থিতিকে ‘নতুন গুরুতর দশা’ হিসেবে বর্ণনা করছেন।

দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনাভাইরাসের এই হানা দেশটির একটি রহস্যময় ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সামনে হাজির করেছে। কারণ, দেখা যাচ্ছে আক্রান্ত ৪৩৩ জনের মধ্যে ২৩০ জনই এ গোষ্ঠীর সদস্য। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে বেশ ভাবাচ্ছে। অনেকে অবশ্য বলছেন, ওই ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রার্থনার ধরন, আচার ও প্রথার কারণেই ভাইরাসটি তাদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার ওই বিশেষ ধর্মটির নাম ‘শিনচিয়নজি’, এর অর্থ ‘নয়া স্বর্গ, নয়া পৃথিবী’। সর্বশেষ আক্রান্তদের মধ্যে ১০০ জন কোনো না কোনোভাবে এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এছাড়া চলতি মাসের প্রথম দিকে দেগু এলাকায় অনুষ্ঠিত এ ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতার ভাইয়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। এ স্থানের নিকটেই একটি হাসপাতালে আক্রান্ত ১১৪ জন একই গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ২০ ফেব্রুয়ারি ওই গোষ্ঠীর ৫৩ জন আক্রান্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন ওই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের বিষয়ে আরো বিস্তারিত ও গভীর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে বলেন, শিনচিয়নজির লোকেরা যেসব তথ্য দিচ্ছেন শুধু সেটির ওপর আমরা নির্ভর করতে পারি না। ওই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজখবর নিতে হবে। 

শিনচিয়নজি গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রার্থনার সময় মেঝেতে একে অপরের কনুই ও হাঁটু লাগিয়ে ঠাসাঠাসি করে বসেন। এভাবে সাধারণত এক থেকে দুই ঘণ্টা তারা বসে থাকেন। দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এতো দীর্ঘ সময় বিপুল সংখ্যক মানুষ ঘনিষ্ঠভাবে বসে থাকার কারণে সমবেতদের মধ্যে দ্রুত রোগজীবাণু ছড়াতে পারে। দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) গতকাল শুক্রবার বলেছে, ওই ধর্মীয় গোষ্ঠীটির দক্ষিণ কোরিয়া শাখা ও হুবেই প্রদেশসহ চীনের অন্যান্য শাখার সদস্যদের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। 

শিনচিয়নজি ধর্মীয় গোষ্ঠীর একটি প্রার্থনাসভা

১৯৮৪ সালে এই শিনচিয়নজি ধর্মমত প্রচার শুরু করেন লি মান হি নামে এক লোক। তার বর্তমান বয়স ৮৮ বছর। এ গোষ্ঠীর অনুসারীরা দাবি করেন, লি হলেন যিশুখ্রিস্টের দ্বিতীয় আবির্ভাব বা তার প্রতিনিধি। অথবা স্বয়ং যিশু। মূলত পৃথিবী ধ্বংসের আগের প্রস্তুতি নেয়ার জন্যই তাকে পাঠানো হয়েছে এবং তিনি অমর। শিনচিয়নজির অনুসারীরা আরো দাবি করেন, বাইবেলে সবকিছু রূপক অর্থে বলা আছে। একমাত্র লি-ই এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেন এবং বোঝেন। নিজস্ব ধর্মমত প্রতিষ্ঠার আগে লি আরেক খ্রিস্টধর্মীয় আন্দোলন অলিভ ট্রির সদস্য ছিলেন। 

শিনচিয়নজির বর্তমান অনুসারী প্রায় ৩ লাখ বলে ধারণা করা হয়। ২৯টি দেশের প্রায় ৬০০ স্থানে এ গোষ্ঠীর অনুসারী রয়েছেন বলে দাবি করা হয়। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, কঙ্গো, কোস্টারিকা অন্যতম। চীনে তাদের সাতটি উপাসনালয় রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী বেইজিং, তিয়ানজিন এবং সাংহাইয়ের মতো শহরে উল্লেখযোগ্য অনুসারী ও প্রার্থনাগৃহ রয়েছে।

জানা যায়, গোষ্ঠীতে নিবন্ধিত হওয়ার পর ছয় মাসের একটি শিক্ষা সেশন রয়েছে। সেটি সফলভাবে শেষ করার পরই গণপ্রার্থনায় অংশ নেয়ার অনুমতি পাওয়া যায়। যে ভবনে প্রার্থনার আয়োজন করা হয় সেখানে প্রবেশের আগে প্রত্যেক সদস্যকে স্ক্যানারে আঙ্গুল রাখতে হয়। এর ফলে তারা মনোনীত ও গর্বিত বোধ করেন। প্রার্থনার পুরোটা সময় তাদের হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে হয়। 

শিনচিয়নজি ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা লি নিজেকে রাজরক্তের উত্তরাধিকারী দাবি করেন। যদিও আসলে তার জন্ম হয়েছে এক গরীব কৃষক পরিবারে। হঠাৎ করেই তিনি আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন।

গোষ্ঠীটির ওয়েবসাইটে এর আগে বলা হয়েছিল, গত বছর তারা চীনের উহানে একটি উপাসনালয় খুলেছে। এ শহরেই প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। তবে ওয়েবসাইটে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু তখন বলা হয়নি। ভাইরাস সংক্রমণের খবর প্রকাশের পর তারা ওয়েবসাইটে বিবৃতি দিয়ে জানায়, উহানে তাদের কোনো জমায়েতের স্থান বা প্রার্থনাগৃহ নেই। ২০১৮ সালেই তারা সব কার্যক্রম অনলাইন করেছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার সিডিসি এরই মধ্যে ওই ৩১তম ব্যক্তি যিনি পরে শিনচিয়নজির সভ্য বলে জানা গেছে তার শেষকৃত্যে অংশ নেয়া ১ হাজার ১ জনকে ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এই গোষ্ঠীর ৯ হাজার ৩০০ এর বেশি সদস্যের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে, এরই মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৩০০ জনের শরীরে ভাইরাস আক্রান্তের লক্ষণ দেখা গেছে।  সিউল মেট্রোপলিটন সরকার বলেছে, শহরে শিনচিয়নজির চারটি শাখা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাজধানীতে ভাইরাসটি যাতে আর ছড়িয়ে পড়তে না পারে আগাম সতর্কতা হিসেবে এটি করা হয়েছে। যেখানে কোরিয়ার মোট জনসংখ্যার (৫ কোটি ১৮ লাখ) প্রায় অর্ধেক মানুষ এ শহরে বাস করে।

২০১৬ সালের নভেম্বরে চার্চ অব ইংল্যান্ড লন্ডনের প্রায় ৫০০ চার্চে শিনচিয়নজি সংশ্লিষ্ট একটি দাতব্য সংস্থার সন্দেহজনক কার্যক্রমের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সতর্কতা জারি করে। ২০১৯ সালের আগস্টে ভারতের মনিপুরে ব্যাপটিস্ট কনভেনশনেও তাদের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়।

নানা সন্দেহ সংশয়ের বিষয়ে জানতে একাধিক গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও শিনচিয়নজির কোনো সদস্য এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তাদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণমাধ্যম এমনভাবে প্রতিবেদন করছে যেন আমরাই করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য দায়ী! আমরা প্রার্থনার সময় মেঝেতে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসি সীমিত স্থানে বিপুল সংখ্যক মানুষের জায়গা করে দিতে।

সূত্র: ব্লুমবার্গ, উইকিপিডিয়া


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫