স্যামসাংয়ের কাছে আভিজাত্য ছেড়ে সাধারণের কোম্পানি হচ্ছে অ্যাপল!

প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০

বণিক বার্তা অনলাইন

স্যামসাংয়ের কাছে আভিজাত্য ছেড়ে দিয়ে সাধারণের ফোন কোম্পানিতে পরিণত হচ্ছে অ্যাপল। সাম্প্রতিক সময়ে স্যামসাংয়ের উন্মোচিত ফোনগুলোর উচ্চমূল্যই নয়, অ্যাপলের বিপণন কৌশলও এমন ধারণা বদ্ধমূল করার পেছনে ভূমিকা রাখছে। শীর্ষস্থান ধরে রাখার দৌড়ে অ্যাপল বিপণন কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে অনেকটা তালগোল পাকিয়ে ফেলছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। 

অ্যাপলই সম্ভবত প্রথম কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান যারা পণ্যের ডিজাইনে সব সময় নান্দনিকতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, বহিরাবরণ, মোড়ক এমনকি উপস্থাপনেও নান্দনিকতার ছোঁয়া থাকে অ্যাপলের সব ধরনের পণ্যে। প্রযুক্তিতে নন্দনতত্ত্বের গুরু বলা হয় স্টিভ জবসকে। তিনি কম্পিউটার ও সেলফোন সফটওয়্যারের হরফেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। মানুষের বেশি দামে অ্যাপলের পণ্য কেনার পেছনে এটি একটি অন্যতম কারণ। 

এখন কথা হলো, যারা সারা জীবন ব্যবহৃত পণ্যের শৈল্পিক ও নান্দনিক শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার নিয়ে চলেছেন তারা এখন রাতারাতি এমন কারো প্রতি ঝুঁকবেন যাদের সব সময় উপেক্ষা করে এসেছেন? অ্যাপলের বিপরীতে স্যামসাংয়ের অবস্থানটি এখন এভাবেই ভাবা হচ্ছে।

সপ্তাহখানেক আগে স্যামসাং বেশ কয়েকটি নতুন ফোন উন্মোচন করেছে। এর মধ্যে কিছু ফোন এতোই বড় যে হাতে ধরে রাখতে রীতিমতো ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে হবে! সবচেয়ে সস্তা ফোনটির দাম শুরু ৯৯৯ ডলার থেকে। আর সবচেয়ে দামী ফোনটির মূল্য শুরু ১ হাজার ৪০০ ডলার থেকে! গ্যালাক্সি এস২০ আলট্রা ৫১২ জিবি সংস্করণটির দাম ১ হাজার ৬০০ ডলার ছুঁয়েছে। আর চমক জাগানো জেড ফ্লিপের দাম শুরু ১ হাজার ৩৮০ ডলার থেকে। গ্যালাক্সি ফোল্ডের দাম প্রায় দুই হাজার ডলার। 

দামের তালিকা দেখে এটা ভাবা যৌক্তিক হবে যে, স্যামসাং ক্রমেই অভিজাতদের সেলফোন কোম্পানিতে পরিণত হওয়ার উচ্চাভিলাস নিয়ে এগোচ্ছে। এমন ধারণা প্রবল হলে স্যামসাংয়ের বিপুল পরিমানে নিম্ন ও মধ্যম মানের ফোনের ব্যবহারকারীরা কিছুটা বিভ্রান্ত হতে পারেন। কারণ প্রিয় ব্রান্ডের কাছে তাদের গুরুত্ব কমছে কি না সে সন্দেহ তৈরি হবে।

অপরদিকে গত বছরের শেষ নাগাদ আইফোন ১১ সিরিজ উন্মোচন করেছে অ্যাপল। এ সিরিজের সবচেয়ে সস্তা ফোনটির দাম ৬৯৯ ডলার। যারা একটি সেলফোন কিনতে হাজার ডলার খরচের কথা শুনলে শিউরে ওঠেন তাদের জন্য এটি একটি স্বস্তি বলা যেতে পারে। এদিকে আরেকটি গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, স্বল্পমূল্যের সংস্করণ আইফোন এসই২ উন্মোচন করতে যাচ্ছে অ্যাপল। সম্ভবত এবার এটি আইফোন ৯ নামে বাজারে আসবে। ছোট আকারের এ সিরিজের ফোন স্বল্প বাজেটের ক্রেতাদের জন্য দুর্দান্ত সুযোগ এনে দিয়েছিল। ফলে মূলত ক্রেতা সংখ্যা বাড়ানোই যে এ উদ্যোগের লক্ষ্য তা স্পষ্ট। এছাড়া যারা ২০০ ডলারে নতুন আইপড প্রো কিনতে অনাগ্রহী বা অসমর্থ্য তাদের জন্যও শিগগির সুযোগ আসবে বলে ধরে নেয়া যায়। 

বিক্রির দিকে থেকে স্যামসাং এক নম্বরে থাকার পেছনে বড় কারণ দক্ষিণ কোরীয় এ কোম্পানি সব বাজারের জন্য উপযুক্ত সব ধরনের ফোন তৈরি করে। তাদের কোনো বাছবিচার নেই। এতো বেশি মডেলের ফোন এ কোম্পানি বানায় যে বেশিরভাগ মানুষ নির্দিষ্ট ফোনকে আলাদা করতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন। অনেক সময় ফোন কিনতে গিয়ে ক্রেতাও সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যান।

এ ধরনের সমস্যা কিন্তু এখন আইফোনের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। অ্যাপল এখন একসঙ্গে বেশ কয়েকটি ফোন উন্মোচন করছে। ফলে নির্দিষ্ট ব্রান্ড নামের আইফোন আলাদা করে চিনতে পারাটা কঠিন হয়ে গেছে। যেমন: আইফোন এক্স, এক্সআর অথবা এক্সএস। এগুলো চোখের দেখায় আলাদা করা প্রায়শই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফোনের দোকানের কর্মীরাও এক্সআর আর এক্স গুলিয়ে ফেলেন। এমনকি এক্সআরকে অনেকে আইফোন ৮ বলেও শনাক্ত করেন! 

তারপরও এখনো অ্যাপলের স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আইফোন রয়েছে। কিন্তু স্যামসাং তার ধারেকাছেও নেই। বিশেষ করে কোম্পানিটির স্বল্পমূল্যের সেলফোনগুলো সবই একই রকম মনে হয়। বলতে গেলে, এসব ফোনের যেন কোনো নাম নেই, এগুলো ‍শুধুই ফোন!

তবে অ্যাপলের মতো কোম্পানির এভাবে ফোনের সংখ্যা বাড়ানোর কৌশল ব্রান্ড ইমেজের ক্ষতি করতে পারে বলেই মনে করেন বিপণন বিশেষজ্ঞরা। সর্বশেষ মডেলের আইফোন নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে যে উত্তেজনা থাকে সেটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অ্যাপলকে আরো বেশি সাধারণ ও সস্তা করে তুলতে পারে।

এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, মানুষ এখন পণ্য কেনার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন ও যৌক্তিক। ফোন কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতারা এখন অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়। 

পণ্য বিক্রির পাশাপাশি বিক্রয়োত্তর সেবা ও অন্যান্য সেবা এখন দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। নিজের ইকোসিস্টেমের মধ্যে বিদ্যমান গ্রাহকদের যে কোনো মূল্যে ধরে রাখা অ্যাপলের প্রধান কৌশল। বেশি পণ্যের উন্মোচন ক্রেতাকে ইচ্ছেমতো পণ্য বেছে নেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে এটি সত্য। তবে অ্যাপলের ক্রেতার যে শ্রেণী তাতে এ সুযোগ নেয়া গ্রাহকের সংখ্যা সামান্যই।

এখন মানুষ প্রিয় ফোন দীর্ঘদিন ব্যবহার করেন। এ কারণে নতুন ডিভাইস এলে তারা খুব খুঁটিয়ে দেখেন। নানা স্বাতন্ত্র সমেত প্রকৃত অর্থেই নতুন মনে না হওয়া পর্যন্ত তারা ডিভাইস পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন না।

এ বিষয়টি উপলব্ধি করছে স্যামসাংও। তারা দাবি করছে তাদের গ্যালাক্সি এস১০ ব্যবহারকারীকে সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এটি ‘পারফেক্ট এন্ট্রি লেবেল’ ফোন বলে দাবি করছে তারা। যদিও আসলে এ ফোনে নতুন কিছুই নেই!

মডেল সংখ্যা বাড়ানোর মানে কিন্তু এ নয় যে, স্মার্টফোনের বাজারে মর্যাদার দিক থেকে শীর্ষস্থানে থাকার লোভ সংবরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অ্যাপল। অ্যাপলের ফোল্ডিং ফোন আসছে। ধরে নেয়া যেতে এর নাম হবে ‘আইফোল্ড’। সেটির দাম কতো হতে পারে সেটি মনে হয় এরই মধ্যে বাজারে আসা ফোল্ডিং ফোনগুলোর দামের বাহার দেখেই অনুমান করা যায়।

এদিক থেকে দেখলে স্যামসাংয়ের অভিজাত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা যায়ই। বলা যায়, সস্তা থেকে আকাশচুম্বি দামের ফোন বাজারে আনার মূল লক্ষ্য টাকা কামানো। অবশ্য অ্যাপলও তা-ই করে, ভবিষ্যতেও করবে। ফলে সামনের দিনগুলোতে অ্যাপলের বিপরীতে স্যামসাংয়ের আরো বেশি অভিজাত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।

এর বাইরে বলা যেতে পারে, স্যামসাং প্রচুর ফোন বানাচ্ছে যেগুলোতে আসলেই আলাদা করার মতো বৈশিষ্ট্য নেই, তাদের উদ্দেশ্যও খুব স্পষ্ট এবং অভিমুখী নয়। 

নতুন ফোন আনার ক্ষেত্রে প্রচারণাই যদি মুখ্য হয় তাহলে স্যামাসংয়ের ক্ষেত্রে হয়তো ঠিক আছে। তাদের কিছু ফোন বেশ চমৎকার। কিছু দামি ফোন আসছে- এগুলোই কিন্তু পুরো কোম্পানির ভাবমূর্তি তৈরি করে দিচ্ছে না। এই মুহূর্তে জেড ফ্লিপ পয়সাওয়ালা ক্রেতাদের মুগ্ধ করতে পারে। কিন্তু তারা কি গ্যালাক্সি এস১০ লাইট আর এস১০ ই এর মধ্যে পার্থক্য করতে পারবেন? নাকি এটি শুধুই চোখ ধাঁধানো ব্যাপারমাত্র। শুধু অন্যান্য অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস থেকে এটি আলাদা বলেই সামর্থ্যবান ক্রেতারা  সন্তুষ্ট থাকবেন? অথবা মুগ্ধতা কেটে গেলে তারা আরো বেশি স্বতন্ত্র দেখায় এমন অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস কেনার কথা ভাববেন- সেটিই দেখার বিষয়।

জিডিনেট অবলম্বনে জাহাঙ্গীর আলম


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫