সেলাই মেশিন: যেভাবে হয়ে উঠলো নারীমুক্তির হাতিয়ার

প্রকাশ: জানুয়ারি ২০, ২০২০

বণিক বার্তা অনলাইন

সম্প্রতি পুরুষের শেভিং পণ্য প্রতিষ্ঠান জিলেটের বিজ্ঞাপনচিত্রে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বার্তা দেয়া হয়েছে। বিয়ার কোম্পানি বাডওয়াইজার বিশেষ ডিজাইনের কাপ বাজারে এনেছে, যেটি দেখলে অদ্বৈত (নন-বাইনারি) ও জেন্ডার ফ্লুইড লোকদের গর্বিত করবে। সমসাময়িক সামাজিক আন্দোলন ও ইস্যুকে পুঁজি করে বাজার দখলের এই ধারণাকে বলে ‘জাগ্রত পুঁজিবাদ’। বাজার অর্থনীতি ভিত্তিক এ পুঁজিবাদের ধারণা কিন্তু বহু পুরনো।

এ বিষয়ের সবচেয়ে প্রকৃষ্ট একটি দৃষ্টান্ত পেতে ফিরে তাকাতে হবে ১৮৫০ সালের দিকে। ওই সময় বর্তমানের উন্নত দেশগুলোর সমাজও দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধে অনেক পিছিয়ে ছিল। এর বছর দুয়েক আগে মার্কিন সমাজকর্মী ও নারী অধিকার আন্দোলন ব্যক্তিত্ব এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টন নারীদের ভোটাধিকার চেয়ে ওই সময় রীতিমতো বিতর্ক তৈরি করেছিলেন। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ সমর্থকরাও তার উচ্চাভিলাস নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। 

ঠিক ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে এক ব্যর্থ অভিনেতা নতুন উদ্ভাবন দিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় দিনরাত এক করছিলেন। তিনি একটি শোরুম ভাড়া করে কাঠ খোদাই করে লেখার যন্ত্র বেচার চেষ্টা করেন। চমৎকার ছিল যন্ত্রটি। আশা ছিল ভালো বিক্রি হবে। কিন্তু ততোদিনে কাঠ খোদাই করে লেখার চল প্রায় উঠে গেছে। ফলে যন্ত্রটি সুন্দর হলেও কেউ কেনার আগ্রহ দেখায়নি। 

তবে তিনি দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। শিগগিরই আরেকটি যন্ত্র বানিয়ে ওই সময়ের হতাশ উদ্ভাবকদের দাওয়াত করলেন। ওই মেশিনটি নিয়ে তখন অনেক উদ্ভাবক দিনরাত খাটছেন। কিন্তু এক দশকেও তেমন কোনো উন্নতি কেউ করতে পারেননি। সেদিক থেকে ওই অভিনেতার যন্ত্রটি ছিল বেশ কাজের। ফলে সফলতার সম্ভাবনা শতভাগ। যন্ত্রটি ছিল একটি সেলাই মেশিন।

ওই সময় কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতেন মূলত নারীরা। তারা খুব কম মজুরি পেতেন। ওই সময় নিউইয়র্ক হেরাল্ড সংবাদপত্রে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, দুস্থ্য নারীরা সেলাইয়ের কাজে অনেক শ্রম দেন। কিন্তু পারিশ্রমিক পান খুবই নগণ্য। তবুও তারা নিরূপায়। 

তখন সেলাইয়ে অনেক বেশি সময় লাগত। একটি শার্ট সেলাই করতে পাক্বা ১৪ ঘণ্টা লেগে যেত। সুতরাং যন্ত্রের সহায়তায় সেলাইয়ের গতি বাড়ানো গেলে ভাগ্য ফেরার নিশ্চয়তা ছিল। সমসাময়িক লেখক সারা হল তার বইয়ে নারীদের সেলাইয়ের কাজকে ‘নেভার এন্ডিং, এভার বিগিনিং’ বা ‘একবার শুরু করলে আর শেষ হবার নয়’ এভাবেই বর্ণনা করেছেন। ওই উদ্ভাবক নতুন ডিজাইনের মেশিনটি বাজারজাতকরণে এ সমস্যাটিকেই পুঁজি করেন। তিনি মজা করে বলতেন, নারীদের চুপ করিয়ে রাখার একটি চমৎকার হাতিয়ার! 

ব্যর্থ অভিনেতা থেকে সফল উদ্ভাবক বনে যাওয়া এই ব্যক্তিটি হলেন আইজ্যাক মেরিট সিঙ্গার। তিনি ছিলেন খুবই পরিপাটি, সহজাত দক্ষতাসম্পন্ন, উদার কিন্তু বেপরোয়া প্রকৃতির মানুষ। নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন তার স্বভাবে ছিল না। কমপক্ষে ২২ সন্তানের এ জনক একই সঙ্গে তিনটি পরিবার চালাতেন। তবে এক স্ত্রী জানতেন না অন্যের কথা। একজন অবশ্য তার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন।

এক কথায়, সিঙ্গার নারী অধিকারের পক্ষের লোক নন। কিন্তু তার উদ্ভাবন ও কাজ নারীদের পক্ষে কাজ করেছে। নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সিঙ্গারের জীবনীকার রুথ ব্র্যান্ডন তার সম্পর্কে বলেন, সিঙ্গার এমন এক মানুষ, যিনি নারীবাদী আন্দোলনের শক্ত ভিত দিয়েছেন।

সিঙ্গার তার উদ্ভাবিত সেলাই মেশিনে প্রচলিতগুলোর তুলনায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন। মেশিনের শাটলটি বৃত্তাকারে ঘোরার পরিবর্তে সরলরেখায় নিয়ে আনেন তিনি, যা সামনে যাওয়া আসা করবে। আর বাঁকানো সুইয়ের পরিবর্তে আনলেন সোজা সুই, যা উপরে এবং নিচে ওঠানামা করবে। যা আধুনিক সেলাই মেশিনের ভিত্তি। সিঙ্গার তার এ আইডিয়ার পেটেন্ট করে ফেলেন এবং দ্রুতই ওই ডিজাইনের মেশিন বাজারে আনেন। তার মেশিনটি দিয়ে মাত্র এক ঘণ্টায় একটি শার্ট সেলাই করা যেত। 

তবে সমস্যা বাঁধলো আরেক জায়গা; সেলাই মেশিনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও কৌশল বিভিন্ন উদ্ভাবকের নামে পেটেন্ট করা ছিল। যেমন খাঁজকাটা মাথায় ছিদ্রযুক্ত সুই এবং সুইয়ের নিচে কাপড়ের স্বয়ংক্রিয় ফিডিং কৌশল। 

১৮৫০ দশকে তথাকথিত ‘সেলাই মেশিন যুদ্ধ’ চলাকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রস্তুতকারকরা মেশিন বিক্রির চেয়ে পেটেন্ট লঙ্ঘনের অভিযোগে একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করতেই বেশি আগ্রহী ছিল। অবশেষে, একজন আইনজীবী তাদের সবাইকে একত্রিত করেন। তাদের মধ্যে চারজন লোক ছিলেন যাদের একটি ভালো মেশিন তৈরিতে প্রয়োজনীয় সব উপাদানের পেটেন্টের মালিকানা ছিল। মামলার ঝামেলায় না গিয়ে লাইসেন্স নিয়ে স্বাধীন ব্যবসা করা যেতে পারে- আইনজীবীর এমন প্রস্তাবে তারা রাজি হয়ে যান। 

আইনি ঝামেলা মেটার পর সেলাই মেশিনের বাজারে উল্লম্ফন ঘটে। আর দ্রুতই আধিপত্য বিস্তার করে সিঙ্গার। তবে সিঙ্গারের কারখানার যে অবস্থা ছিল তাতে বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটাই ছিল অবিশ্বাস্য। কারণ মেশিনের যন্ত্রাংশ সাধারণ নাট-বোল্ট দিয়ে হাতে তৈরি করা হতো।

তবে সিঙ্গারের চতুর ব্যবসায়িক পার্টনার এডওয়ার্ড ক্লার্ক অন্য অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। বিপণন কৌশলে তিনি সব প্রতিযোগীকে ধরাশায়ী করেন। ওই সময় সেলাই মেশিনের দাম মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে ছিল। তাদের কয়েক মাসের উপার্জনের সমান ছিল এ মেশিনের দাম। ক্লার্ক মেশিন ভাড়া দেয়া শুরু করলেন। খুব সামান্য অর্থের বিনিময়ে মাসভিত্তিক ভাড়া নেয়া যেতো। কারো ভাড়ার টাকা যখন মেশিনের দামের সমান হয়ে যেতো তখন মেশিনটি তাকে দিয়ে দেয়া হতো। সিঙ্গারের এজেন্টরা ক্রেতার বাড়িতে গিয়ে মেশিন সেট করে দিয়ে আসতো এবং ঠিকঠাক চলছে কি না খোঁজখবর নিতো।

কিন্তু এই সমস্ত উদ্ভাবনী বিপণন কৌশল একটি বড় সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। সমস্যাটি ছিল তৎকালীন সমাজে নারীবিদ্বেষ। এই মনোভাব বুঝতে সেলাই মেশিনের বিজ্ঞাপনের দুটি কার্টুনই যথেষ্ট। একটিতে দেখানো হয়, একটি লোক বলছে, বিয়ে করার পর আপনি কেন একটি সেলাই মেশিন কিনবেন। অন্যটিতে একজন বিক্রয়কর্মী বলছে, একটা সেলাই মেশিন থাকলে নারী তার বুদ্ধিসুদ্ধি উন্নতির জন্য আরো সময় পাবে।

এ ধরনের মনোভাবের কারণে একটা সংশয় প্রবল ছিল যে, সিঙ্গারের এতো দামি একটা মেশিন নারীরা চালাতে পারবে কি না। সেলাই যতো জনপ্রিয় হবে সিঙ্গারের ব্যবসাও ততো রমরমা হবে। ফলে ব্যক্তি জীবনে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলেও নারী-পুরুষ ভেদের দিকে খেয়াল করার মতো নির্বোধ ছিলেন না সিঙ্গার।

নিউইয়র্কের ব্রডওয়েতে একটি দোকান ভাড়া নেন সিঙ্গার। সেখানে তরুণীদের নিয়োগ দেন যারা মেশিনগুলো চালিয়ে দেখাতেন। এমন দৃশ্য তখন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। সিঙ্গারের বিজ্ঞাপনগুলোতে নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে দেখানো হয়। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, পরিবারের নারী সদস্যের কাছে প্রস্তুতকারী সরাসরি মেশিন বিক্রি করে। তারা বুঝাতে চেষ্টা করেন নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, একজন দক্ষ নারী অপারেটর এ মেশিন থেকে বছরে ১ হাজার ডলার আয় করতে পারেন। 

সেলাই মেশিন বিক্রির বিজ্ঞাপন

১৮৬০ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে বলা হয়, অন্য কোনো উদ্ভাবন আমাদের মা ও কন্যাদের জন্য এত বড় স্বস্তি আনেনি। নারী দর্জিদের জন্য এই উদ্ভাবন ছিল কম পরিশ্রমে বেশি পারিশ্রমিকের নিশ্চিয়তা। 

তথাকথিত ‘জাগ্রত পুঁজিবাদ’কে আজকাল অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখেন। বলা হয়, এটা আরো বেশি পণ্য বিক্রির কৌশল। কথাটি অনেক ক্ষেত্রে সত্যও। সিঙ্গার কিন্তু সরাসরিই বলতেন; যা করেছেন টাকার জন্য! কিন্তু তিনি এটাও প্রমাণ করেছেন, ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টাও অনেক সময় সমাজের অগ্রগতির উপলক্ষ্য হতে পারে।

বিবিসি অবলম্বনে


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫