সময়ের ভাবনা

প্রাথমিক শিক্ষা কি প্রয়োজনানুযায়ী গুরুত্ব পাচ্ছে?

প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯, ২০২০

গৌতম রায়

সাম্প্রতিক সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা বেশকিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য বর্তমান সময়সূচি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে প্রায়ই। পরিবর্তন আসছে শিক্ষাক্রম পাঠ্যবইতেও। পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও বেশকিছু আলোচনা হচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বইয়ের ভারে ভারাক্রান্ত করার বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। এর প্রতিফলন হয়তো পড়বে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরের নানা নির্দেশ, পরিপত্র বা বিজ্ঞপ্তি অনুসারে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় কমবেশি পরিবর্তন সবসময়ই আসছে।

গুণগত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রাসঙ্গিক পরিবর্তন কাম্য। কিন্তু পরিবর্তনগুলো নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে হচ্ছে কিনা, সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য আজ থেকে বছর দশেক আগে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছিলে দেশের দ্বিতীয় শিক্ষানীতি, যা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ নামে পরিচিত। শিক্ষানীতিতে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তার বড় অংশ এখনো বাস্তবায়নের বাইরে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, সেগুলো দৃশ্যমান নয়।

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার পরিধি ব্যাপক। স্তরের শিক্ষার গুরুত্ব এমন পর্যায়ে যে গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের নানা খাতে দ্রুত কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সম্ভব। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা প্রয়োজনানুযায়ী পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাচ্ছে কি?

উদাহরণস্বরূপ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সীমার বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ৯টায় এবং তা শেষ হতে হতে এক শিফটের বিদ্যালয়ে ৩টা ১৫ দুই শিফটের বিদ্যালয়ে বিকাল ৪টা বাজে। কোনো কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের এই নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। বিদ্যালয়ের অফিস সময়সীমা এবং শিক্ষাদানের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা দুটো ভিন্ন বিষয়। বিদ্যালয় সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীরা একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত পড়বে, বাকি সময়ে শিক্ষকরা ক্লাসের শিক্ষাদানের বাইরের কাজগুলো করবেনএমনটাই হওয়া উচিত। আমাদের বিদ্যালয়গুলোয় দিনের পড়া দিনে শেষ করে দেয়া হয় না এবং শিক্ষার্থীদের বাড়ি, গৃহশিক্ষক কোচিংয়ের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কতটুকু সময় ধরে বিদ্যালয়ে রাখা প্রয়োজন, তা নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। তবে যদি এমন হয় যে, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার যাবতীয় আয়োজন বিদ্যালয়েই শেষ করা হবেএমন ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের, সেক্ষেত্রে অবশ্য অন্যভাবে ভাবতে হবে।

শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার সময়টুকুর পাশাপাশি একজন শিক্ষক কতটুকু সময় বিদ্যালয়ে দেবেন, সেই সিদ্ধান্তও সতর্কভাবে গ্রহণ করা প্রয়োজন। একজন শিক্ষক শুধু শিক্ষকই নন, তাকে সমাজের আর ১০ জন মানুষের মতো নানা পারিবারিক সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাছাড়া শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ক্লাসের আগে শিক্ষককে সতর্কভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে হয়, আনুষঙ্গিক অফিশিয়াল কাজ সম্পন্ন করতে হয়। শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য শিক্ষকদের নির্ধারিত মাত্রায় বিশ্রামও নিতে হয়। এর সঙ্গে জড়িত তাদের মানসিক শারীরিক সুস্থতাও। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে এসব বিষয় অনেকাংশে অনুপস্থিত বলে ধারণা করা যায়। যেমন বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে সবাই যেখানে শুক্র শনিবার দুদিন ছুটি ভোগ করছে, সেখানে শিক্ষকরা ছুটি পাচ্ছেন মাত্র একদিন। একদিনের ছুটিতে একজন শিক্ষক কীভাবে তার পরিজনদের সঙ্গে গুণগত সময় কাটাবেন? সপ্তাহান্তে নানা দায়িত্ব শেষ করতেই ছুটির সময় ফুরিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কীভাবে একটি সুস্থ ছুটি কাটিয়ে পরবর্তী সপ্তাহের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেবেন? ছুটি মানুষকে চাঙ্গা করে, এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যটুকু আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে অন্য সবার মতো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মঘণ্টাও সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা রাখা যেতে পারে। রবি থেকে বৃহস্পতিবার প্রতিদিন ঘণ্টা করে তারা অফিস করবেন। এর মধ্যে প্রতি শিক্ষক গড়ে - ঘণ্টা ক্লাসে ব্যয় করবেন, বাকি সময় প্রস্তুতি অন্যান্য অফিশিয়াল কাজ সম্পন্ন করবেন। শুক্র শনিবার দুই দিন যাতে ছুটি কাটাতে পারেন, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এটি করা প্রয়োজন শুধু শিক্ষকদের স্বার্থেই নয়, গুণগত শিক্ষার স্বার্থেও। প্রয়োজনে বছরের ছুটিগুলো নতুনভাবে বিন্যস্ত করা যেতে পারে।

একজন শিক্ষককে ক্লাসের বাইরে বা বিদ্যালয়ের বাইরেও নানা ধরনের কাজ করতে হয়, যার অনেকগুলো পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক। একজন শিক্ষককে বিদ্যালয়ের বাইরে আদমশুমারির জরিপ থেকে শুরু করে নির্বাচন পরিচালনার মতো প্রচুর কাজ করতে হয়, যেগুলো শিক্ষা কার্যক্রমের বহির্ভূত। এমনকি স্বাস্থ্যসেবার কাজ বা ভোটার তালিকা তৈরিতে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের যুক্ত করা হয়। অতি জরুরি বিষয় ছাড়া সরকারের এসব কাজে শিক্ষকদের জড়িত না করে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের লোকবল দিয়ে এসব কাজ করানো জরুরি। এগুলো শিক্ষকদের কাজ নয়।

এসব কারণে হোক বা শিক্ষকদের যোগ্যতার ঘাটতির কারণে হোক, আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক পর্যাপ্ত দক্ষ নন। শুধু শিক্ষাগত যোগ্যতা শিক্ষকতার ক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচনা হতে পারে না। একজন শিক্ষক নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতা দিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করলেও অবসর গ্রহণ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে তাকে প্রশিক্ষণের মধ্যে রাখা প্রয়োজন। এতে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়বে, তারা প্রতিনিয়ত নতুন জ্ঞান কৌশলের সঙ্গে পরিচিত হবেন। উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে ৬৭টি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে আরো উপযোগী করা প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষার কোন কোন দিকে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, সেগুলো নির্ধারণ করা প্রয়োজন গবেষণার মাধ্যমে। বাংলাদেশে বর্তমানে পাবলিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিভিন্ন নামে শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট বা ফ্যাকাল্টি রয়েছে। প্রয়োজনে বিশ্লেষণ পরিকল্পনা গ্রহণে সরকারের প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে পারে।

এটিও উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেকোনো ক্ষেত্রেই বেতন একটি প্রণোদনা। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের শিক্ষকরা এদিকে অবহেলিত এবং তাদের মধ্যে প্রাথমিকের শিক্ষকরা আরো বেশি অবহেলিত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পড়ানো যতটা সহজ, তার চেয়েও বেশি কঠিন প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের পড়ানো। অথচ এই কঠিন কাজটি করছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা অনেক কম বেতনে। শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবি উঠেছে অনেক আগেই। সেটি যদি না- হয়, এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, যেখানে দক্ষ যোগ্য মানুষ নিজ থেকেই প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকতা করতে আগ্রহী হবেন। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন যদি তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি অনুসারে নির্ধারণ করা হয়, সেক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা বরং লাভবান হবে। এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা যদি পর্যাপ্ত বেতন পান, তাদের অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষায় আসতে আগ্রহী হবেন। শুধু তা- নয়, প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতির কাঠিন্যের কথা চিন্তা করে তাদেরকে বরং বিশেষ প্রণোদনাও দেয়া প্রয়োজন। শিক্ষা এমন একটি খাত, যেখানে অন্য খাতের বেতনের নিরিখে মাপা অনুচিত; বরং এটুকু মনে রাখতে হবে শিক্ষায় সুচিন্তিত পরিকল্পিত বিনিয়োগ দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক ফল বয়ে আনে।

উল্লিখিত বিষয়গুলোর পাশাপাশি ভৌত অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানো, স্থায়ী শিখনের উদ্দেশ্যে মূল্যায়ন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে সামঞ্জস্য বিধান, শিক্ষার্থীদের বিকাশের শক্তিময়তার কেন্দ্রগুলো পরিচর্যা করাএসব বিষয়েই নজর দেয়া প্রয়োজন। আর্থিক সীমাবদ্ধতা পরিচালনগত দক্ষতার সীমাবদ্ধতায় স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশের পক্ষে একসঙ্গে সব বিষয়ে মনোযোগ দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে এগোলে নির্ধারিত কর্মপরিকল্পনা মোতাবেক কার্যক্রম বাস্তবায়নের চেষ্টা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০- অনেক ভালো চমত্কার সুপারিশ রয়েছে কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নে সদিচ্ছার অভাব এরই মধ্যে দৃশ্যমান।

প্রাথমিক শিক্ষা যদি গুণমানসম্পন্ন করা যায়, তাহলে এর প্রভাব পড়বে মাধ্যমিকে। একইভাবে গুণগত মাধ্যমিক শিক্ষা উচ্চশিক্ষায় গুণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। দেখা যাচ্ছে, এভাবে চেইন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে যতই হা-হুতাশ করা হোক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয় কখনই একা সেটি নিশ্চিত করতে পারবে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়তে আসেন, তাদের মূল ভিত্তি তৈরি হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, সেটি মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় স্থায়ী হয়ে যায়। সুতরাং প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে তৈরি হয়ে এলে মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে সেটি পরিপূর্ণভাবে বিকাশের সুযোগ মেলে। অন্যথায় ডিগ্রিধারী মানুষ তৈরি হয় সত্যি কিন্তু দক্ষ জনসম্পদে ঘাটতি বাড়তেই থাকে।

সার্বিক দিক বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষাকে তাই যতটুকু গুরুত্ব দেয়া উচিত, সেটি যত দ্রুত সম্ভব নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত শিক্ষকরাই যেহেতু কাজে অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করেন, সুতরাং তাদের কেন্দ্র করে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার প্রয়াস গ্রহণ করা হলে তার ফল প্রভাব দ্রুত পড়বে অন্যান্য খাতেও। শিখনের স্থায়ী ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক শিক্ষাকে শক্তিশালীকরণের বিকল্প নেই।

 

গৌতম রায়: সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected] 

 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫