১০ জানুয়ারি: আকাশ ভেঙে আসে ওই জনতার রাজা

প্রকাশ: জানুয়ারি ১৩, ২০২০

হায়দার মোহাম্মদ জিতু

কালের ইতিহাসে কোনো কোনো শাসকও যে জনগণের জন্য কাতর, উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং তাদের দুর্দশা লাঘবের জন্য সব ছেড়ে-ছুড়ে সংগ্রাম করেছেন, তারই একখণ্ড উদাহরণ সফোক্লিসের ‘ইডিপাস’ নাটক। যেখানে গ্রিক রাজা ইডিপাস তার প্রাসাদমুখে দাঁড়িয়ে দু’হাত প্রসারিত করে জনগণের দুর্দশাকে আলিঙ্গন করেছেন এবং তার থেকে উদ্ধারের পথ নির্মাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।

বাঙালির জীবনেও এমন একজন রাজার আগমন ঘটেছিল। তবে তিনি কোনো প্রাসাদের অধিকারী ছিলেন না। রাখালের মতো মাঠঘাট পেরিয়ে তিনি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যেতেন। মানুষের দুঃখ অনুভব করতেন এবং সেই দুঃখ-দুর্দশাকে জয় করার তাগিদে জীবনের শেষ আলোক বিন্দু পর্যন্ত ‘জনগণের জন্য-জনগণের হয়ে’ লড়াই করে গেছেন। সেই রাজা-মহারাজার নাম ‘শেখ মুজিব’।

গ্রিক নাটক ইডিপাসে রাজা ইডিপাস যেমন জনগণের দুঃখ-দুর্দশায় কাতর হয়ে প্রাসাদমুখে বেরিয়ে এসেছিলেন, জনগণের সঙ্গে যন্ত্রণাগ্রস্ত হয়েছিলেন, তেমনি শেখ মুজিব তার দুর্দশাগ্রস্ত জনগণের কাছে হাজির হয়েছিলেন ৭ মার্চ তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে। যেখানে দুর্দশাকে প্রতিহত করে জয় ছিনিয়ে আনতে ভবিষ্যৎ সার্বিক দিকনির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্যই যার প্রমাণ।

যুদ্ধকালীন পুরোটা সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তান কারাগারে বন্দি। আর এ সুযোগটাকেই অপব্যবহার করে অনেকে কৃতিত্ব ভাগ-বাটোয়ারার পাঁয়তারা করেছেন। এ সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠেছিল ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। বিএনপি কর্তৃক যুদ্ধাপরাধী জামায়াত এবং তার দোসর শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে। তেমনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ‘সজীব ওয়াজেদ জয়ের’ নীরব বিপ্লব ডিজিটালাইজেশনের কারণে অবাধ তথ্য সংযোগের ফলে বাঙালির ‘একক আকাঙ্ক্ষার জায়গা যে শেখ মুজিব’, সেটাও এখন চারদিকে আরো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে।

মূলত ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে উল্টো পথে হাঁটানোর পরিকল্পনাই এই বিকৃত ইতিহাস নির্মাণের কারণ। তবে সত্য হলো, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ছিল একক শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন যে সরকার গঠন করা হয়েছিল, সেটার নামকরণও ছিল ‘মুজিব নগর সরকার’ এবং এর প্রধান ছিলেন শেখ মুজিব। অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাণভোমরাখ্যাত জনগণ তার নেতা শেখ মুজিবকে নিয়ে বিশ্বের বুকে ‘রাষ্ট্রযাত্রা’ শুরু করেছিল আগেই। শুধু বাকি ছিল পূর্ণ দখলমুক্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির।

রাষ্ট্রযন্ত্রের সংজ্ঞায়নে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক হেগেলের মতে, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সে হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘একক নেতৃত্বে’ বাঙালি আজ পরিপূর্ণভাবে সেই গৌরবের অধিকারী। এ বিষয়টি আরো স্পষ্টতর হয় প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধুর জীবনীকার ওবায়েদ-উল হকের ভাষায়, ‘যদি বাংলাদেশ একটি দৈহিক আকৃতি পায়, তবে তা হবে দেখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো।’

তবে সবচেয়ে কট্টর সত্য হলো, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়টায় যতক্ষণ এই বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধুর পদস্পর্শ পড়েনি, ততক্ষণ বাংলার স্বাধীনতা অপূর্ণই ছিল। ভিন্নভাবে বললে, শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ নাটক যেমন ডানকান চরিত্রবিহীন কল্পনা করা অসম্ভব, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর পদস্পর্শ ও অস্তিত্ববিহীন কল্পনা ছিল অসম্ভব। মূলত পাকিস্তান জেল থেকে মুক্ত হয়ে ফেরত আসার সময়টা ছিল নাটকীয় এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ।

কারণ পাকিস্তান সময় রাত ৩টায় রাওয়ালপিন্ডি ছাড়ার পর বেশকিছু সময় ধরে বঙ্গবন্ধুর বিমানের গন্তব্য অজানা থেকে যায়। যদিও পরে জানা যায় এটা বঙ্গবন্ধুর চাওয়াতেই হয়েছিল। তবু উত্কণ্ঠার ইয়ত্তা ছিল না বাঙালির। কারণ এত অল্প সময়ে এত প্রলম্বিত পরাজয় মেনে পাকিস্তানিরা বাঙালির শেখ মুজিবকে ফেরত দেবে তো? পরবর্তীতে এ উত্কণ্ঠার দালিলিক প্রমাণও মেলে। ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেও ইয়াহিয়া ভুট্টোকে অনুরোধ করেছিলেন ব্যাকডেটে শেখ মুজিবের ফাঁসির আদেশ দিয়ে তা কার্যকর করতে। অনেকেই এ সিদ্ধান্ত সংযোগে ভুট্টোর প্রেমে মজে যেতে পারেন! কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, শেখ মুজিবের কিছু হলে বাংলার মাটিতে আটকে পরা পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শরীরের একটা লোমও খুঁজে পাওয়া যেত না। কারণ তখন পর্যন্ত আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে আটক ছিল। শুধু এ কারণেই ভুট্টো ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন।

বিশ্ব বাঙালির নেতা শেখ মুজিবকে নিয়ে সরাসরি বিস্মিত হয় ব্রিটেন সরকার। কারণ সদ্য পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত শেখ মুজিব তখনো দেশে ফিরতে পারেননি বা আদৌ ফিরতে পারবেন কিনা জানেন না। অথচ সেখানে বসেই তিনি ব্রিটেন সরকারের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার আহ্বান করেন। অর্থাৎ দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় যেখানে যখন সুযোগ পেয়েছেন, বাংলার জনগণের জন্য কাজ করেছেন, লড়াই করেছেন।

যদিও শেখ মুজিবের এ আহ্বানে তাৎক্ষণিক কোনো সাড়া মেলেনি। তবুও ব্রিটেন যখন তার রাষ্ট্রীয় বিমানে বঙ্গবন্ধুকে ভারত হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে নিয়ে আসে, তাকেই এক ধরনের স্বীকৃতি ধরা যায়। তাছাড়া ভারতের বিমানবন্দরে দেশটির প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যে ২১ বার তোপধ্বনি এবং ১৫০ সদস্যের গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়, তার মাধ্যমে দেশে ফেরার আগেই বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অভিষেক ঘটে যায়। অর্থাত্ বাংলার জনগণের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বও তাকে বাংলাদেশের একক নেতা হিসেবে মেনে নেয়।

১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার আগে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান প্রায় ৪৫ মিনিট বাংলার আকাশ প্রদক্ষিণ করে। বঙ্গবন্ধু দেখেন তার সাজানো বাংলায় পাকিস্তানিদের চালানো লুট, ধ্বংস। আপ্লুত, চিন্তিত বঙ্গবন্ধু তাই রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে জনতার সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করেন। থেমে থেমে কথা বলেন এবং ৩৫ মিনিটের ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের জয়কে সমুন্নত রাখতে নিজেদের মাঝে একতা বজায় রাখার আহ্বান জানান।

এদিন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পরিবেশ ছিল আরো ভিন্ন রকম। উত্কণ্ঠা ও আবেগের সংমিশ্রণ ছাপিয়ে হাতে ফুল নিয়ে শেখ রাসেলের ‘আব্বু আসবে আব্বু আসবে’ ধ্বনি অনুরণিত ছিল সর্বত্র। এবারে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যখন আকাশ ভেঙে নেমে এলেন শেখ মুজিব। বাড়ির দরজায় পা রাখতেই আনন্দের লহমায় অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে পরিবারের সদস্যরা। বাবাকে সালাম এবং মাকে জড়িয়ে অস্তিত্বের স্পর্শ অনুভূত হয় সর্বত্র।

এর পরই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের সংগ্রাম। যেখানে নিহিত ছিল প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা। কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, খাদ্যনিরাপত্তা, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা। আর এ শিক্ষা শুধু কেতাবি শিক্ষা নয়। ছিল মানুষ হয়ে ওঠার এবং নিজেকে নিবেদন করার।

বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের লাগাম এখন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। যিনি সেই সোনার বাংলার স্বপ্ন বিনির্মাণে সংগ্রাম করে চলেছেন। কিন্তু এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন তখনই টেকসই হবে যখন জনগণ নিজেদের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা, সম্পর্ক আরো জোরদার করবে। আর এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়াস পারিবারিক শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজরদারির।

হায়দার মোহাম্মদ জিতু: প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ
[email protected]


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫