বিয়ের স্মরণীয় মুহূর্তগুলো বন্দি করতে ফটোগ্রাফারের বিকল্প নেই। আগের দিনে স্টুডিওতে যিনি পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলতেন, তারই ডাক পড়ত বিয়েবাড়িতে। সময় বদলেছে, কিন্তু বদলায়নি বিয়েবাড়ির ছবি তোলার হিড়িক। যার কারণে দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি। শিক্ষাজীবনের ফটোগ্রাফির নেশাকে অনেকেই পরিণত করেছেন পেশায়। শিক্ষাজীবনের শখের ফটোগ্রাফিকে পরবর্তী জীবনে পেশা হিসেবে নিয়ে সফল হয়েছেন এমন কয়েকজন আলোকচিত্রীর সাক্ষাত্কার নিয়েছেন উম্মে সালমা—
‘টাকা নয়, আগ্রহই মুখ্য’
সারতাজ আহমেদুর রহমান
ফটোগ্রাফার, পেনোরোমা
ফিল্মের ক্যামেরার ৩০টি গুনে গুনে ছবি তোলা থেকে ডিজিটাল ক্যামেরার ৫১২ মেগাবাইটের কার্ড আসতে আসতে ছবি তোলার আগ্রহটা নেশায় পরিণত হয়। যদিও বরাবর স্ট্রিট ফটোগ্রাফিতেই আগ্রহ ছিল কিন্তু কিছুটা কৌতূহলের কারণে ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে প্রবেশ।
‘পেনোরোমা’র বড় ভাইদের কাছেই মূলত ওয়েডিং ফটোগ্রাফির হাতেখড়ি। ফটোগ্রাফির আর দশটা ফিল্ডের মতো এতেও জানতে হবে ফটোগ্রাফির সাধারণ নিয়ম, উন্নত পদ্ধতি ও কলাকৌশল। ছাত্র অবস্থায় ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে আসতে অনেকেই ভয় পায়, কারণ এতে শুরুতে কিছুটা খরচ করতে হয়। কাজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাজের পরিমাণও বাড়বে। সেই টাকা জমিয়ে ধীরে ধীরে নতুন গিয়ার কেনা সম্ভব।
আমি মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) স্থাপত্য বিভাগে পড়ছি। ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে অনেক সময় বাসায় আসতে আসতে বেশ রাত হয়, যেটা ছাত্র অবস্থায় অনেক বাসায়ই মেনে নিতে চায় না। শুরু থেকেই বাসায় একটা পরিষ্কার ধারণা দিয়ে রাখলে খুব সহজেই এসব সমস্যা এড়ানো সম্ভব।
ওয়েডিং ফটোগ্রাফির জগত্টা বর্তমানে আমাদের দেশে অনেক বিশাল এবং তা আরো বড় হচ্ছে। অদম্য আগ্রহ, নতুন কিছু শেখার, নতুন কিছু করে দেখানোর এবং নিজের একটি ধরন তৈরি করার আগ্রহ সাহায্য করতে পারে এ ফিল্ডে অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে।
‘ফটোগ্রাফি কোনো পেশা হলো!’
সোহেল মাহমুদ
লিড ফটোগ্রাফার, কে’নাসিফ ফটোগ্রাফি
ফটোগ্রাফিতে আমার পথচলা শুরু ২০১১ সালে। এক প্রবাসী আত্মীয় আমাকে কলেজে পড়া অবস্থায় একটা ফিল্ম ক্যামেরা উপহার দেন। বাবা প্রতিদিন কলেজে আসা-যাওয়া করার জন্য যে টাকা দিত, সেটা জমিয়ে আমি ফিল্ম কিনে রাস্তাঘাট ও প্রকৃতির ছবি তুলতাম।
এআইইউবিতে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হওয়ার পর বন্ধু নাসিফের হাত ধরে ফটোগ্রাফির ডিজিটাল জগতে প্রবেশ করি। ২০১১ সালে আমি একটি নিকন ক্রপ সেন্সর ক্যামেরা কিনি প্রবাসী এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে। ২০১২ সালে প্রথম আমার তোলা ছবি একটি প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে আমি বন্ধু নাসিফের সাথে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি শুরু করলাম। ২০১৪ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি না খুঁজে ফটোগ্রাফিতে ক্যারিয়ার গড়ায় মনোনিবেশ করি। ২০১৬ সাল থেকে একজন প্রফেশনাল ওয়েডিং ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করি।
ওয়েডিং ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার শুরু থেকেই পরিবার থেকে বাধার সম্মুখীন হই। বন্ধু মহল থেকেও হাসিঠাট্টার পাত্র হতে হয়েছে। ফটোগ্রাফি একটি পেশা হতে পারে, সেটা তারা মেনে নিতে পারেনি।
বর্তমানে আমাদের দেশে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পাঠশালাসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ফটোগ্রাফির ওপর উচ্চশিক্ষা দিচ্ছে।
‘নেশা থেকে পেশা’
মহম্মদ সাকিয়াম
ফটোগ্রাফার, মহম্মদ সাকিয়াম’স ফটোগ্রাফি
একজন ফটোগ্রাফার হতে হলে সাধনা করতে হয়, লেগে থাকতে হয়। ২০১১ থেকে নেশার মতো ছবি তুলতাম, যা পেতাম তার ছবি তুলতাম। আমার এ আগ্রহ দেখে আব্বু এসএসসি পরীক্ষার পর একটা নিকন উ ৬০০ ক্যামেরা দেন আমার হাতে। পরিবার আমাকে সবসময় সমর্থন দিয়েছে। আম্মু, আব্বু, বোন, স্যার, ম্যাম, বন্ধু, বড় ভাই, ছোট ভাই—সবাই প্রতিনিয়ত সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ থেকে পেশাদার ফটোগ্রাফি শুরু করি। বর্তমানে বিইউবিটিতে আইন পড়ার পাশাপাশি মহম্মদ সাকিয়াম’স ফটোগ্রাফি নাম নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি ঢাকা, যশোর ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে।
পরিশেষে ইন্ডিয়ান ফটোগ্রাফার রঘুবীর সিংয়ের একটা কথা বলে শেষ করি। তার মতে, ফটোগ্রাফি অনেকটা খনি এলাকায় সোনা খোঁজার মতো। বারবার আপনি খুঁজতে থাকবেন এবং কখনো হয়তো ছোট এক টুকরা আপনি পেতে পারেন। তার মানে হলো এখানে পরিশ্রম ও ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই।
‘কলেজে থেকেই ছবি তুলতাম’
জাহিদ হোসেন রাফিন
ফটোগ্রাফার, ক্লিকার’স ল্যাব
কলেজে পড়ার সময়ে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতাম। এক বন্ধু দুবার জোর করে ছবি সাবমিট করায় একটা পুরস্কারও পেয়ে যাই। একটি পঞ্চম ল্যাবরেটরিয়ানস ন্যাশনাল সায়েন্স ফেস্টিভ্যাল ২০১৭, অন্যটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি অন ট্যুরিজম-২০১৮। এরপর নিজে ক্যামেরা কিনে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি শুরু করি। ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করতে অন্তত দুটি লেন্স দরকার হয়, আমার নিজের শুরুর দিকে একটিমাত্র লেন্স ছিল, অন্যটি পরিচিত এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ধার নিয়ে কাজ করতাম। তার নাম মেজবাহ-উল-আজীজ। ভাইয়া পেশায় ডাক্তার হলেও ফটোগ্রাফি করা তার শখ। আমার ফটোগ্রাফির অনেক কিছুই তার কাছ থেকে শেখা। এর আগে সাব্বির আহমেদ নামের একজন ভাইয়ার সঙ্গে তার ক্যামেরা দিয়ে ওয়েডিং ফটোগ্রাফি করতাম, এটা ২০১৪-১৫ সালের কথা।
বেশ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শুরু করলাম ক্লিকার’স ল্যাব। পড়াশোনা শেষ করে এ পেশায়ই আরো ভালো করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাব।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে রাফিনের তোলা ছবি