পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা ভরা প্রত্যাবর্তন

প্রকাশ: জানুয়ারি ১০, ২০২০

জহিরুল হক মজুমদার

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে আকাঙ্ক্ষাটি বাঙালি জাতির মনে জেগে উঠেছিল, তা হচ্ছে প্রিয় নেতাকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। তখনো চারদিকে লাশ, কান্না আর স্বজনের খোঁজে হাহাকার। জীবন পুরো মাত্রায় জেগে ওঠার সব প্রচেষ্টা শুরু হয়নি। সাঁঝবাতি জ্বলে ওঠেনি সব বাড়িতে। বুলেটবিদ্ধ ভাতের হাঁড়ি আর পুড়ে যাওয়া বসতির দিকে বোবা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকার প্রহর তখনো শেষ হয়নি।

সীমানার ওপারে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীরা অনেকেই ফিরেছে আবার কেউ কেউ ফেরার পথে। তাদের সংশয়ে দোল খাওয়া মন ভাবছে তাদের ঘরখানি কি টিকে আছে, নাকি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে?

প্রতিবেশীরা কি সবাই বেঁচে আছে? এত সব মানবিক পরিস্থিতির মধ্যেও কান্না, রক্ত, ঘাম আর ধ্বংসের মধ্যে জেগে ওঠা এক সাহসী ভূখণ্ডের মানুষেরা আবেগের এক তুমুল প্রকাশ দেখিয়েছিল তাদের প্রিয় নেতাকে নিজেদের মাঝে ফিরে পেয়ে। দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। আমাদের ইতিহাসে যা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে গ্রেফতার হন ২৫ মার্চ রাতের দ্বিতীয় প্রহরে রাত ১টা ৩০ মিনিটে। তখন সারা ঢাকা শহর জ্বলছে, চারদিকে চলছে গণহত্যাযজ্ঞ। অকুতোভয় মানুষটি নিজের মানুষদের ফেলে কোথাও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করেননি, যদিও রাজনৈতিক সহকর্মীদের দিক থেকে সেরকম অনুরোধ ছিল। গ্রেফতার হওয়ার আগেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তারপর তাকে বন্দি হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। ২৬ মার্চ এক বেতার ভাষণে সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি আরো বলেন, মুজিবকে বিচারহীনভাবে ছেড়ে দেয়া হবে না।

তার পরের নয় মাস তার ডাকে সশস্ত্র স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যায় বাংলার বীর জনতা। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে বিচারের নামে চলতে থাকে প্রহসন। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া সংকল্পবদ্ধ, এবার মুজিবকে আর ছাড়া যাবে না, মুজিবকে মরতে হবেই। তার এ সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল তার জেনারেলরা ও ক্ষমতালোভী শকুন জুলফিকার আলী ভুট্টোর সমর্থন।

এ জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার তত্কালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিজের কক্ষের জানালা দিয়ে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে দেখা যায়। বাঙালিকে দমিয়ে রাখতে পারার বিনোদন মাখা ক্রূর হাসি লেগে ছিল হয়তো এ দুষ্ট আত্মার চোখে-মুখে। ২৬ মার্চ করাচিতে ফিরে গিয়ে সাংবাদিকদের সামনে তার মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এসেছিল, ‘আল্লাহ পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন

কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণের পর বাঙালি এক নতুন সংজ্ঞায় সারা পৃথিবীর কাছে চিহ্নিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের সেই ডাক দাবায়া রাখতে পারবা না’, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দমায়ে রাখতে পারবে না’, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’—বাঙালি তার নিজের রক্তের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে। এ এক নতুন বাঙালি।

আর তাই ইয়াহিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই একই ভুট্টোকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ অসহায় ক্রোধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে কাগজ ছিঁড়তে দেখা যায়। জাতিসংঘের অন্য সদস্যদের দোষী করতে দেখা যায় তার দেশের পরিণতির জন্য। নিরাপত্তা পরিষদের ভাষণে তিনি আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়ার অভিযোগ তোলেন নিরাপত্তা পরিষদের বিরুদ্ধে এবং ভুট্টো তার আমলা পরিষদসহ ওয়াক আউট করেন অধিবেশন থেকে।

আর যাওয়ার আগে তিনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ারও হুমকি দেন। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে নিয়াজির পরাজয়ের দলিল স্বাক্ষরের ভেতর দিয়ে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয় আর ভুট্টো ইয়াহিয়া চক্রের সব দম্ভের অবসান ঘটে। বাংলাদেশ কখনো ভুট্টোদের দেশ ছিল না। বাংলাদেশ বাঙালির।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নামটি বঙ্গবন্ধুর নিজের দেয়া। ১৯৬৯-এর ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তান’-কে বাংলাদেশ নামে ডাকা হবে। বঙ্গবন্ধুর যুক্তি ছিল সহজবোধ্য। ফেডারেল পাকিস্তানের অন্য প্রদেশগুলো যদি নিজেদের আলাদা নামে ডাকতে পারে, তাহলে এ অংশের নাম কেন হবে পূর্ব পাকিস্তান।

যদি সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব কিংবা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আলাদা আলাদা নাম হয়, তাহলে আমাদের মাতৃভূমির নাম পূর্ব পাকিস্তান হতে হবে কেন? কেন বাংলাদেশ নয়? বঙ্গবন্ধু খেদ প্রকাশ করেন যে শুধু বঙ্গোপসাগর এর নাম ছাড়া কোথাও বাংলা বা বেঙ্গল দেখা যাচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫  সালের ২৫ আগস্ট কনস্টিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে ইস্ট বেঙ্গল’-এর নাম ইস্ট পাকিস্তান করার প্রতিবাদ করেন। ৭ মার্চের ভাষণের মাঠের সেই যোদ্ধা জনতাও নেতার উপস্থিতিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে স্লোগানে বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর

২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে নিঃশর্তে মুক্তি পাওয়ার পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’-এর উদ্যোগে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নেতাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পরিষদের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ উপাধি প্রদান করেন। তার পর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত বঙ্গ শব্দটি নিজ নামের সাথে বহন করে চলেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

যদিও সাহিত্যে ও কাব্যে বাংলাদেশ শব্দটির ব্যবহার আগেই লক্ষ করা যায়। সন্দেহ নেই যে একটি দেশের জন্ম প্রথমে কবির কল্পনাতেই হবে। আর রাজনীতিবিদ সেই কল্পরাষ্ট্রকে একদিন বাস্তব হিসেবে মানুষের জন্য নির্মাণ করবেন, মানুষকে সাথে নিয়ে। আর এভাবেই একজন রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন রাজনীতির কবি। বঙ্গবন্ধু নিঃসন্দেহে একজন রাজনীতির কবি।

সামরিক আদালতে ১২টি অভিযোগ আনা হয় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। ছয়টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়। তার মধ্যে অন্যতম অভিযোগ ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করা এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।

সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হয় ১৯৭১-এর ১১ আগস্ট। বিচারের স্থান ছিল লায়ালপুর জেলের অভ্যন্তর। ২ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বিচারের জন্য সামরিক আদালত গঠিত হয়। একই দিনে এ বিষয়ে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার একটি প্রেস রিলিজ দেয়। তাতে বলা হয়, মুজিব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তার বিচার করা হবে। তারপর ৩ আগস্ট জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য মুজিবের বিচার করা হবে।

এ বিচার শুরু হওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি চারদিনের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে ১৬ অগাস্ট দিল্লিতে এক প্রেস কনফারেন্সে এ বিচারের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি এ বিচারকে যেকোনো মানদণ্ডে আন্তর্জাতিক আইনের চূড়ান্ত লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মুজিবের একমাত্র অপরাধ নির্বাচনে জেতা।

কিন্তু বিচারটি চলতেই থাকে। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা বিশ্বজনমতের চাপ এড়ানোর জন্য এ বিচারের প্রক্রিয়া ও রায় সারা পৃথিবীর কাছে গোপন রাখে। কিন্তু চূড়ান্ত যুদ্ধে পরাজয় টের পেয়ে ইয়াহিয়া ৪ ডিসেম্বর সারা পৃথিবীর কাছে বিচারের রায় প্রকাশ করেন। সে বিচারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর জেল থেকে ইসলামাবাদের মিয়ানওয়ালি জেলে স্থানান্তর করা হয় এবং তার সেলের পাশে একটি কবর খোঁড়া হয়। চতুর ভুট্টো যদিও সাধু সাজার জন্য পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাসিকে বলেছিলেন, এটা কবর ছিল না। এটা ছিল এয়ার রেইড শেল্টার। এটি ছিল ভুট্টোর চূড়ান্ত মিথ্যাচার।

একাত্তরের অক্টোবরে ইয়াহিয়া খান ইরানের রাজতন্ত্রের ২ হাজার ৫০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তেহরান যাওয়ার প্রাক্কালে জুলফিকার আলী ভুট্টো মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য ইয়াহিয়ার ওপর চাপ তৈরি করেন। তিনি এ যুক্তি দেন যে তেহরানে অনেক দেশের সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন। তারা মুজিবের মুক্তির জন্য ইয়াহিয়ার ওপর চাপ তৈরি করতে পারেন। তার আগেই মুজিবকে শেষ করে দিতে হবে।

একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণের মুখে বিপর্যস্ত ইয়াহিয়া পরাজয় টের পেয়ে বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। লায়ালপুর থেকে মিয়ানওয়ালি জেলে স্থানান্তরের পরও ঘটনার পরিক্রমায় পরিস্থিতি আর ইয়াহিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। মিয়ানওয়ালি জেলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের একটি বিশেষ টেলিগ্রাম আসার কথা ছিল প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়ার কার্যালয় থেকে। কিন্তু পরাজয়ের ধাক্কা সামলাতে ব্যস্ত ইয়াহিয়া আর সেই বিশেষ টেলিগ্রামটি করে উঠতে পারেননি।

বঙ্গবন্ধুর বিচার সামরিক আদালতে হওয়ায় উচ্চতর আদালতে আপিল করার কোনো সুযোগ ছিল না। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের স্বাক্ষরই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের শেষ ধাপ ছিল। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পরাজয়ের দলিল স্বাক্ষর করে পাকিস্তানি বাহিনী। জেনারেলদের হাত করে ক্ষমতা নিয়ে নেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। প্রথমে জঙ্গলের মধ্যে একটি নির্জন বাংলো এবং পরবর্তী সময়ে নিজ বাড়িতে গৃহবন্দি হন জেনারেল ইয়াহিয়া। জনরোষে আক্রান্ত হয় বাংলার কসাই জেলারেল টিক্কা খানের বাড়ি।

সারা পৃথিবী থেকে মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরের বিবেকবান নাগরিক সমাজও মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে চাপ দিতে থাকেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পরাজয়ের পর ভুট্টো ভীত হয়ে পড়েন যে ইয়াহিয়া কি এরই মধ্যে মুজিবকে হত্যা করেছে? তাহলে বাংলাদেশে এ খবর পৌঁছলে সেখানে বন্দি হয়ে থাকা প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতি মুক্তিবাহিনী কোনো প্রকার যুদ্ধবন্দির সম্মান বা করুণা প্রদর্শন না করার সম্ভাবনাই বেশি। তাদের জীবিত ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ভুট্টো নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে ব্যস্ত থাকার কারণে সর্বশেষ কয়েক দিন মুজিবের অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।

ভুট্টো পাকিস্তানে ফিরে আসেন ১৮ ডিসেম্বর। ভুট্টোর চাপাচাপিতে ইয়াহিয়া স্বীকার করেন যে মুজিব এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু ইয়াহিয়া এটাও বলেন যে প্রাণ থাকতে তিনি মুজিবকে জীবিত ফেরত দেবেন না। ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ভুট্টো। পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর ইয়াহিয়াকে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে চাইছিল না। দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় মরিয়া ইয়াহিয়া ভুট্টোকে প্রস্তাব দেন পেছনের তারিখ দেখিয়ে মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানো যায় কিনা। কিন্তু ভুট্টো অস্বীকৃতি জানান।

ক্ষমতা হারানোর শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা জেলের অন্য কয়েদিদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্ত করে। মিয়ানওয়ালি জেলে কয়েদিদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে বাংলাদেশে নিয়াজিকে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিশোধ হিসেবে মুজিবকে হত্যা করতে হবে। চক্রান্তের পরিকল্পনা ছিল ভোর ৬টায় কয়েদিদের সেল খুলে দেয়া হবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর সেলে আক্রমণ চালাবে। কিন্তু জেলার হাবীব আলীর সহূদয়তায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে যান। জেলার ভোর ৪টার সময় বঙ্গবন্ধুকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান এবং বঙ্গবন্ধু সেখানে দুদিন অবস্থান করেন।

সারা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মাধ্যমগুলো ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ পৃথিবীর বিবেকবান উদ্বিগ্ন মানুষদের জানিয়ে দেয় যে মুজিব বেঁচে আছেন। স্বস্তি পায় সারা পৃথিবী। কিন্তু অপেক্ষার এক দীর্ঘ প্রহর শুরু হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, বঙ্গবন্ধুর নিজের মানুষদের মাঝে। কবে নেতা ফিরে আসবেন? নেতার ফিরে আসা ছাড়া এ স্বাধীনতা অর্থহীন।

এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির সিহালার একটি বাড়িতে সরিয়ে নেয়া হয় এবং তাকে সেখানে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ক্ষমতা সংহত করে সেখানে দেখা করতে হাজির হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ২৩ ও ২৭ ডিসেম্বর দুদফায় বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধুর সাথে। ভুট্টোকে প্রথমবার দেখে বঙ্গবন্ধু বিস্ময় প্রকাশ করেন, ভুট্টো আপনি এখানে কেন? ভুট্টো জানান যে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধু শ্লেষাত্মক হাসি দিয়ে বলেন, সেই ম্যান্ডেট তো আমার ছিল, আপনি কোন যোগ্যতায়? বিব্রত ব্যক্তিত্ব হারানো ভুট্টো উচ্চারণ করেন যে তিনি পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও বটে। যেন একজন বন্দিকে ভয় দেখানোর চেষ্টা। আসলে এটি ছিল ভুট্টোর নিজের হারানো ব্যক্তিত্ব ফিরে পাওয়ার কষ্টকল্পিত চেষ্টা। বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ হাসি ছিল কৌতুকমাখা।

ভ্রাতৃত্বের দোহাই, কোনোভাবে দুই পাকিস্তানকে এক রাখার চেষ্টা, ভুট্টোর সরকারে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হওয়া কিংবা অন্তত কনফেডারেশন এ রকম অনেক উদ্ভট প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শুধু বলেন, আমার মানুষদের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া আমি কিছুই বলতে পারব না। বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে প্রিয় শব্দ আমার মানুষ

করাচিতে নীতিনির্ধারকদের সাথে এক বৈঠকে ১ জানুয়ারি ১৯৭২-এ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে ভুট্টো সিদ্ধান্ত নেন বলে জানা যায়। কিন্তু সঠিক তারিখটি গণমাধ্যমকে জানাননি তিনি। তারপর ৩ জানুয়ারি করাচিতে লাখো মানুষের এক উন্মুক্ত জনসভায় ভুট্টো পাকিস্তানের জনগণের সম্মতি আদায় করে নেন মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে।

ভুট্টোর প্রশ্নের জবাবে জনতা চিত্কার করে জবাব দেয়, হ্যাঁ আমরা মুজিবের মুক্তি চাই। ভুট্টো স্বস্তির সাথে উচ্চারণ করেন শুকরিয়া। সামরিক চক্রের হত্যার জিঘাংসা থেকে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করার জন্য এ জনসম্মতিই ছিল ভুট্টোর প্রধান সম্বল। আসলে তিনি চাইছিলেন মুজিবের প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্যের নিরাপত্তা।

৮ জানুয়ারি ১৯৭২-এ ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। রাওয়ালপিন্ডির চাকলালা বিমানবন্দর থেকে পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু রওনা হন লন্ডনের উদ্দেশে। তখন রাত ৩টা।

৭ জানুয়ারি সন্ধ্যাবেলা ডিনার টেবিলে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেন যে ইরানের শাহ আসছেন। তাই নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ ও সুরক্ষিত রাখা হয়েছে। ভুট্টো প্রস্তাব করেন যে এ পরিস্থিতিতে মুজিব তার দেশে ফেরা বিলম্বিত করতে পারেন কিনা। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন যে মরিয়া ভুট্টো শাহর মাধ্যমে তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন দুই পাকিস্তানের কোনো সম্পর্কসূত্র রাখার ব্যাপারে। বঙ্গবন্ধু বলেন যে আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। আপনি চাইলেই পাকিস্তানের আকাশসীমা আবার খুলতে পারে। ভুট্টোর শেষ চেষ্টাটিও ব্যর্থ হয়।

যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধু গৃহবন্দি ছিলেন সেখান থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন রেড ক্রসের একটি বিমানে নিরপেক্ষ কোনো দেশে পৌঁছতে। সেখান থেকে তিনি নিজের মানুষদের কাছে পৌঁছবেন। শেষ পর্যন্ত রেড ক্রসের বিমান সংস্থান করতে পারেননি ভুট্টো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সম্মতিতেই তার লন্ডন যাত্রার ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল ইরান কিংবা তুরস্ক যাওয়ার। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। লন্ডনের প্রস্তাবটি তিনি গ্রহণ করেন।

চাকলালা বিমানবন্দর ছিল নিরাপত্তার চাদরে ঘেরা। আর বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছার পর ভুট্টো গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করেন যে মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয়েছে এবং তিনি এখন লন্ডনে। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রস্থানের ১০ ঘণ্টা পর। বিমানে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী ছিলেন ড. কামাল হোসেন এবং তার পরিবার। আরো ছিলেন পাকিস্তানের বিমান বাহিনী ও বিমান চলাচল দপ্তরের করেকজন কর্মকর্তা।

লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু পৌঁছেন ৮ জানুয়ারি ভোরবেলা। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর আগমন সংবাদ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পায় বঙ্গবন্ধুর বিমান অবতরণের ১ ঘণ্টা আগে। হইচই পড়ে যায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের সাউথ এশিয়া ডেস্কে। তারা সিদ্ধান্ত নেন যে বঙ্গবন্ধুকে পূর্ণ রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা দেয়া হবে। বিমানবন্দরে দৌড়ে যান সাউথ এশিয়া ডেস্কের সচিব স্যার ইয়ান সাদারলেন্ড। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তার অবকাশ বাতিল করে ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফিরে আসেন।

ভোরবেলা নিজের গাড়ি চালিয়ে হিথরো বিমানবন্দরে হাজির হন বাংলাদেশী কূটনীতিক এমএম রেজাউল করিম। ভিআইপি লাউঞ্জে প্রবেশ করে বঙ্গবন্ধু এবং ড. কামাল হোসেনকে দেখতে পান রেজাউল। কূটনীতিক রেজাউলকে দেখে স্বস্তি বোধ করেন পাকিস্তানি কর্মকর্তারা। তারা বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট দিয়ে বিমান নিয়ে ফেরত যান।

বঙ্গবন্ধুর জন্য ব্রিটিশ সরকারের পাঠানো লিমোজিন গাড়িটি বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু উঠে পড়েন বাংলাদেশী তরুণ কূটনীতিক রেজাউল করিমের ব্যক্তিগত গাড়িতে। নিজের দেশ আর মানুষ নিয়ে কথার ঝরনাধারা বইয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মানুষটির চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও তিনি ছিলেন অসম্ভব হাস্যোজ্জ্বল।

বঙ্গবন্ধু অবস্থান করেন ক্ল্যারিজেস হোটেলে। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে কথা বলেন ঢাকায় তার পরিবারের সদস্যদের সাথে, বিশেষ করে শিশু রাসেলের সাথে, তার রাজনৈতিক সহচর ও প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। এরই মধ্যে গণমাধ্যমের মারফত জানতে পেরে হোটেল এবং আশপাশের রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। বিলেতের বাঙালি কমিউনিটির লোকজন, প্রিয় নেতাকে একবার দেখতে চায় তারাবঙ্গবন্ধুর আমার মানুষেরা। বঙ্গবন্ধু হোটেলের বারান্দায় এসে তাদের দিকে হাত নাড়েনএক সূর্য মাখা হাত, নিজের মানুষদের জন্য ভালোবাসা মাখা হাত।

বঙ্গবন্ধু ক্ল্যারিজেস হোটেলে প্রেস কনফারেন্সে বিবিধ গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। সাংবাদিকদের

তিনি জানান যে তিনি জীবিত ও সুস্থ আছেন। তিনি আরো

জানান যে তার জনগণ যে মহাকাব্যিক স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তি অর্জন করেছে, তার বাঁধভাঙা আনন্দ তিনি সবার সাথে ভাগাভাগি করতে পেরে খুব ভালো অনুভব করছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ও লেবার পার্টির বিরোধীদলীয় নেতা হ্যারল্ড উইলসনের সাথে তার বৈঠকের কথাও সাংবাদিকদের জানান।

বঙ্গবন্ধু প্রেস কনফারেন্সের আগেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে বৈঠক করেন তার কার্যালয়ে। বাংলাদেশের স্বীকৃতি আর বিবিধ সহযোগিতা নিয়ে কথা বলেন। পাকিস্তানের সাথে ন্যূনতম সম্পর্কসূত্র রাখার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে প্রধানমন্ত্রী হিথকে সাফ জানিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু। প্রধানমন্ত্রী হিথ অফিস থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গাড়ির দরজা খুলে দেন এবং ততক্ষণ পর্যন্ত দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন, যতক্ষণ না মুজিব আরাম করে তার আসনে বসেছেন।

এ বিষয়ে হিথকে ব্রিটেনের রক্ষণশীল নাগরিকদের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিথ তার নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে সাফ জানিয়ে দেন যে তিনি যা করেছেন তা সঠিক ভেবেই করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিথের সাথে বৈঠকের ভিত্তিতেই হিথ পরবর্তী সময়ে বিশেষ বার্তায় প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে মুজিবের মনোভাব জানিয়ে দেন যে পাকিস্তানের সাথে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ন্যূনতম সম্পর্কসূত্র থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।

প্রধানমন্ত্রী হিথের সাথে বৈঠকে মুজিব তাকে একটি বিশেষ বিমান দেয়া যায় কিনা এ প্রস্তাব করেন। তিনি ছিলেন তার নিজের মানুষদের কাছে ফেরার জন্য উদগ্রীব। প্রধানমন্ত্রী হিথের সম্মতিতে রয়েল এয়ার ফোর্সের একটি বিশেষ বিমান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাত্রা করে দিল্লির উদ্দেশে।

বিমানে তার সহযাত্রী ড. কামাল হোসেন, তার স্ত্রী হামিদা হোসেন, লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের প্রথম সচিব ভেদ মারওয়া এবং লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব ও পলিটিক্যাল অফিসার শশাঙ্ক ব্যনার্জি। শশাঙ্কের বর্ণনায় জানা যায় যে বঙ্গবন্ধু বিমানের মধ্যেই আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গানটি গাইছিলেন এবং তার চোখে ছিল জল। তিনি বিমানে বসেই গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে বলে জানান শশাঙ্ককে। তিনি বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে বিমানের মধ্যেই আলাপ করেন বলে জানাচ্ছেন শশাঙ্ক।

বঙ্গবন্ধু দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে অবতরণ করেন ১০ জানুয়ারি সকালবেলা। সেখানে তাকে সাদরে গ্রহণ করতে উপস্থিত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা, তিন বাহিনী প্রধান ও ভারত সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ। ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানানো হয়।

এর মধ্যেই বিমানবন্দরের লাউঞ্জে আলাপে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়টি ইন্দিরাজিকে বলেন। ইন্দিরা গান্ধীও সহাস্য সম্মতি প্রদান করেন। দিল্লির পালাম বিমানবন্দরের আশপাশে ছিল উত্সুক জনতার ভিড়। দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভারত সরকারের কর্মসূচি ছিল অনেক দীর্ঘ। বঙ্গবন্ধু সেই কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করার অনুরোধ করেন। সেটাও তার

সোনার বাংলা আর তার মানুষদের কাছে দ্রুত ফেরার তাগিদেই।

বঙ্গবন্ধুকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য দিল্লির প্যারেড গ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। চারদিকে জনতার হর্ষধ্বনি শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করেন ইংরেজিতে। কিন্তু জনতা চিত্কার করে ওঠে নেতার কণ্ঠে বাংলায় বক্তৃতা শোনার জন্য। বঙ্গবন্ধু বাংলায় বক্তৃতা করেন।

শুরু করেনআমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা, এ সম্বোধন দিয়ে। কৃতজ্ঞতা জানান ভারত সরকার আর ভারতের জনগণের প্রতি। নিজেদের দুঃখ-কষ্ট থাকার পরও এক কোটি মানুষকে খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করার জন্য তিনি ভারতের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষায় মিসেস গান্ধীর সারা পৃথিবীময় কূটনীতির জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। মিসেস গান্ধীর সাথে তার মতাদর্শিক মিলের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে। প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার রাস্তা ছিল হাজার হাজার লোকে লোকারণ্য। একটি বিমান নিম্ন উচ্চতায় উড়ে উড়ে ফুলের পাপড়ি বর্ষণ করছিল।

শশাঙ্কের বয়ানে জানা যায় যে লন্ডন থেকে বিমানযাত্রার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে কলকাতা যাওয়ার আমন্ত্রণবার্তা পাঠান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়। কলকাতার মানুষ বঙ্গবন্ধুকে দেখতে উদগ্রীব ছিলেন। বঙ্গবন্ধুও তার মানুষদের কাছে ফিরে আসতে উদগ্রীব ছিলেন। তাই এ প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের বিমানটি ঢাকার আকাশে দেখা দেয় ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বেলা ১টা ২০ মিনিটে। তার ২০ মিনিট পর তিনি বিমান থেকে নেমে আসেন। দিনটি ছিল সোমবার। জনতার ১০ মাসের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে নেতা ফিরে আসেন তার দেশে, তার মানুষদের মাঝে। বিমানবন্দরে তাকে বরণ করে নেন তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীরা, তার প্রবাসী সরকারের সদস্যরা, স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা।

আরো উপস্থিত ছিলেন বিবিধ দেশের কূটনীতিকরা, ছিলেন মিত্রবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গার্ড অব অনার প্রদান করে তিন বাহিনী। তোপধ্বনি করা হয় ৩১ বার। তারপর তাকে বহন করে একটি খোলা ট্রাক এগিয়ে চলে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের দিকে। ২৯০ দিনের কারাজীবন আর ফাঁসির মঞ্চ পেছনে ফেলে নেতা এগিয়ে চলেছেন জনতার জোয়ারের ভেতর দিয়ে।

চারদিক লোকে লোকারণ্য। প্রিয় নেতাকে একবার দেখার বাসনায় দূর-দূরান্ত থেকেও লোকজন এসেছে। দেশজুড়ে রাস্তাঘাট তখনো অচল, ব্রিজ-কালভার্ট সব ভেঙে পড়ে আছে। এখানে সেখানে লাশ পড়ে আছে, পড়ে আছে পরিত্যক্ত যুদ্ধাস্ত্র অথবা ভয়ানক মাইন। সেসব বাধা ডিঙিয়ে মানুষ এগিয়ে এসেছে প্রিয় নেতাকে বরণ করে নিতে। চারদিক স্লোগানে মুখরিত। শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, জয় বাংলা স্লোগানে প্রকম্পিত আকাশ-বাতাস। পুলিশ ব্যারিকেড ভেঙে নেতার সাথে একটু হাত মেলানো কিংবা নেতাকে জড়িয়ে ধরার আবেগে উদ্বেল ছিল জনতা। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স মাত্র পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। প্রায় ২ ঘণ্টা লেগে যায় লাখো জনতার স্রোত পেরিয়ে পৌঁছতে। নেতা পৌঁছেন সাড়ে ৪টায়। এবিসি নিউজের সাংবাদিক রন মিলারের রিপোর্টমতে প্রায় ১০ লাখ লোকের সমাবেশ হয়।

জনতার উদ্দেশে ভাষণে উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের স্মৃতি। বক্তৃতার শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শহীদ ছাত্র, শ্রমিক, সেপাই আর সাধারণ মানুষদের আত্মার মঙ্গল কামনা করেন। তিনি আবেগী কণ্ঠে বলেন, আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার মনের আশা পূর্ণ হয়েছে। আমার বাঙালি আজ মুক্তি পেয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু কবি গুরুর উদ্দেশে চিত্কার করে বলে ওঠেন, হে কবি, আপনি বলেছিলেন, সাত কোটি সন্তানেরে হে বঙ্গ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি। আপনি এসে দেখে যান আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম। বাংলাদেশকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

এভাবেই নেতার প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করে। নেতার দুই চোখে লাখো জনতার ছবি আর লাখো জনতার চোখে নেতার ছবি, ৭ মার্চ ১৯৭১-এর পর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। এভাবেই জনতার হূদয়ে এক নতুন দেশের মানচিত্র পরিপূর্ণভাবে আঁকা হয়ে যায়।

 

জহিরুল হক মজুমদার: শিক্ষক, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫