পাম আবাদে উজাড় ৬৩ লাখ হেক্টর বন

প্রকাশ: ডিসেম্বর ০৩, ২০১৯

পাম অয়েল। বিশ্বব্যাপী ভোজ্যতেলের বাজারে যার হিস্যা ৫০ শতাংশের বেশি। বৈশ্বিক বাজারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জায়ন মার্কেট রিসার্চের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে পাম অয়েলের বৈশ্বিক বাজার ছিল ৬ হাজার ৫৭৩ কোটি ডলারের সমান। আর ২০২১ সালে ভোজ্যতেলটির বাজার দাঁড়াতে পারে ৯ হাজার ২৮৪ কোটি ডলারের সমান। যেখানে ২০১৬-২১ সালের মধ্যে চক্রবৃদ্ধি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে ভোজ্যতেলের বাজারে আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী জ্বালানি হিসেবেও বাড়ছে পাম অয়েলের আধিক্য। পরিবহন খাতে জ্বালানি হিসেবে পাম অয়েল থেকে উৎপাদিত বায়োডিজেল ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। এর মধ্যে ব্রাজিলে ২০২৩ সাল নাগাদ জ্বালানি খাতে বায়োডিজেলের হিস্যা ১৫ শতাংশ নিয়ে যেতে কাজ করছে। এছাড়া শীর্ষ পাম অয়েল উৎপাদক দেশ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়ও বাড়ছে বায়োডিজেলের ব্যবহার। এরই মধ্যে ইন্দোনেশিয়া পরিবহন খাতে ব্যবহূত জ্বালানির ২০ শতাংশ পাম অয়েল থেকে উৎপাদিত বায়োডিজেল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। আর ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জ্বালানি পণ্যটির ব্যবহার বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করবে দেশটি। অন্যদিকে দ্বিতীয় শীর্ষ পাম অয়েল উৎপাদক দেশ মালয়েশিয়াও বায়োডিজেলের ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে। বর্তমানে দেশটিতে মোট জ্বালানির ১০ শতাংশ বায়োডিজেল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যেখানে আগামী বছর থেকে ব্যবহার বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করবে দেশটি। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে বায়োডিজেলের ব্যবহারও দ্রুত বাড়ছে। ২০১৭ সালে এ অঞ্চলের বায়োডিজেলের ব্যবহার ছিল ১ কোটি ৫৪ লাখ টন জ্বালানি তেলের সমান, যা ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেলের সমান। সে হিসাবে ব্যবহার বেড়েছে ১০ দশমিক ১ শতাংশ। আগামীতে ইউরোপের বাজারে জ্বালানি পণ্যটির ব্যবহার আরো বেশি বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া এ অঞ্চলে আমদানি হওয়া পাম অয়েলের অর্ধেকেরও বেশি ব্যবহার হয় বায়োডিজেল তৈরিতে। এত গেল পাম অয়েলের উৎপাদন ও সম্ভাবনাময় বাজারের তথ্য। তবে এর বাইরে পাম অয়েল উৎপাদন কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী ক্ষতিকর প্রভাবও কম নয়। এর কারণ হলো পাম চাষ কেন্দ্র করে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।

বিশ্বব্যাপী পাম অয়েলের ৮৫ শতাংশের বেশি উৎপাদন হয় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়। দেশ দুটিতে পাম আবাদ কেন্দ্র করে প্রতি বছরই বন নিধন বাড়ছে। এতে বাড়ছে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন।

ফ্যাক্টস অব ইন্দোনেশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার অর্ধেকের বেশি বন এখন নিধনের পথে। ১৯৬০ সালে দেশটিতে ৮২ শতাংশই ভূমিতে বনায়ন ছিল, যা ১৯৮২ সালে কমে ৬৮ শতাংশে ও ১৯৯৫ সালে ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে। আর বর্তমানে দেশটিতে ৪৯ শতাংশ ভূমিতে বনায়ন রয়েছে। আর হুমকির কথা হলো, দেশটিতে বন নিধন থেমে নেই। দেশটির বন উজাড়ের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো পাম আবাদ। সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ফরেস্টি রিসার্চের (সিআইএফওআর) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে অবস্থিত জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বোর্নিও দ্বীপে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাম আবাদের জন্য ৩৯ শতাংশ বন নিধন করা হয়েছে। আর দেশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়া অংশের ৩৫ শতাংশ ও মালয়েশিয়ার অংশের ৪৬ শতাংশ বন উজাড় করে পাম আবাদ করা হয়েছে। আর শীর্ষ উৎপাদক দেশ দুটিতে মোট ৬৩ লাখ হেক্টর বনভূমি কেবল পাম আবাদের জন্য নিধন করা হয়েছে।

এছাড়া ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি বছর ১০ লাখ হেক্টর বনভূমি নিধন করা হয় পাম চাষের জন্য। এছাড়া পাম অয়েল ফিল্ড ও খাতসংশ্লিষ্ট অবকাঠামো তৈরির জন্যও বন নিধন করা হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটিতে প্রতি বছর প্রায় ১৬ শতাংশ বন নিধন করা হচ্ছে শুধু পাম খাতের জন্য।

গ্রিনপিচের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বন নিধন হওয়া দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া অন্যতম। গত অর্ধশতকে দেশটি থেকে প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার ৭০০ মাইল রেইনফরেস্ট ধ্বংস হয়েছে।


এ অবস্থায় ইন্দোনেশিয়ার সরকার বন নিধন করে পাম খাতকে সম্প্রসারণ বন্ধে নতুন করে উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পরিবেশ ও বনমন্ত্রী সিতি নুরবায়া বাকের। তিনি জানান, প্রেসিডেন্ট উইডোডো বন নিধন করে পাম অয়েল চাষের ওপর নিষেধাজ্ঞার সয়মসীমা ও পরিধি বাড়াতে পারেন। কারণ তিনি মনে করেন এর মাধ্যমে বন নিধন কমবে। তিনি দাবি করেন, ২০১১-১৮ সাল পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা এসব এলাকায় বন নিধন ৩৮ শতাংশ কমেছে।

তবে পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিচ অবশ্য বলছে, এ সময়ের মধ্যে এ এলাকায় ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার বন নিধন করা হয়েছে। ২০১১ সালের পর থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ছবি সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ তথ্য জানায় সংগঠনটি।

এসব তথ্য-উপাত্তের মধ্য দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট, বন নিধন বন্ধ করতে জাকার্তা এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। বরং এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ইন্দোনেশিয়ায় আরো বন উজাড় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালের তথ্য বলছে, ইন্দোনেশিয়ায় পাম আবাদের জন্য প্রতি হেক্টর বন উজাড়ের বিপরীতে ১৭৪ টন কার্বন নষ্ট হয়ে যায়। এমন বেপরোয়াভাবে বন উজাড় চলতে থাকলে ২০১৮ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দেশটি, সেটি কার্যত বাস্তবতার মুখ দেখবে না। বরং বৈশ্বিক জলবায়ু উষ্ণায়ন বৃদ্ধিতে অন্যতম অংশীদার হয়ে থাকবে পাম অয়েল উৎপাদনের শীর্ষ দেশ ইন্দোনেশিয়া।

 

ঁ আল আমিন হুসাইন

সূত্র: রয়টার্স, ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্ট


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫