চীন ও আমেরিকা কি কোনো চুক্তিতে আসতে পারে?

প্রকাশ: অক্টোবর ১৮, ২০১৯

কেভিন রাড

প্রতিষ্ঠার ৭০ বছর পূর্তির উদযাপন শেষে চীনের এখন উচিত আমেরিকার সঙ্গে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। দ্বন্দ্বটি বোধকরি সুনির্দিষ্ট একটি পরিণতির দিকে ধাবমান। আলোচনার পরবর্তী পর্বটি হয়তো সত্যিকার অর্থেই বাণিজ্য, প্রযুক্তি আর বিস্তৃত অর্থনৈতিক জটিলাবস্থা থেকে উপায় খুঁজে নেয়ার শেষ সুযোগ হতে পারে, যে সমস্যাগুলো উভয় দেশকে বর্তমানে গ্রাস করে চলেছে। 

এ পর্যায়ে ব্যর্থ হলে ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার বিষয়টি স্মরণে নিয়ে গোটা বিশ্বের অনিশ্চিত ও নড়বড়ে এক অর্থনৈতিক যাত্রার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে বাস্তব ঝুঁকিটা হচ্ছে আমেরিকা মন্দার দিকে ঝুঁকবে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি বড় ধরনের বিযুক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে, যা ভবিষ্যতে সুস্পষ্টভাবেই চীন-আমেরিকার সম্পর্কের মধ্যে আরো বেশি তিক্ততার বিষ ঢেলে দেবে। এভাবে অনিবার্য দ্বন্দ্বের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে বিষয়টি তখন উভয় দেশের জাতীয়তাবাদী সমর্থকদের জন্য নতুন সুযোগের দুয়ার হিসেবে কাজ করবে। 

বাণিজ্যযুদ্ধ এখন পর্যন্ত চারটি পর্যায় অতিক্রম করেছে। প্রথম পর্বের সূচনা হয় গত বছরের মার্চে, যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম দফায় চীনা পণ্যসামগ্রীর ওপর শুল্কারোপ করে বসেন। দ্বিতীয় পর্বের শুরু হয় গত ডিসেম্বরে আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ারসে জি২০ সম্মেলনের প্রাক্কালে; ট্রাম্প আর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ৯০ দিনের মধ্যে এ-বিষয়ক একটি চুক্তিতে যাবেন বলে ঘোষণা দেন। তবে চলতি বছরের মে মাস নাগাদ সব আলোচনা ভেস্তে যায় এবং উভয় পক্ষের তরফ থেকে পরস্পরের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তে চুক্তির খসড়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনার অভিযোগ আনা হয়। তৃতীয় পর্যায়কে বর্ণনা করার সেরা উপায়টা হচ্ছে একেউষ্ণ দিনের অসন্তোষ হিসেবে ব্যাখ্যা করা। এ পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ফের আমদানি শুল্ক আরোপ করে। চীনও থেমে থাকেনি, পাল্টা জবাব দেয় এবং নিজেদের পক্ষ থেকে শুল্ক আরোপিত পণ্যের একটি তালিকা প্রকাশ করে। চীনের এ পদক্ষেপের প্রত্যুত্তরে হুয়াওয়েসহ দেশটির আরো পাঁচটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে ট্রাম্প প্রশাসন কালো তালিকাভুক্ত করে। কাব্যিকভাবে চীন যুক্তরাষ্ট্রের এ কাজকেঅবিশ্বাস্য অস্তিত্বের খসড়া হিসেবে আখ্যা দেয় এবং আমেরিকান প্রতিষ্ঠানগুলোকে বহিষ্কারের হুমকি প্রদান করে।

এ পর্যায়ে প্রশ্ন আসে, দুই দেশের সম্পর্কের যখন এমন দশা, সেক্ষেত্রে আমরা কীভাবে আশা করতে পারি যে পরবর্তী ধাপের আলোচনা সফল হবে?

প্রথমত, চীন-যুক্তরাজ্য উভয় দেশের অর্থনীতিই চাপের মধ্যে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক দুর্বল উৎপাদন এ বেসরকারি খাতনির্ভর কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান অর্থনীতির সম্ভাবনাসংক্রান্ত হতাশাবাদকে জোরদার করে। পরিস্থিতি যদি আরো খারাপের দিকে যায়, তাহলে ২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাটি বিপন্ন হতে পারে। একইভাবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপনের প্রাক্কালে যেকোনো আকারের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক মন্দার ঘটনা শি জিনপিংয়ের একচ্ছত্র ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলবে, যা কিনা ২০২০ সালে তৃতীয় মেয়াদে পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার মনোনয়নের প্রক্রিয়াকে দুর্বল করবে, বিষয়টি যদিও এখনো বিতর্কিত।

জনসমক্ষে উভয় পক্ষই একে অন্যকে দোষারোপ করে বলছে যে বাণিজ্যযুদ্ধ তাদের বেশি ক্ষতি করছে। মূলত বাজার অস্থিতিশীল করে, ব্যবসার আস্থা নষ্ট করে এবং প্রবৃদ্ধিকে অবনমিত করে দুই পক্ষই নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এছাড়া উভয় পক্ষ আরো দাবি করেছে যে একটি বর্ধিত দ্বন্দ্ব মোকাবেলায় অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা প্রয়োজন। এ প্রশ্নে কার পক্ষে তীব্র যুক্তি রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। আমেরিকা অবশ্যই চীনের চেয়ে কম বাণিজ্যনির্ভর। তবে বাণিজ্যযুদ্ধের আগে নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নীতি নির্বাচনের ফলে দুর্বল অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও আমেরিকার তুলনায় চীনের আর্থিক, মুদ্রা ও ঋণ সরঞ্জাম ব্যবস্থা এখনো শক্তিশালী।

 যা-ই হোক না কেন, উভয় পক্ষই স্বীকার করে যে তারা একে অন্যের মাথা বরাবর একটি অর্থনীতির বন্দুক ধরে রেখেছে। অতত্রব, রাজনৈতিক ভান-ভঙ্গিমার আড়ালে ট্রাম্প ও শি উভয়ই শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তিতে যেতে চান। উপরন্তু, শুল্ক বৃদ্ধির বড় ধরনের ক্ষতিআসছে ১৫ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছেএড়াতে চলতি বছরের মধ্যেই চূড়ান্তভাবে উভয় পক্ষই চুক্তি সম্পাদন করতে আগ্রহী। ওই সময়সীমা অনুসারে, অনতিবিলম্বে উভয় পক্ষ থেকেই লাক্ষণিক ও স্থিতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করাটা জরুরি।

প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে চীনকে পূর্ববর্তী দেড়শ পৃষ্ঠার খসড়া হিসেবে একই পাঠ্য ব্যবহার করে একটি চুক্তির প্রস্তাব করা উচিত। তবে সেখানে যে তিনটিলাল লাইন ছিল, তার সংশোধনীসহ প্রস্তাবটি করতে হবে। বিশেষ করে চুক্তি সম্পাদনের পর চীনের উচিত শুল্ক বজায় রাখা এবং একতরফাভাবে শুল্ক আরোপবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বিধানগুলো বাতিল করা, নচেৎ যুক্তরাষ্ট্র এটা মনে করতে পারে যে চীন সম্ভবত চুক্তিটিকে অসম্মান করছে। সঙ্গে একটি প্রতিশ্রুতি যোগ করা উচিত যে চীন চুক্তিটা এমনভাবে কার্যকর করবে, যা তার সাংবিধানিক, আইনি ও নিয়ন্ত্রণমূলক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, সময়ের সঙ্গে চীনের উচিত ২০০ বিলিয়ন ডলার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসের মূল প্রস্তাবনাকে উন্নীত করা। এ আলোচনার মূল ভিত্তি মূলত নোংরা অর্থনীতি, তবে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্পের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।

তৃতীয়ত, চীন তার দেশীয় শিল্প ও উদ্যোগের জন্য রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি নিষিদ্ধ করা এড়াতে চাইবে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই বৌদ্ধিক সম্পত্তি রক্ষা এবং জোরপূর্বক প্রযুক্তি স্থানান্তর নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত খসড়া চুক্তির বিদ্যমান বিধানগুলো বজায় রাখতে হবে। তাছাড়া চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে এটিও সম্ভব হতে পারে যে প্রতিটি দেশ তার রাষ্ট্রীয় শিল্পনীতি সম্পর্কে সরকারিভাবে নিজস্ব অবস্থান ঘোষণা করবে। এ ধরনের একটি বিবৃতি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মীমাংসা প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট করে দিতে পারে, যা প্রতিযোগিতামূলক নিরপেক্ষতা সম্পর্কিত সব প্রাসঙ্গিক আইন প্রয়োগ করতে ব্যবহার হবে।

চতুর্থত, উভয় পক্ষের তরফ থেকেই ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে এমনটি হওয়ার লক্ষণ দেখা গেছে, বিশেষ করে সেপ্টেম্বরে চীনের পক্ষ থেকে আমেরিকান সয়াবিন ক্রয়ের প্রতিবেদন অনুসারে। যদিও ক্রয়ের বিষয়টি এখনো ঐতিহাসিক স্তরে পৌঁছেনি, তবে এটি ট্রাম্পকে তার ঘাঁটিতে ক্ষুব্ধ কৃষকদের শান্ত করতে সহায়তা করেছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ১ অক্টোবর নির্ধারিত ৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে। তাছাড়া কিছু মার্কিন সংস্থাকে হুয়াওয়ের কাছে সংবেদনশীল ইনপুট বিক্রির ক্ষেত্রেও ছাড় দেয়া হতে পারে।

পঞ্চমত, উভয় পক্ষকেই আগামী ১৫-১৬ নভেম্বর চিলির সান্তিয়াগোতে অনুষ্ঠেয় এশিয়া-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা শীর্ষক শীর্ষ সম্মেলনকে চুক্তি স্বাক্ষরের শেষ সুযোগ হিসেবে ধরে নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে তা বিবেচনা করা উচিত। চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী লিউ হি ও আমেরিকান বাণিজ্য প্রতিনিধি রবার্ট লাইথিজারের মধ্যে উচ্চস্তরের আলোচনার পরে বেইজিংয়ের উচিত নভেম্বরের শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর বিষয়ে একমত হওয়া। ক্রিসমাসের মৌসুমে মার্কিন ব্যবসায়ী ও গ্রাহকের আস্থা অর্জনে থ্যাংকস গিভিংয়ের আগে চুক্তিটি সম্পাদন করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

যদিও স্বল্প কয়েকজন মন্তব্যকারীর মধ্যে আমি একজন, যারা সারা বছর যুক্তি দিয়েছেন যে রাজনৈতিক আতশবাজি সত্ত্বেও ট্রাম্প ও শির অন্তর্নিহিত আগ্রহগুলো চুক্তি না করা নয়, বরং একটি চুক্তিতে যাওয়ার সম্ভাবনাই তৈরি করে। তবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ঘোষিত অভিশংসন চেষ্টা এ প্রক্রিয়ায় ছেদ ঘটাতে পারে। ক্লান্ত ও দুর্বল ট্রাম্প মার্কিন অর্থনৈতিক স্বার্থের দাবির চেয়ে চীনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়নে বেশি উৎসাহিত হতে পারেন। ভারসাম্য বজায় রাখার পরেও ট্রাম্প ২০২০ সালের মন্দার ঝুঁকি মোকাবেলা করতে পারবেন না, যার মানে চুক্তি না হওয়ার চেয়ে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

তবুও পরবর্তী দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাস ঠিকঠাকভাবে পরিচালনা করার ব্যর্থতা পুরো প্রক্রিয়াটির ধস নামাতে পারে। উভয় পক্ষ এরই মধ্যে ২০২০ সালের জন্য প্ল্যান বি-র প্রস্তুতি নিতে বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছে; বিশেষ করে অর্থনৈতিক যুদ্ধের পশুগুলোকে হারাতে, জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে শক্তিশালী করতে এবং ক্ষতির জন্য অন্য পক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপাতে গিয়ে। যদি এটি ঘটে, আসছে বছর আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার মন্দার ঝুঁকি বেশি থাকবে; চীন যদিও আরো মুদ্রা ও আর্থিক উদ্দীপনার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ অভিঘাতগুলো শিথিল করতে চাইবে।

চীন ও আমেরিকার সামনে বেছে নেয়ার সুযোগটি চূড়ান্ত। এক্ষেত্রে বাকি বিশ্বের দায়ভার কোনোভাবেই বেশি হতে পারে না।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

 

কেভিন রাড: অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী

নিউইয়র্কভিত্তিক এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সভাপতি

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫