যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট একটি শহর সেরে কানিয়ে (কুর্দিশ)। আরবদের কাছে শহরটি রাস আল-আইন নামে পরিচিত। তুরস্কের সীমান্তবর্তী এ অঞ্চল কুর্দিদের শক্তিশালী ঘাঁটি। গত বুধবার থেকে তুর্কি সামরিক বাহিনী ও সিরীয় বিদ্রোহীদের মিত্রবাহিনী যৌথভাবে এ শহরে ভারী বোমাবর্ষণ শুরু করে।
তুর্কি আগ্রাসন শুরুর পর ওই অঞ্চলে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। আগ্রাসনের তৃতীয় দিন পর্যন্ত ১১ জন সাধারণ নাগরিক, কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) ও তুর্কি পক্ষের কয়েক ডজন সৈন্য নিহত হয়েছে। অন্যদিকে তুর্কি আগ্রাসনের মুখে ওই অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছে হাজার দশেক স্থানীয় নাগরিক।
সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিরোধী লড়াইয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল কুর্দি ওরফে এসডিএফ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই অঞ্চল থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ায় তুর্কিরা সেখানে আগ্রাসনের মওকা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বড় আশঙ্কা তৈরি হয়েছে আইএস-বন্দিদের ঘিরে। কুর্দিরা তুর্কিদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় ওই অঞ্চলে কুর্দি নেতৃত্বাধীন এসডিএফের হাতে কয়েক হাজার বন্দি বেহাত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমনটি ঘটলে ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সেরে কানিয়েতে তুর্কি আগ্রাসনের প্রত্যুত্তর হিসেবে আঙ্কারার অর্থনীতি গুঁড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে তুরস্কের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের পরিকল্পনা করছেন রিপাবলিকানরা। তবে কৌশলগত কারণে আইএসবিরোধী লড়াইয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জোট করলেও কোনো কুর্দিই তাদের বিশ্বাস করে না। এক্ষেত্রে পিপলস প্রটেকশন ইউনিটসের (ওয়াইপিজি) স্নাইপার কুর্দি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-ইরানি নাগরিক আজাদ চৌদি বলেন, কুর্দিদের এর আগেও অনেকবার প্রয়োজনে ব্যবহার করে সময় ফুরালে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হয়েছে। বিশ্বের যেকোনো দেশ বা সরকারের মতো যুক্তরাষ্ট্রকেও আমরা বিশ্বাস করি না।
এদিকে তুরস্কের সীমান্তজুড়ে সিরিয়ার ওই অঞ্চলে সিরীয় শরণার্থীদের জন্য একটি ‘নিরাপদ জোন’ নির্মাণের ধুয়ো তুলেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। নিরাপদ জোন গড়ে তোলার জন্য সেখানে তুর্কি সামরিক বাহিনী অপারেশন শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
আঙ্কারা ওই রকম দাবি করলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ সীমান্ত অঞ্চল থেকে এরদোগান আদতে ওয়াইপিজি নামে কুর্দি মিলিশিয়া বাহিনীকে নির্মূল করতে চায়। তুরস্কে স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংগ্রামরত ওয়াইপিজিকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেছে তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। অন্যদিকে এসডিএফকেও সন্ত্রাসী দল বলে মনে করে আঙ্কারা। প্রসঙ্গত, এসডিএফ তুরস্কে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সংগ্রামরত ওয়াইপিজিকে সহায়তা করে থাকে। তবে সিরিয়ায় আইএসবিরোধী লড়াইয়ে কুর্দি ও আরব মিলিশিয়াদের মধ্যে গঠিত জোট এসডিএফের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ওয়াইপিজি তুরস্ক ও আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়টি সমালোচনা ও অস্বীকার করে আসছে বারবার।
এদিকে ২৭ বছর বয়সী কুর্দি চলচ্চিত্রকার সেভিনাজ বলেন, এরদোগান একটা মিথ্যুক। কুর্দিদের নির্বংশ করাই তার মতলব। তিনি বলেন, এসডিএফ ও ওয়াইপিজির সম্মিলিত যোদ্ধারা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তুর্কি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। সেরে কানিয়ের একটি কনাও তারা ছাড়বে না। একটু দার্শনিক ভঙ্গিতে তিনি বলেন, শেষতক জয়ী হব আমরাই। কারণ আমরা এ মাটির সন্তান। সত্য আমাদের ছেড়ে যেতে পারে না।
আইএসবিরোধী লড়াইয়ের মাঝপথে যুক্তরাষ্ট্রের সরে পড়াকে ‘পিঠে ছুরি মারা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন আজাদ চৌদি। তিনি বলেন, যেকোনো মূল্যে আমরা তুর্কি আগ্রাসনবিরোধী সংগ্রাম চালিয়ে যাব। এছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই।
লড়াকু এ স্নাইপার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, তুর্কিদের মোকাবেলা করার মতো আমাদের ভারী মেশিনগান, অ্যান্টি-এয়ারক্রাপ্ট বা অ্যান্টি-ট্যাংক সরঞ্জাম নেই। শুধু তা-ই নয়, প্রকৃত বিচারে আমাদের কোনো বন্ধুও নেই। বিপদে পাহাড়ই বন্ধু হয়ে আশ্রয় দেবে আমাদের। সূত্র: বিবিসি