দক্ষিণ এশিয়ায় সৌহার্দ বজায় রাখতে প্রধানমন্ত্রীর চার প্রস্তাব

টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্যই আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা জরুরি

প্রকাশ: অক্টোবর ০৬, ২০১৯

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটের সমাপনী অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় চার দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রথম দফায় তিনি সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সৌহার্দ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়াস চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যুগ যুগ ধরে বহুত্ববাদ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি। এর মাধ্যমে আমরা ধর্ম, জাতি ও ভাষাগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বৈচিত্র্য উদযাপন করতে পারি। এটি হচ্ছে মৌলিক বিষয়। দ্বিতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দ্রুত প্রবৃদ্ধির সময়ে সমাজে যেন বৈষম্য আরো বেড়ে না যায়, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। সম্পদ হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং তা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। স্বল্পোন্নত সম্প্রদায় বা দেশ পেছনে পড়ে থাকবে না। আমাদের যুবকদের আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে অন্যদের হাত ধরতে হবে। তৃতীয় প্রস্তাব হলো, আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের জন্য সহযোগিতাপূর্ণ সংস্কৃতি প্রয়োজন। যদিও আমাদের বেসরকারি খাত স্বচ্ছ ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। চতুর্থ প্রস্তাবে তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ন্ত্রণ করব। আমাদের জনগণের স্বার্থে ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক বাস্তবতার আমরা প্রশংসা করব। আমরা স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ বন্ধ করে দিতে পারি না। উল্লেখ্য, চারটি প্রস্তাব সময়োপযোগী ও প্রশংসার দাবি রাখে।

আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে জন্ম হলেও এসব সংগঠন যে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, তা আমরা বুঝতে পারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অর্থনৈতিক জোটের দিকে তাকালে। আশির দশকে তত্কালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন সার্ক গঠনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তখন এর লক্ষ্যই ছিল কল্যাণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা, সদস্য দেশগুলোর মধ্যকার পরস্পর বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের মাধ্যমে আঞ্চলিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধন করা। কিন্তু ষোড়শ সার্ক সম্মেলনে সার্কের বর্তমান আটটি সদস্য ও নয়টি পর্যবেক্ষক দেশের প্রতিনিধিরা এ মর্মে স্বীকার করেছেন যে দক্ষিণ এশীয় গুরুত্বপূর্ণ জোটটি প্রতিষ্ঠার তিন দশক পেরোলেও এখনো তেমন কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি। পারস্পরিক সৌহার্দ বজায় রাখতে  দক্ষিণ এশীয় সার্কভুক্ত আটটি দেশ বিশ্ব আয়তনের মোট ৩ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে। কিন্তু বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২১ ভাগের বসবাসই এ অঞ্চলে। দারিদ্র্য, সন্ত্রাস আর দুর্যোগের ঝাপটায় বারবার আক্রান্ত এ দেশগুলোর ২২ শতাংশ লোকই বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে। মাথাপিছু আয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অঞ্চল এটি। জনসম্পদ আর প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে ভরপুর দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদ আর দরিদ্রতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যেখানে এ জোটের নেতৃত্বকে একত্রে এগিয়ে যাওয়া আবশ্যক ছিল, সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার ১৮০ কোটি মানুষের সার্বিক উন্নতিতে সার্ক পুরোপুরি কার্যকর হওয়া না-হওয়ার প্রশ্নে বহুলাংশে জিম্মি হয়ে রয়েছে। সার্ক গঠনকালীন দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পটভূমি আর বর্তমান পটভূমি কোনোভাবে মিলবে না সত্যি কিন্তু তার পরও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের উন্নয়নে সার্কের মাধ্যমে খুব কমই ঐকমত্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৯৮ সালে সার্ক জোটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১০ সালের ভিশন প্রদান করা হয়েছিল, এ অঞ্চলকে মুক্ত বাণিজ্য এলাকায় পরিণত করা হবে। পুরো অঞ্চলকে একটি ইকোনমিক ইউনিয়নের আওতায় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত খুব কমই অগ্রগতি হয়েছে। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলো নিয়ে বাণিজ্য জোট গঠন করা সম্ভব হলে এটা যে ইইউ জোটের ন্যায় বিশ্ববাণিজ্যে ফায়দা তুলতে সক্ষম হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে। দেশগুলোর নাগরিকদের ভিসামুক্ত ভ্রমণের কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠাকালীন সাতটি দেশ থাকলেও ২০০৭ সালে সার্ক জোটে প্রবেশ করে আফগানিস্তান। তবে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারতই একা সার্কের আয়তনের ৭০ শতাংশ জায়গা ধরে অবস্থান করছে। ফলে অন্যান্য সদস্য দেশের মধ্যে একটা প্রবল ধারণা কাজ করে যে ভারত এ জোটে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে, যার কারণে বাকি দেশগুলোর মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বড় দুটি দেশ পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে জন্মগত দ্বন্দ্ব সার্ক অকার্যকর থাকার পেছনে অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। এ অঞ্চলের অধিকাংশ দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা বিদ্যমান।

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতা করার লক্ষ্য নিয়েই গঠিত হয়েছিল সার্ক। আর সেই সার্ক যদি না থাকে, তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হবে বৈকি। দুটি দেশের বিরোধের কারণে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারা রুদ্ধ হতে দেয়া যায় না। সার্ক কাঠামোর মধ্যে উপ-আঞ্চলিক জোট হতে পারে, এক বা একাধিক দেশ অন্য কোনো জোটের শরিক হতে পারে কিন্তু সার্ককে টিকিয়ে রাখার এবং সামনে এগিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫