বিদ্যালয়ের বাইরে ৬৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু : অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে

প্রকাশ: আগস্ট ১৭, ২০১৯

দেশের প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষার্থীরা দারিদ্র্য, অবহেলা আর বঞ্চনার কারণে মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আজো চরমভাবে পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছেই সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় এদের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করাও সম্ভব হচ্ছে না। হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের গবেষণার বরাত দিয়ে গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী প্রতিবন্ধী শিশুদের ৬৫ শতাংশই বিদ্যালয়ে যায় না। আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৭৫ শতাংশ এখনো শিক্ষার বাইরে। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। তবে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার বিষয়টি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত। প্রচলিত আইন ও বিভিন্ন ধরনের নীতিমালার ভিত্তিতে তারা এসব শিশুর শিক্ষার বিষয়টি পরিচালনা করছে। প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের শিক্ষালাভের সহায়তায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচি বাস্তবায়ন নীতিমালা-২০০৮ অনুযায়ী এসব শিশুর উপবৃত্তি দেয়ার কর্মসূচি প্রবর্তন করেছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত শিক্ষা কর্মসূচিতে এসব শিশু অংশ নিতে পারে না। এমনিতেই তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম, তার ওপর তাদের সাধারণ শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় না এনে ভিন্ন ধরনের নামমাত্র শিক্ষা ব্যবস্থায় এনে নতুন করে অক্ষমতায় পতিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা অনেক ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় কঠিন বৈকি। এক্ষেত্রে বিদ্যমান বিদ্যালয়গুলোতেই প্রতিবন্ধী সহায়ক অবকাঠামো গড়ে তুলে পাঠদান করা যেতে পারে। বিশ্বের উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো এ নীতিতেই তাদের স্কুল-কলেজ এমনকি যাতায়াত অবকাঠামো প্রতিবন্ধী সহায়ক করে গড়ে তোলে। এতে প্রতিবন্ধীরা সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করে না।

বাংলাদেশে একসময় প্রতিবন্ধীদের বোঝা মনে করা হলেও সময়ের পরিক্রমায় তারা এখন সমাজের মূলধারায় চলে আসতে শুরু করেছে। এজন্য বর্তমান সরকার ও অটিজম বিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের অবদান অনস্বীকার্য। প্রতিবন্ধীদের জন্য আইন তৈরিসহ নানা উদ্যোগের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার যেভাবে এগিয়ে এসেছে, তা এ দেশে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রতিবন্ধীদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের পাশাপাশি সাধারণ স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগদানের ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছে বর্তমান সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা ও উদ্যোগের ফলেই। বর্তমানে প্রতিবন্ধীরা যেমন রাষ্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা পাচ্ছে, তেমনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে। সরকারের সদিচ্ছার কারণে আজ প্রতিবন্ধী সন্তানের লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও মা-বাবা বা পরিবারের সদস্যদের ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তবে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা মাঝে মধ্যে শোনা যায়। এসব ক্ষেত্রে দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হলে পিছিয়ে পড়া শিশুগুলো অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবে। মূল ধারার শিক্ষায় তাদের সংযুক্তি ঘটাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেই প্রতিবন্ধীর পাঠদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

একজন শিক্ষার্থী বাসস্থানের পর সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে তার বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুবিধাদি একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এখন পর্যন্ত আমাদের সব বিদ্যালয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী/বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু শিক্ষার্থীর জন্য উপযোগী র্যাম্প বা ঢালু সিঁড়ির ব্যবস্থা নেই। টয়লেটগুলোয় তাদের উপযোগী ব্যবস্থা নেই। এজন্য হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হয়। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাক্ ও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ইশারা ভাষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়া সরকারের উচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকগুলো ব্রেইলে প্রকাশ করা। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে বিভিন্ন ডকুমেন্ট, কর্মপরিকল্পনা, কারিকুলাম, আইন, আন্তর্জাতিক সনদ ইত্যাদি থাকলেও কাজ হবে না। সেগুলো বাস্তবায়নে সরকার ও নীতিনির্ধারণী মহলের সদিচ্ছা না থাকলে সবকিছুই কাগুজে আইনে পরিণত হবে এবং প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান সবকিছু থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবে। সম্প্রতি সরকার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা হয়নি। এসব সমস্যা সমাধান না করে শুধু স্কুলে ভর্তির নির্দেশ দিলেই তা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। এখনো শ্রেণীকক্ষে অন্যান্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর শিখন সমস্যা বিদ্যমান। এসবের দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।

দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে শিক্ষার আওতায় আনতে হলে সরকারকে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা ও আহ্বান বাস্তবায়ন করতে হলে সমাজের সব স্তরের মানুষের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। দেশের বিভিন্ন জেলা ও গ্রাম পর্যায়ে বিশেষ শিশুদের জন্য বিশেষায়িত বিদ্যালয় স্থাপনসহ যে বিদ্যালয়গুলো এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোর প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আরো দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সুযোগ বাড়ানোসহ শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি অভিভাবক ও সমাজের সচেতনতা প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে তাদের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতে সম্পৃক্ত করতে পারলে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আরো বেগবান হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫