পোশাক শিল্প : নির্ধারিত সময়ে বেতন হয়নি ৩০% কারখানায়

প্রকাশ: আগস্ট ০৯, ২০১৯

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রথম সাত কর্মদিবসের মধ্যে পূর্ববর্তী মাসের বেতন পরিশোধের বিধান রয়েছে দেশের প্রচলিত শ্রম আইনে। শিল্প পুলিশের হিসাবে, আইনের এ বিধান মেনে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করেছে ৭০ শতাংশ পোশাক কারখানা। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ কারখানা নির্ধারিত সময়ে বেতন পরিশোধ করেনি। একই সময়ে শ্রমিকদের উৎসব ভাতা পরিশোধ করেছে ৮০ শতাংশ কারখানা। অর্থাৎ ২০ শতাংশ পোশাক কারখানার শ্রমিক উৎসব ভাতা পাননি।

নির্ধারিত সময়ে বেতন-বোনাস না পাওয়ায় বেশকিছু এলাকায় পোশাক শ্রমিকরা বিক্ষোভও করেছেন। ৭ আগস্ট মিরপুরে জারা জিন্স নামের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বেতন-বোনাসের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করেন। মালিকের কোনো খোঁজ না থাকায় ওইদিন সন্ধ্যার পরও রাস্তায় ছিলেন শ্রমিকরা। পরে ওই এলাকার সংসদ সদস্য ও শ্রমিক নেতাদের আশ্বাসে রাস্তা ছেড়ে দেন তারা।

বেতন-বোনাসের দাবিতে গতকাল আবারো রাস্তায় নামেন জারা গার্মেন্টসের শ্রমিকরা। বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ বেতন-বোনাস পাওয়ার নিশ্চয়তায় কারখানায় ফিরে যান তারা। সর্বশেষ তথ্য পাওয়া পর্যন্ত পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও ব্যাংকের সহযোগিতায় কারখানা কর্তৃপক্ষ বেতন-বোনাস পরিশোধ করছিল।

বেতন-বোনাস পরিশোধের আশ্বাস না পেয়ে কাজ বন্ধ ও রাস্তায় নামার ঘটনা ঘটেছে ঢাকার বাইরেও। গাজীপুরের শ্রীপুরে এমন একটি কারখানা বস্ত্র খাতের ওশিন স্পিনিং। বেলা আড়াইটার দিকে কারখানাটির ১ হাজার ২০০ শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসেন। পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যস্থতায় গতকাল বোনাস ও আজ বেতন পরিশোধের আশ্বাসে কারখানায় ফেরেন তারা।

যদিও অনেক কারখানা আছে, যেখানে জুলাইয়ের বেতন পরিশোধ হয়নি। অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আস্থা রাখার মতো আশ্বাসও পাননি শ্রমিকরা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, দেশের শিল্প অধ্যুষিত ছয়টি এলাকা আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনায় স্থাপিত বস্ত্র ও পোশাক কারখানাগুলোর ৭০ দশমিক ৩ শতাংশ বেতন পরিশোধ করেছে। বেতন পরিশোধের এ তথ্য গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। শিল্প পুলিশের আওতাভুক্ত ছয় এলাকায় গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বোনাস পরিশোধ হয়েছে ৭৯ দশমিক ৬১ শতাংশ কারখানায়। যদিও প্রথম সাত কর্মদিবসের মধ্যে বেতন পরিশোধের কথা বলা আছে শ্রম আইনে। শ্রম আইনের ১২৩-এর ১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো শ্রমিকের যে মজুরিকাল সম্পর্কে তার মজুরি প্রদেয় হয়, সেই কাল শেষ হওয়ার পরবর্তী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তার মজুরি পরিশোধ করতে হবে।

শিল্প পুলিশ বলছে, আইনে দিকনির্দেশনা থাকলেও বিশেষ করে ঈদের সময় শিল্প মালিকরা সর্বশেষ কর্মদিবস পর্যন্ত বেতন-বোনাস পরিশোধ করেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সে সময় পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে শ্রম অস্থিরতাও প্রকাশ পায়। এবারের ঈদে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো শ্রম অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি।

শিল্প পুলিশের মহাপরিচালক অ্যাডিশনাল আইজিপি আবদুস সালাম বণিক বার্তাকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের জাজ অ্যাপারেলস ছাড়া শিল্প পুলিশের আওতাভুক্ত এলাকার আর কোনো কারখানায় সমস্যা হয়নি। আশা করছি বড় কোনো সমস্যা ছাড়াই শেষ কর্মদিবস অতিবাহিত করে সবাই ঈদ উদযাপনে যাবেন।

সূত্র জানিয়েছে, শিল্প পুলিশের আওতায় থাকা ছয়টি এলাকায় বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএর সদস্য বস্ত্র ও পোশাক কারখানা আছে ৩ হাজার ৮৪৬টি। এ কারখানাগুলোর আওতায় শ্রমিক আছেন ২৫ লাখের বেশি। কারখানাগুলোর ২ হাজার ৭০৪টিতে বেতন ও ৩ হাজার ৬২টি কারখানায় বোনাস পরিশোধ করা হয়েছে। এ হিসাবে গতকাল পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ কারখানায় বেতন ও ২০ দশমিক ৩৯ শতাংশ কারখানায় বোনাস পরিশোধ হয়নি।

শিল্প পুলিশের হিসাবে, শিল্প পুলিশ ১ বা আশুলিয়া এলাকায় বস্ত্র ও পোশাক কারখানা আছে ৭৯১টি। এর মধ্যে বেতন পরিশোধ হয়েছে ৪৮৫টি বা ৬১ শতাংশ কারখানায়। বোনাস পরিশোধ হয়েছে ৭০৬টি বা ৮৯ শতাংশ কারখানায়।

শিল্প পুলিশ ২ বা গাজীপুরে বস্ত্র ও পোশাক খাতের ১ হাজার ২৪২টি কারখানার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত বেতন পরিশোধ হয়েছে ৯০১টি বা ৭২ দশমিক ৫৪ শতাংশ কারখানায়। আর বোনাস পরিশোধ হয়েছে ৯৭৮টি কারখানায়, যা এ অঞ্চলের মোট পোশাক কারখানার ৭৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

শিল্প পুলিশ ৩ বা চট্টগ্রামে বস্ত্র ও পোশাক কারখানা রয়েছে ৬৭৯টি। এর মধ্যে বেতন পরিশোধ হয়েছে ৫০৬টি বা ৭২ দশমিক ৫১ শতাংশ কারখানায়। বোনাস পরিশোধ হয়েছে ৫৪৩টি বা ৭৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ কারখানায়।

শিল্প পুলিশ ৪ বা নারায়ণগঞ্জে বস্ত্র ও পোশাক কারখানা রয়েছে ১ হাজার ৫৬টি। এর মধ্যে বেতন পরিশোধ হয়েছে ৭৬৪টি বা ৭২ দশমিক ২৩ শতাংশ কারখানায়। বোনাস পরিশোধ হয়েছে ৭৮৫টি বা ৭৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ কারখানায়।

শিল্প পুলিশ ৫ বা ময়মনসিংহে বস্ত্র ও পোশাক কারখানা রয়েছে ৫৫টি। এর মধ্যে বেতন পরিশোধ হয়েছে ৪৩টি বা ৭৮ দশমিক ১৮ শতাংশ কারখানায়। বোনাস পরিশোধ হয়েছে ৪৫টি বা ৮১ দশমিক ১৮ শতাংশ কারখানায়। শিল্প পুলিশ ৬ বা খুলনায় বস্ত্র ও পোশাক কারখানা রয়েছে পাঁচটি। এর সবক’টিতেই বেতন ও বোনাস পরিশোধ হয়েছে।

শিল্প পুলিশের প্রধান কার্যালয় থেকে বেতন-বোনাস নিয়ে বড় ধরনের শ্রম অস্থিরতা দেখা যায়নি বলা হলেও গতকাল শিল্প পুলিশ ৪ বা নারায়ণগঞ্জে বেতন-বোনাসের দাবিতে সড়ক অবরোধ করেন শ্রমিকরা। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভুঁইঘর এলাকায় তিন মাসের বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে একটি রফতানিমুখী গার্মেন্টের শ্রমিকরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

শিল্প পুলিশের এসপি জাহিদুল ইসলাম বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভুঁইঘর রঘুনাথপুর এলাকায় অবস্থিত জাজ অ্যাপারেলস গার্মেন্টের শ্রমিকরা এক মাসের বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে সড়ক অবরোধ করেন। এ সময় শিল্প পুলিশ ও জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা শ্রমিকদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বেতন-বোনাস ছাড়া রাস্তা না ছাড়ার কথা জানান। প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টার পরও শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ তুলে না নিলে শিল্প পুলিশ ও জেলা পুলিশ যৌথভাবে শ্রমিকদের ধাওয়া দেয়। এতে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

এদিকে গতকাল বেতন-বোনাস পরিশোধ পরিস্থিতি নিয়ে প্রথমবারের মতো বিবৃতি দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বিজিএমইএর বরাত দিয়ে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সারা দেশে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ৯৫ শতাংশ কারখানা গতকাল পর্যন্ত শ্রমিকদের বোনাস পরিশোধ করেছে। দু-একদিনের মধ্যে বাকি ৫ শতাংশেও পরিশোধ হবে।

বিকেএমইএ সদস্যভুক্ত চলমান কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৮৩, এমন তথ্য উল্লেখ করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলেছে, গতকাল পর্যন্ত ৯২ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের বোনাস প্রদান করেছে। বাকিগুলো আজ-কালের মধ্যে পরিশোধ করবে। বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানাগুলোর শ্রমিকদের জুলাইয়ের বেতনও প্রায় ৫০ শতাংশ প্রদান করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, ৭৮-৮০ শতাংশ কারখানায় বেতন পরিশোধ হয়েছে। বাকি ১০ শতাংশ আগামীকাল (আজ) এবং ১০ শতাংশ শনিবারের মধ্যে পরিশোধ করা হবে।

বোনাসের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের জানামতে ৯৮ শতাংশ কারখানায় বোনাস পরিশোধ হয়েছে। যদি কিছু বাকি থাকে, তা শনিবারের মধ্যে অবশ্যই পরিশোধ হবে।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫