গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা : ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার ভিত্তিক উন্নয়ন প্রয়োজন

প্রকাশ: আগস্ট ০১, ২০১৯

নিজস্ব প্রতিবেদক

সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও দলিত জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এসব মানুষের ভূমির অধিকার, সামাজিক সংস্কৃতিতে প্রবেশগম্যতা এবং সর্বোপরি অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার বিষয়টি এখনো সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিতর্ক আছে তাদের সঠিকভাবে হিসাবভুক্ত করা কিংবা পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নিয়েও। কোনো ধরনের দয়া বা করুণার মাধ্যমে সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও দলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদের জন্য প্রয়োজন মানব মর্যাদা অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন।

গতকাল বণিক বার্তার সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ‘সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও দলিত জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং মৌলিক সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে প্রবেশগম্যতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।

কেমন আছে সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও দলিত জাতিগোষ্ঠীর মানুষরা। কেমন চলছে তাদের জীবন, টিকে থাকার লড়াই। সরকারের সামাজিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা কেমন। সরকারইবা তাদের নিয়ে কী ভাবছে—এমন নানা প্রশ্ন সামনে রেখেই এ গোলটেবিল বৈঠকটি যৌথভাবে আয়োজন করে দৈনিক বণিক বার্তা, ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেড এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হেকস বাংলাদেশ। বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি  ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম।

স্বাগত বক্তব্যে বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, আগে একটা সাধারণ ধারণা ছিল যে কুড়িগ্রামে হয়তো বেশি দরিদ্র মানুষের বাস। কিন্তু সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন দিনাজপুরে বেশি দরিদ্র মানুষের বাস। এর অন্যতম কারণ সেখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের দারিদ্র্য। তারাই সবচেয়ে বেশি দরিদ্র। বিশেষ করে এসব গোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ নারী দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। অনগ্রসর এসব জনগোষ্ঠীর জন্য অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন করা না গেলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। আইনগত ও সামাজিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমেই তাদের জীবনমান উন্নয়ন করতে হবে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছেন। সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের উন্নয়নে তার দপ্তর সবচেয়ে বেশি কাজ করছে। সরকারের লক্ষ্যপূরণের পথে অনেক সময় ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের সম্ভাবনাও অনেক। আমরা সেই সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে প্রকল্প গ্রহণ করছি। অতীতের অভিজ্ঞতা ও ব্যর্থতা চিহ্নিত করে সেই আলোকে কাজ করা হচ্ছে। এর মধ্যে সুইপারদের বসবাসের জন্য ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে ভবন করা হচ্ছে। সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও দলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে প্রাণপ্রকৃতি গবেষক ও ডিআইপির সমন্বয়ক পাভেল পার্থ বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১৯ অনুযায়ী একটি তালিকা করা হয়েছে, কিন্তু রাজশাহীর কডা সম্প্রদায় সে তালিকায় আসেনি। ফলে সরকারের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সমতলের অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এখনো সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। তাদের উন্নয়নের জন্য আদিবাসী ও দলিত তালিকা সঠিকভাবে করে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্থানীয় সরকার কাঠামোয় অনগ্রসর এসব জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দলিতদের উন্নয়নে ১১ দফা সুপারিশ করেন। সুপারিশগুলো হচ্ছে জাতীয় নৃগোষ্ঠী ও দলিত জরিপ পরিচালনা, তাদের জন্য জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, সমতলের নৃগোষ্ঠীদের জন্য স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠন, বিশেষ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা, প্রথাগত ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করে তাতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, মৌলিক মানবাধিকার ও নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন, বিশেষ সেবা ও কোটা সংরক্ষণ, জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ, ভূমি-প্রতিবেশ ও পরিবেশ রক্ষা এবং প্রস্তাবিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আইন ও বর্ণবৈষম্য বিলোপ আইনে সংশ্লিষ্ট পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, সমাজে অসাম্য বজায় রেখে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। দলিত ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিষয়ে সরকার থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এ পরিবর্তনই তাদের উন্নয়নের পথে অনেকটা এগিয়ে দেবে। তা না হলে অধিকার কেড়ে নেয়ার মাধ্যমে গোলায় মোড়লদের ধান ভরবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব কামালউদ্দীন তালুকদার বলেন, বাংলাদেশের জন্মের পেছনে সব সম্প্রদায়ের মানুষের অবদান রয়েছে। তাই কোনো জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজনের সুযোগ নেই। সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে আলাদা সেল আছে। তবে বাজেট বরাদ্দ তুলনামূলক কম। এ সেলকে মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনলে তথ্যভাণ্ডার তৈরিসহ সম্প্রদায় ও সংস্কৃতিভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা করা যাবে। আমরা সব জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণ করতে চাই।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব জুয়েনা আজিজ বলেন, পাহাড় ও সমতলের নৃগোষ্ঠীর মানুষের কথা সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় হূদয়ে ধারণ করেন। এ কারণে তাদের উন্নয়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তত্পর রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের ১১২টি উন্নয়ন কমিটিতে স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দলিতদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের বিষয়ে মাননীয় মন্ত্রী কার্যকর নির্দেশনা দেবেন বলে আশা করছি। আমরা তাদের উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করেছি। কোনো মানুষ গৃহহারা থাকবে না।

সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বলেন, ভারতের সংবিধানে অনেক যুদ্ধ করে দলিতদের অধিকার যুক্ত করা হয়েছে। এতেও তাদের ভাগ্য ফেরেনি। তাই মাঠপর্যায়ে কমিউনিটিভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করা খুব জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় করতে হবে।

সবাইকে নিয়ে উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন সংস্কৃতিকর্মী রোকেয়া প্রাচী। তিনি বলেন, উন্নয়নের পথে আমি একা এগিয়ে যাব অথচ আমার আশপাশের সবাই পিছিয়ে থাকবে, তাহলে একপর্যায়ে গিয়ে আমি একা হয়ে পড়ব। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও সবার অংশগ্রহণে সমন্বিত উন্নয়ন এগিয়ে নিতে হবে। সরকারি বরাদ্দ অনগ্রসর এসব গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতে হবে।

ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান সৈয়দ বোরহান কবির বলেন, অনগ্রসর এসব নৃগোষ্ঠীর জন্য কাজ হলেও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। স্বতন্ত্র একটা সেল করা যেতে পারে। যেখানে প্রতি তিন মাসে অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদে তাদের উন্নয়নের অগ্রগতি নিয়ে পর্যালোচনা কিংবা তদারকি করা প্রয়োজন।

সমাজে তাদের বঞ্চনার নানান দিক তুলে ধরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসিবে বক্তব্য দেন লাকি রাণী। তিনি বলেন, ‘আমি একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে মাসে ২ হাজার টাকা আয় করি। আমি ওই প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত কোনো শ্রমিক নই। একজন তালিকাভুক্ত হলেও সে কোনো কাজ না করে মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছে। সেখান থেকে আমাকে ২ হাজার টাকা দিচ্ছে। আপনারাই বলুন এই টাকায় সংসার কীভাবে চলবে, বেঁচে থাকি কীভাবে? আমাদের সন্তানরা স্কুলে গেলে শিক্ষা পায় না, হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা সেবা পায় না।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘আমরা কি মানুষ না?’

বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি বিমল মুর্মু, রাইট বেজড প্রোগ্রামিং অ্যান্ড অ্যাডভোকেসির ম্যানেজার মোজাহিদুল ইসলাম নয়ন, ডিএফআইডির সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডভাইজর আনোয়ারুল হক, হরিজন ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চন্দ্র, কর্মজীবী নারীর নির্বাহী পরিচালক সালমা খান, ইউএনডিপির আরবান প্রোগ্রাম অ্যান্ড সোস্যাল সেফটি নেটের প্রধান আশেকুর রহমান, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সোহেল হাজং।


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বার্তা ও সম্পাদকীয় বিভাগ: পিএবিএক্স: ৫৫০১৪৩০১-০৬, ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৫৫০১৪৩০৮-১৪, ফ্যাক্স: ৫৫০১৪৩১৫