বিশ্ব শিক্ষক দিবস

প্রকাশ: অক্টোবর ০৫, ২০২৪



জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ সাধন, নৈতিকতা বিকাশ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য কৃতিত্বের সঙ্গে তারা দায়িত্ব পালন করেন। ইউনেসকো ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার যৌথ সুপারিশের স্বীকৃতিস্বরূপ শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও অবদান স্মরণ করতে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করা হয়। এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষকের কণ্ঠস্বর: শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার।’ শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি, পেশাগত উন্নয়ন ও জনসচেতনতা\বৃদ্ধির মাধ্যমে সব শিক্ষককে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশেও আজ দিবসটি উদযাপন হচ্ছে। এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে গণসাক্ষরতা অভিযান, এডুকেশন আউটলাউড ও গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন আয়োজন করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র

বিশ্বায়ন ও এসডিজিসের আলোকে বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ

আকমল হোসেন

৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস, দিবসটিতে শিক্ষক সমাজের দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকারের বিষয়টি নিয়ে কথা বলার দিন। প্রতিবারের মতো এবারো দিবসটি পালিত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, তবে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ইউনেসকো প্রতিবারই দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে: Valuing teacher voices : Towards a new social contract for education, যার বাংলা করা হয়েছে, শিক্ষকের কণ্ঠস্বর: শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার। ১৯৯৪ সালে ইউনেসকোর ২৬তম সাধারণ সভায় ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় দ্বিতীয় জন্মদাতা অথবা জাতি গড়ার কারিগর বলে বিবেচিত শিক্ষক সমাজের মান-সম্মান ইজ্জত ও আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করার চিন্তাভাবনা থেকে দিবসটি পালনের উদ্যোগ। শিক্ষার অধিকার মানবিক এবং মৌলিক, বিষয়টি বিবেচনায় এবং জাতিসংঘের ঘোষণা বাস্তবায়নে ১৯৬৬ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তঃসরকার সম্মেলনের সুপারিশ থেকে বিশ্বের সকল শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা, সকল রাষ্ট্রের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, মানবসম্পদের পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়ক কর্মসূচিতে স্বাক্ষর করেন জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেসকো) মহাপরিচালক ও সম্মেলনের সভাপতি। সম্মেলনে যোগদানকারী সরকারপ্রধান বা তাদের প্রতিনিধিরা সেটাতে স্বাক্ষর করেন এবং বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। সম্মেলনে গৃহীত সুপারিশের মধ্যে প্রধান বিষয়গুলো ছিল শিক্ষকদের মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিতকরণ, মাধ্যমিক স্তরে সরকারি-বেসরকারি সবার জন্য স্তরনির্বিশেষে শ্রেণী বৈষম্যহীন একই শিক্ষা নীতিমালা, শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন, পদোন্নতি, পেশাগত আচরণ ভঙ্গের শাস্তি, নারী শিক্ষকদের জন্য কর্মোপযোগী পরিবেশ, শিক্ষকদের অধিকার ও নিরাপত্তা এবং পেশাগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিধান ওই সম্মেলনে গৃহীত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারায় জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোতে সবার জন্য প্রাইমারি ও এলিমেন্টারি শিক্ষা নিশ্চিত করবে, মাধ্যমিক স্তরে কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ঘটাবে আর মেধার ভিত্তিতে উচ্চ শিক্ষায় সবার জন্য অর্থায়ন করবে। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে (২০০০-১৫) মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের আটটি বিষয়ের মধ্যে ২ নম্বরে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সরকারি-বেসরকারি ও এনজিও স্কুলের মাধ্যমে সংখ্যাগত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য এসডিজিসের (২০১৫-৩০) চতুর্থ নম্বরে কোয়ালিটি, ইনক্লুসিভ ইকুইটি এবং লাইফ লং এডুকেশন বাস্তবায়নে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কাজগুলো বাস্তবায়নে নিয়োজিত শিক্ষকদের দক্ষতা, আন্তরিকতা, সামাজিক মর্যাদা আর অর্থনৈতিক সচ্ছলতার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু এর কোনোটিই নিশ্চিত হয়নি। প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষকের চাকরি শুরু হয় ৯৭০০ টাকার স্কেলে ১৫০০০ আর মাধ্যমিক স্তরে ১২৫০০ টাকার স্কেলে, ১০০০ টাকার মাসিক বাড়ি ভাড়া আর ৫০০ টাকার মেডিকেল সুবিধা দিয়ে ১১৭৫০ টাকার (১০ ভাগ কর্তনের পর) মাসিক বেতন দিয়ে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা উৎসব বোনাস পান মূল বেতনের ২৫ শতাংশ এবং কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ। অবসর ও কল্যাণ তহবিলের কর্তনকৃত টাকা অবসরে যাওয়ার অনেক দিন পর শিক্ষক-কর্মচারীরা পাচ্ছেন না। নিয়োগকালে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি উৎকোচের বিষয়টিও মুক্ত নয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষকদের পিটিয়ে হত্যা, হামলা, গলায় জুতার মালা পরানোর মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছিল জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক কর্মী, গভর্নিং বডির সদস্য দ্বারা। এসব ঘটনার কোনো প্রকার বিচার না হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর ঢালাওভাবে শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন, আইনবহির্ভূতভাবে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে শিক্ষকরা মর্যাদাহানির শেষ পর্যায়ে। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব পাঠদান কাজের সংকটের বিষয়টি নতুন সমস্যা হিসেবে সামনে আসছে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারকদের যথেষ্ট আন্তরিকতা যেমন দরকার, সেই সঙ্গে আর্থিক বরাদ্দও প্রয়োজন। সেটা বিবেচনা করেই সংস্থাটি প্রত্যেক দেশকে তার দেশের জিডিপির ৭ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার তাগিদ দিয়েছিল, যদিও তা কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশে ড. কুদরাত-এ-খুদার শিক্ষা কমিশন জিডিপির ৫ শতাংশ, পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ এবং ১০ বছরের মধ্যে শিক্ষাকে সরকারীকরণের তাগিদ দিয়েছিল, সেটাও কার্যকর হয়নি।। ২০০৬ সালে সেনেগালের রাজধানী ডাকার সম্মেলনে ইউনেসকোভুক্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শিক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকে আর্থিক সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে আপাতত জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও তা কার্যকর হয়নি। ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইন্চনে এসডিজিসের সম্মেলনে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার ব্যয় সরকার বহন করবে বলে সম্মতি জানিয়েছিল, সেটাও বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত টাকার অংক কিছুটা শতাংশে বাড়লেও টাকার অবমূল্যায়ন এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে তার সুফল তেমন পাওয়া যায়নি। শিক্ষা খাতে জিডিপির ৭ শতাংশ ৬ শতাংশ ও ৫ শতাংশ বরাদ্দে বিভিন্ন সরকারের রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতি থাকলেও সেখানে বরাদ্দ ২ দশমিক ৪ শতাংশের ওপরে ৫৩ বছরে কখনো ওঠেনি। এসডিজিসের আলোকে ২০৩০ সালের মধ্যে (২০১৫-২০৩০) কোয়ালিটি ইকুইটি ইনক্লুসিভ এবং লাইফ লং এডুকেশন এবং মাধ্যমিক স্তরে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে বাস্তবায়ন করতে হলে পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবমতে জিডিপির ৪ দশমিক ৪ শতাংশ টাকা বরাদ্দের সুপারিশ করার পরে শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

আর্থসামাজিক বাস্তবতা ও সক্ষমতায় বাংলাদেশের কাছাকাছি এমনকি দুর্বল অনেক দেশও শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয় করছে। শিক্ষা খাতে ভুটান ৪ দশমিক ৮, মালদ্বীপ ১১ দশমিক ২০, ভারত ৩ দশমিক ১ শতাংশ আর বাংলাদেশের অবস্থান ১ দশমিক ৬৭ (২০২৪-২৫)। বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষকদের অবস্থান বিশ্বায়নের বিবেচনায় খুবই দুঃখজনক। দেশের ৯০ ভাগ শিক্ষা এখনো পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার মাধ্যমে। বাকি ১০ ভাগ সরকারি ও প্রাইভেট শিক্ষার মাধ্যমে। সারা চাকরি জীবনে দুইবার পদোন্নতি, প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সেই কলঙ্ক এখনো শেষ হয়নি। পারফরম্যান্সভিত্তিক পদোন্নতির ব্যবস্থা নেই, সময়ভিত্তিক পদোন্নতি এবং সারা চাকরি জীবনে দুটির বেশি পদোন্নতি নেই। ফলে এ পেশায় মেধাবীদের অংশগ্রহণ যেমন কম, তেমনি পেশাগত মান বৃদ্ধির চেষ্টাও কম। ফলে কোয়ালিটি শিক্ষা বাস্তবায়নের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। 

শিক্ষক সংগঠনের অবস্থান: বিশ্ব শিক্ষক দিবসের ঐতিহাসিক ঘোষণা এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণের দাবিতে বাংলাদেশের শিক্ষকরা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে করেছেন। তবে দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে স্বাধীন পেশাদারত্বের জায়গা থেকে বৃহৎ আন্দোলন সেই অর্থে হয়নি। জোটগত দীর্ঘ আন্দোলনের কারণে ১৯৮১ সালের জানুয়ারি থেকে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ নিয়ে এমপিওভুক্ত হয়ে বর্তমানে মূল বেতনের ১০০ ভাগের অধিকারী হয়েছেন। বাড়ি ভাড়া ১০০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, উৎসব বোনাস মূল বেতনের ২৫ ভাগ ও একটি পদোন্নতির শিকলে আটকে আছেন। কোনো কারণে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বকেয়া হলে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া বকেয়া পাওনা পাওয়া যায় না। গভর্নিং বডি দলীয়করণ হওয়ায় সামাজিক মর্যাদায়ও শিক্ষকরা পিছিয়ে। এ অবস্থা থেকে শিক্ষক সমাজ মুক্তি পাওয়ার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার জাতীয়করণ পৃথক নিয়োগ কমিশন, বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি চান। শিক্ষকরা শুধু ট্রেড ইউনিয়নের জায়গা থেকে তাদের ভূমিকা পালন নয়, জাতি গড়ার কারিগর হিসেবে, দক্ষ, যোগ্য মানবসম্পদ তৈরিতে অবদান রাখতে চান। তাদের দিয়ে এ কাজগুলো করে নিতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে, শিক্ষকদের একাডেমিক ফ্রিডমের আওতায় কারিকুলাম সিলেবাস প্রণয়ন পাঠদানের স্বাধীনতা প্রদান, শিক্ষা কাজের বাইরে অন্য কাজে যুক্ত না করাসহ পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিতকরণের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও রাজনীতিমুক্তকরণ নিশ্চিত করা এবং আর্থিক নিরাপত্তার জন্য শিক্ষায় অর্থায়ন বাড়ানো প্রয়োজন। ইউনেসকো ও সংবিধানের শিক্ষা প্রসঙ্গে সরকার যে অঙ্গীকার করেছে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষার মান বৃদ্ধিসহ বিশ্ব শিক্ষক দিবসের তাৎপর্য রক্ষা করা সম্ভব। সেই সাথে আন্তর্জাতিক ডিক্লারেশনে স্বাক্ষরকারী দেশ যাতে তা বাস্তবায়ন করে, সে বিষয়ে ইউনেসকোর তদারকি থাকা দরকার। বিশ্বব্যাপী শিক্ষক সমাজের মর্যাদা বৃদ্ধি পাক, সেই সঙ্গে শিক্ষক সমাজ ক্লাসরুমের পাঠদান কার্যক্রমসহ বস্তুনিষ্ঠভাবে দেশ, জাতি ও দক্ষ মানুষ গড়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি অধিকার যেমন ভোগ করবেন, সেই সঙ্গে দায়িত্বও পালন করবেন সেই প্রত্যাশা সবার ।

আকমল হোসেন: অধ্যক্ষ, লালমাটিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

শিক্ষায় শিক্ষকের মতামত গ্রহণ ও নতুন সামাজিক চুক্তি

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ 

‘শিক্ষায় শিক্ষকের মতামতে গুরুত্ব ও নতুন সামাজিক চুক্তি’ প্রতিপাদ্যে আজ ৫ অক্টোবর দেশে দেশে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হচ্ছে। তবে শিক্ষকের মর্যাদাসংক্রান্ত বিশেষ আন্তঃসরকার সম্মেলনের সুপারিশ ১৯৬৬ ও উচ্চতর শিক্ষা প্রদানকারী ব্যক্তিদের মর্যাদাবিষয়ক ইউনেসকোর সুপারিশমালা ১৯৯৭-এর স্মারক এ দিনটি ইউনেসকোর আয়োজনে এ বছর প্যারিস সদর দপ্তরে একদিন আগে ৪ অক্টোবর উদ্‌যাপনের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ইউনেসকো, আইএলও, ইউনিসেফ ও এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের যৌথ উদ্যোগে এ বছরের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের ধারণাপত্রে: বিশ্বজুড়ে উচ্চ আয় এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় একইভাবে শিক্ষকতা পেশার প্রতি বর্তমানে প্রদত্ত স্বল্প ও ক্রমহ্রাসমান গুরুত্বের উল্লেখ করা হয়েছে। এর বিপরীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে: শিক্ষা ব্যাহতকারী কভিড-১৯ মহামারীসহ সাম্প্রতিক সংকটের মধ্যেও এটা নিশ্চিত হয়েছে যে অনুকূল পরিবেশ এবং স্বায়ত্তশাসন পেলে শিক্ষকরা শিক্ষায় যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং এমন সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারেন, যা শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর উন্নয়ন নিশ্চিত করে। (সূত্র: OECD,UNESCO, TTF-2021) গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষকরা শিক্ষার বিষয়গুলো আয়ত্ত করে পাঠক্রমের বিষয়বস্তুকে অগ্রাধিকার দিয়ে মূল্যায়ন এবং প্রাসঙ্গিক করেন, সাধ্যমতো শ্রেণীকক্ষে প্রতিটি শিক্ষার্থীর দিকে মনোযোগ দেন এবং শ্রেণীকক্ষে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সচেষ্ট থাকেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় অর্জন ও অগ্রগতি সাধনে, তাদের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন সত্ত্বেও তাদের সৃজনশীলতা ও সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কথা বা পরামর্শ যথাযথভাবে বিবেচিত হয় না। শিক্ষকতা পেশাকে প্রভাবিত করে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তাদের কণ্ঠস্বর খুব কমই শোনা যায় বা মত প্রকাশ করতে খুব একটা উৎসাহ দেয়া হয় না। যদিও শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য তা যথেষ্ট গুরুত্ববহ। এসব পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এ বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবসের কর্মসূচিতে শিক্ষকদের মতামতের প্রতি কার্যকর গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা উন্নয়নের অপরিহার্য অংশ হিসেবে সেসব তাদের পেশাগত উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দিয়েছে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবের ‘হাই লেভেল প্যানেল অন দ্য টিচিং প্রফেশন’ ও সর্বশেষ ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন টিচার্স’-এর বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেখানে ক্রমবর্ধমান শিক্ষকস্বল্পতার সংকট ও তাদের অবনতিশীল কর্মপরিবেশের প্রসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। দিবসটির মূল বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবে বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের অভিব্যক্তি প্রকাশের অপরিহার্যতায় শিক্ষায় একটি নতুন সামাজিক চুক্তির প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে। সংগত কারণেই ২০২৪ সালের ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন টিচার্স’-এর ছয়টি সুপারিশ এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক: ১. সামাজিক সংলাপের মাধ্যমে সকল দৃষ্টিকোণ ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় অগ্রাধিকারে অন্তর্ভুক্ত সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ শিক্ষক নীতি প্রবর্তন। ২. শিক্ষা কর্মসূচি ২০৩০-এর অগ্রগতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন নির্ধারিত সূচকগুলোর ভিত্তিতে আরো স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রদানের লক্ষ্যে অধিকতর গ্রহণযোগ্য তথ্য পরিসংখ্যান সংগ্রহ। ৩. শিক্ষক-শিক্ষা ও পেশাগত উন্নয়ন কর্মসূচির নির্দিষ্ট বিষয় ও ব্যক্তিভিত্তিক কর্মসূচির পরিবর্তে জীবনব্যাপী, সহযোগিতামূলক ও শিক্ষক পরিচালিত প্রক্রিয়ায় রূপান্তর। ৪. শিক্ষকদের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে বর্তমানে প্রচলিত বেতন ভাতা ও প্রণোদনা বৃদ্ধি, চিকিৎসা ক্ষেত্রে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা ও ক্ষতিপূরণ এবং বেতান-ভাতার ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠা। ৫. বিদ্যমান আদর্শ নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জিডিপির ৬ শতাংশ এবং মোট সরকারি ব্যয়ের ২০ শতাংশ অর্থায়নে পাবলিক ও অভ্যন্তরীণ তহবিল থেকে সংগ্রহ নিশ্চিতকরণ। ৬. শিক্ষক ঘাটতি বা স্বল্পতা দূর করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং সকল স্তর ও পর্যায়ে শিক্ষকসংক্রান্ত নীতিগত পরিস্থিতি উপস্থাপন।

বিশ্ব শিক্ষক দিবস ও বাংলাদেশের শিক্ষক

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পরিমাণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫তম আর দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম। বিশ্বব্যাংক ও ইউনেসকোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাই প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়ে আসছে। আবার দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন পাচ্ছেন বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষকরা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে মালদ্বীপ; দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত; তৃতীয় অবস্থানে ভুটান; চতুর্থ অবস্থানে নেপাল। তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে এমপিও-বহির্ভূত বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো ও এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের এমপিওবহির্ভূত শিক্ষকরা।

শিক্ষানীতি ও শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরিবিধি

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, বিভিন্ন সরকারের আমলে প্রণীত শিক্ষানীতির কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বশেষ ২০১০ সালের শিক্ষানীতিরও খণ্ডিত বা আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। প্র সঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আগে চাকরিবিধি থাকলেও বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের চাকরিবিধি ছিল না। ১৯৭৯ সালে তা প্রণীত হলেও যুগোপযোগী সংস্কার হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত অশিক্ষক কর্মচারীদের চাকরিবিধি হলেও তা যথাযথ কার্যকারিতা পায়নি। বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী সমাজের একটা অংশ শিক্ষার মান উন্নয়নে সরব থাকলেও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, ক্যারিয়ার পাথ বা পেশাগত ধাপগুলো বা সামাজিক মর্যাদার প্রসঙ্গে অনেকেই মুখ খুলতে চান না। অন্যদিকে কর্তাব্যক্তিরা দালানকোঠার উন্নয়নকে অনেকে শিক্ষার উন্নয়ন হিসেবে দেখতে বা দেখাতে পছন্দ করেন। 

শিক্ষা উপদেষ্টার অবস্থান, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মূল্যায়ন

শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ ও হেনস্তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাকালে সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এখনো শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ ও নানাভাবে হেনস্তা করার ঘটনা ঘটছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। তিনি বলেন, যেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অপকর্মের অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। (প্রথম আলো, ৪.৯.২৪)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এক শিক্ষার্থী একটি ইংরেজি দৈনিকে লিখেছেন: শিক্ষক হয়রানির জন্য তারা নিজেরাই দায়ী।...শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা এবং তাই শিক্ষকরা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র দ্বারা সম্মানিত...। শিক্ষকরা যখন নিজেরাই অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়, তখন তারা ক্লাসে এসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে শেখানোর অধিকার হারান। তারা নিজেরাই বিভিন্ন ভুলের মধ্যে জড়িয়ে পড়েন বলে শ্রেণীকক্ষে এসে ভুলের বিরুদ্ধে আমাদের গাইড করতে পারেন না।... শিক্ষকতার মহৎ পেশা হোক সব রাজনৈতিক রং—সাদা, কালো, নীল, লাল, হলুদ থেকে মুক্ত। শিক্ষাকে নিরপেক্ষতার দিকে ফিরে যেতে দিন। এ পেশা যখন...পক্ষপাতিত্বমুক্ত থাকবে, তখনই আমাদের দেশে শিক্ষকদের হয়রানি অচল হয়ে পড়বে।... (২৯-০৯-২৪, দি ডেইলি সান)।

শিক্ষা নিয়ে ভাবেন এমন একজন অভিভাবক, পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা পত্রিকার কলামে লিখেছেন: ‘স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে শিক্ষকদের যে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি সেটা নয়, বেশকিছু পরিবর্তন হয়েছে, তবে এখনো যেসব বৈষম্য থেকে গেছে সেটা নিয়ে কাজ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছি। উন্নত বিশ্বকে যদি বাদও ধরা হয়, শুধু দক্ষিণ এশিয়ার গুটিকয়েক দেশের বিবেচনায়ও শিক্ষকদের সম্মানীর তালিকায় আমরা তলানিতে! এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আমাদের দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের যদি প্রশ্ন করা হয় তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? কেউ ডাক্তার হতে চায়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বড় অফিসার! কেউ কি শিক্ষক হতে চাই—এ কথাটি বলে? সম্ভবত এ রকম সংখ্যাটি অতি নগণ্য, কারণ সবাই আর্থিক নিরাপত্তা চায়, সবাই সামাজিক মর্যাদা চায়। তবে আমাদের প্রাথমিক কিংবা বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে যে বেতন দেয়া হয় তা কি আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে! কিংবা সামাজিকভাবে তাদের সেই মর্যাদা কি দেয়া হয়! অবশ্যই না! আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত যে বেতন দেয়া হয় তাতে ক্লাসের প্রথম সারির শিক্ষার্থীরা এ পেশায় আকৃষ্ট হবে সে চিন্তা করা অলীক স্বপ্ন! আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে এমন পরিবর্তন দরকার, যেখানে ক্লাসের প্রথম সারির শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার হিসেবে শিক্ষকতা চয়েজ করতে আর্থিক নিরাপত্তায় না ভোগেন। শিক্ষকতা মহান পেশা, শুধু মুখে মহান বললেই চলবে না, রাষ্ট্রকে শিক্ষকদের দায়িত্ব নিয়ে তাদের মূল্যায়ন করতে হবে।’(ভোরের কাগজ, ২৯-০৯-২৪)

এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক ড. মনজুর আহমদ বলেছেন, ‘আধিপত্য ও আনুগত্যের রাজনীতির প্রভাবে ও যোগ্য শিক্ষা নেতৃত্বের অভাবে গত দেড় দশক শিক্ষার গতিপ্রকৃতি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের যথার্থ আলোচনায় আগ্রহ দেখা যায়নি। সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমুক্ত বর্তমান সরকার নির্মোহ সংলাপে উৎসাহী হবে বলে আশা করা যায়।’ (প্রথম আলো, ২৬.০৮.২৪)

এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের দিনটিতে ভাবনার জন্য পাঁচটি সুপারিশ উপস্থাপন করা সমীচীন মনে করি: ১. ইউনেসকো ঘোষিত ২০১৫ সালের শিক্ষকনীতি ও স্কুল নেতৃত্বসংক্রান্ত সুপারিশ সক্রিয় বিবেচনা। ২. শিক্ষার্থীর জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের পাঠ সম্ভব করে তুলতে অঞ্চল ও এলাকাভিত্তিক শিক্ষক বিনিময় ব্যবস্থা চালু। ৩. জনসংখ্যা ও শিক্ষার্থীর অনুপাত এবং দেশের প্রতিটি অঞ্চলকে যথোপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষায় বরাদ্দ প্রদান এবং দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত স্থানীয় সরকার, অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ ও পৌরসভা/সিটি করপোরেশনগুলোকে শিক্ষায় অর্থায়নের উৎস হিসেবে পুনর্বিবেচনা। ৪. কোচিং বাণিজ্য নিরসনে প্রতিকারমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন: যে কারণে ও পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন হয়, তার অবসানকল্পে শ্রেণীকক্ষে পাঠ গ্রহণে পশ্চাৎপদ শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার/সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত প্রতিকারমূলক (রিমিডিয়াল) ও সমযোগ্যতা অর্জনে সহায়ক (লেভেলিং) প্রতিষ্ঠান স্থাপনপূর্বক প্রচলিত কোচিং বাণিজ্যের নিরসন। ৫. ইনচিয়ন ঘোষণার আলোকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মৌলিক শিক্ষার স্তর নির্ধারণ।

লেখাটি শেষ করব শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক সমীর রঞ্জন নাথের উদ্ধৃতি দিয়ে: প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী এবং ১২ লাখ ৭২ হাজার শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত এ শিক্ষা ব্যবস্থাটি পথে আনতে একটু দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু কাজটি এখনই শুরু করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রমকে ফলদায়ক ও টেকসই করার জন্য দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এবং যৌক্তিকভাবে এটিকে এগিয়ে নেয়া এই সময়ের চ্যালেঞ্জ। (প্রথম আলো, ৪.৯.২৪)

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ: সদস্য, এডুকেশন ওয়াচ। আহ্বায়ক, শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিরসনে কোয়ালিশন, বাংলাদেশ। ব্যক্তি-সদস্য, এশিয়া সাউথ প্যাসিফিক অ্যাসোসিয়েশন ফর বেসিক অ্যান্ড অ্যাডাল্ট এডুকেশন, (অ্যাস্বে)
[email protected]

নতুন যুগের শিক্ষায় শিক্ষকের কণ্ঠ 

মু. নাজমুল হক

আমরা শিক্ষকরা শিক্ষকতা করি বটে কিন্তু নতুন যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রেখে সমাজকে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করার কাজে নিজেরা কী ভূমিকা পালন করি? আমরা কি জানি যে আমাদের যুগটা বদলে যাচ্ছে? শিক্ষার্থীরা এখন আর আগের যুগের সুবোধ বালকের মতো ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারা দিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’ এমন ধ্যানধারণাকে আর বহন করে না। বরং অস্থির ও চিত্তচঞ্চল এ একবিংশ শতাব্দীর যুগে সারা দিন শিশুরা আকাশ মাধ্যম ও বাতাস সংস্কৃতির বহমান স্রোতে ভেসে বেড়াতে থাকে। শিশুদের এ ভেসে বেড়ানোর ফলে তাদের চিত্তে দীর্ঘমেয়াদি কোনো ছাপ সৃষ্টির সুযোগই হয় না। আমরা শিক্ষকরা কি ভাসমান এ শিশুদের চিত্তে গভীর রেখাপাতের কোনো কৌশল অবলম্বন করতে পেরেছি? কারণ কূলে থেকে ভাসমান কোনো প্রস্তরখণ্ডে ছায়াপাত করা যায় না। আমরা যারা কূলে থাকা শিক্ষক অর্থাৎ অতীত যুগের স্থাণু ব্যক্তিত্ব তাদের পক্ষে চলমান, বর্ধিষ্ণু ও অপার তথ্যের মধ্যে ছুটে চলা শিশুদের শিক্ষার ভার বহন করা সম্ভব নয়। 

বাংলাদেশের বিরাটসংখ্যক শিক্ষকের মধ্যে এমন শিক্ষক কতজন আছেন যারা প্রকৃত অর্থেই এসব সাগরে ভাসা সার্ফারদের মতো জ্ঞানের রাজ্যে ভেসে বেড়ানো শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত পদ্ধতিতে শিক্ষা দিতে সক্ষম? শিক্ষকের সাহায্য ছাড়া কোনো জাতিই জগতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। এখানে শিক্ষক বলতে কেবল শ্রেণীকক্ষে দাঁড়ানো ব্যক্তিকেই বোঝায় না বরং লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সমাজের যেকোনো পর্যায়ের গুরুজন এমনকি পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবও সমাজের শিক্ষক হয়ে থাকেন। এসব শিক্ষকই কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি হয়, যারা পরবর্তী প্রজন্মের শিশুদের জন্য শিক্ষক হিসেবে প্রকাশ পায়। সমাজে শিক্ষকের প্রভাব নির্ভর করে তার তুলনামূলক গভীর জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব ও বাহ্যিক আচার-আচরণের ওপর। একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার আদর্শ শিক্ষকই পরবর্তী প্রজন্মের উপযুক্ত শিক্ষক তৈরিতে সক্ষম হয়। 

উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবেই সমাজে তৈরি হয় দুর্নীতি, দুরাচার ও নানা রকম সামাজিক অবক্ষয় ও মনোব্যাধি। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় যে অবক্ষয়ের নমুনা দেখা যাচ্ছে তাও প্রকৃত অর্থেই এ অপরিণামদর্শী শিক্ষকের প্রভাব। সমাজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা শিক্ষকতা করছেন তাদের আদর্শের কথা তুললেই পাল্টা জবাব আসে, ‘আমরা কতটা সচ্ছল যে আমাদের কাছে আদর্শ চাওয়া হয়?’ আসলে জীবনাদর্শ, কর্মস্পৃহা, নিষ্ঠা ইত্যাদির সঙ্গে আর্থিক সচ্ছলতার সম্পর্ক কমই আসে। আমরা যদি এ উপমহাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির দিকে তাকাই তাহলে এ গুণগুলোর সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক কমই পাব। 

সুতরাং প্রয়োজন হলো শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো। এর জন্য বাইরের শক্তির যতটা না প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষক সমাজের ভেতরের সংগঠিত শক্তি ও পচেষ্টা। শিক্ষকতায় কর্মসংস্থানের প্রাচুর্যের কারণে শিক্ষিত তরুণ সাময়িক তাকিদের কারণে সাময়িকভাবে এ পেশায় সংযুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু এ পেশাকে জীবনসঙ্গী করার দৃঢ় সংকল্প হয়তো অনেকেরই থাকে না। অতএর যাদের এ পেশায় থিতু হওয়ার ইচ্ছাটা কম থাকে তারাই পেশা পরিবর্তনের চেষ্টায় জীবনের দীর্ঘ একটা সময় অতিক্রম করে যায়। এর পাশাপাশি আর একটি দল শিক্ষকতা পেশাকে স্থায়ী রেখে আনুষঙ্গিক আরো কিছু কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখে শিক্ষকতার জীবন অতিবাহিত করে যায়। 

উপরোক্ত আলোচনায় মোটামুটি তিন ধরনের শিক্ষক পাওয়া যায়। প্রথমত, যারা নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, অন্য কোনো ধ্যান দ্বারা প্রভাবিত হন না; দ্বিতীয়ত, যারা নানাবিধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ পেশায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। তৃতীয়ত, আর এক শ্রেণী যারা অবস্থান্তর পর্যায়ের শিক্ষক, অর্থাৎ পেশা পরিবর্তনে নিরন্তর সচেষ্ট। আমাদের দেশে এই তিন শ্রেণীর শিক্ষকদের মধ্যে কোন শ্রেণীর আধিক্য রয়েছে সেটা অনুমান করার ভার আমি পাঠকের ওপরই ছেড়ে দিলাম। 

এবার আসা যাক, শ্রেণী শিক্ষকের কর্মযোগ্যতা নিয়ে, যারা বর্তমান সমাজে ভেসে বেড়ানো শিশু-কিশোরদের শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে গেলে এ শিক্ষকের অধিকাংশই একবিংশ শতাব্দীর এসব শিশুকে শিক্ষা দেয়ার জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেননি অথবা তাদের সেইভাবে প্রশিক্ষিত করাও হচ্ছে না। এখন এই শিক্ষকদের কাছে যদি প্রত্যাশা করা হয় যে তারাই নতুন যুগের এসব শিক্ষার্থীকে মধ্যে জ্ঞান, দক্ষতা ও উপযুক্ত মানবিক গুণাবলি সৃষ্টি করে দেবেন তাহলে সেটা কখনই সঠিক হবে না। যুগোপযোগী করে শিক্ষককে প্রশিক্ষিত করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষকের সার্বিক চাহিদাগুলো পূরণে আন্তরিক হতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষককে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তার সামাজিক মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার পাশাপাশি যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম দিয়ে তাদের কর্মে নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দেশে যে রাজনীতি আমরা এতদিন প্রত্যক্ষ করে আসছি সেটা  তাদের মান-মর্যাদাকে এতটাই বিনষ্ট করেছে যে এখন সমাজে মাথা তুলে দাঁড়ানোর পথে তারা অনেকটা অন্তরায় অনুভব করছে। তাদের মর্যাদাহানিকর অবস্থাটি আমরা তখনই প্রত্যক্ষ করি যখন দেখি যে তাদের ন্যায়সংগত দাবিগুলো কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য অসম্মানজনকভাবে ফুটপাথে পড়ে থাকতে হয় এবং তার চেয়েও বেশি যখন দেখা যায় যে পুলিশ তাদের গরু-ছাগলের মতো করে তাড়া করে ফুটপাথ থেকে অলিগলিতে নিয়ে যায়। যে সমাজের শিক্ষকরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয় সেই সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনলেও ফলাফল শিক্ষার্থীর সার্টিফিকেট প্রাপ্তি পর্যন্তই গড়াবে। 

শিক্ষার মান উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষকের সার্বিক গুণগত ও সামাজিক মর্যাদার উন্নতি সাধন। শিক্ষকের উন্নতি ছাড়া কোনো শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। একটি আদর্শ ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সাফল্যও মানসম্পন্ন শিক্ষকের ওপরই নির্ভর করবে। অতএব শিক্ষকের মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন তার একটি ন্যূনতম পর্যায়ের সাধারণ শিক্ষা, অত্যন্ত উন্নত মানের প্রশিক্ষণ এবং তাকে একটি উঁচু সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। এ কাজে প্রধানত দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে। তার একটি হলো সরকারি ব্যবস্থাপনা এবং দ্বিতীয়টি হলো শিক্ষক সমিতি। 

শিক্ষকের মান বৃদ্ধির জন্য সরকার যৎসামান্য প্রচেষ্ট চালালেও শিক্ষক সমিতি তাদের মান উন্নয়নের বিষয়কে সর্বদাই বেতন-ভাতা ও চাকরির সুযোগ-সুবিধার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। অতএর শিক্ষকদেরই তাদের নিজস্ব মান বজায় রাখার দায়িত্ব নিতে হবে, যেটা তারা সমিতির মাধ্যমে সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা করেননি। আমাদের এ সমিতির একটা বড় দুর্বলতা হলো তারা কখনই সকলে এক ছাতার নিচে আসতে পারছেন না এবং সে কারণেই নিজেদের পেশাদারি দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যাপারেও তারা কোনো পদক্ষপে নিতে পারছে না। দেশীয় রাজনীতি শিক্ষা প্রসারের আর একটি বড় অন্তরায়। শিক্ষকরা দলে দলে বিভক্ত, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে নেতারাও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না। প্রয়োজন জাতীয় নেতাদের মধ্যেও উন্নত শিক্ষা চেতনার বিকাশ ঘটানো।

আধুনিক যুগের শিক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখতে হলে শিক্ষকদের একত্র হতে হবে, একসঙ্গে আওয়াজ তুলতে হবে ‘আমরা শিক্ষক আমরা অবহেলার পাত্র নই’। শিক্ষকদের সব অবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিজেদেরই করতে হবে, সরকারের আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। শিক্ষক নিজেরাই নিজের দেশের শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করবে, শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করবে, শিক্ষার গুণগত মান রক্ষা করবে এবং শিক্ষকের গ্রহণযোগ্য মান নিরূপণ করবে, তবেই দেশের একটি বহুল প্রত্যাশিত সমস্যার সমাধান নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। 

মু. নাজমুল হক: সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৮১৮০১৯৩-৪ (বিজ্ঞাপন), ৮১৮০১৯৬-৭ (সার্কুলেশন)

ই-মেইল: [email protected]