সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি: বৈষম্য ও অধিকার

দারিদ্র্য দূর করতে হলে দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা

প্রকাশ: অক্টোবর ০৩, ২০২৪

বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বহুবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ এ খাতে ব্যয় হলেও কর্মসূচিগুলোর প্রকৃত প্রভাব প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম—এমন মন্তব্য করে বিদ্যমান বৈষম্য কমিয়ে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর বাড়ানোর আহ্বান জানান অর্থনীতিবিদরা। দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে ২৫ সেপ্টেম্বর আয়োজিত ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি: বৈষম্য ও অধিকার’ শীর্ষক এক জাতীয় সংলাপে তারা এ আহ্বান জানান। দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ওয়েভ ফাউন্ডেশন এ সংলাপ আয়োজন করে। এতে মিডিয়া সহযোগী হিসেবে ছিল বণিক বার্তা


কানিজ ফাতেমা

উপ-পরিচালক

ওয়েভ ফাউন্ডেশন

বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ওয়েভ ফাউন্ডেশন ‘একটি ন্যায্য ও সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার’ রূপকল্প নিয়ে ১৯৯০ সাল থেকে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। বিগত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এ ধারাবাহিকতায় দি এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় নভেম্বর, ২০২১ সাল থেকে ‘রাইজিং সিটিজেনস্ ভয়েস ফর এনশিওরিং ট্রান্সপারেন্সি অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি অব সোশ্যাল প্রটেকশন প্রোগ্রামস (এসপিপিএস)’ শীর্ষক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সংক্রান্ত প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে সংবেদনশীল, অন্তর্ভূক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক করা। 

দারিদ্র্য বিমোচন এবং খাদ্যনিরাপত্তার জন্য প্রধান কর্মসূচি ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি’, যার মাধ্যমে দেশের অতিদরিদ্র ও সর্বাধিক ঝুঁকিগ্রস্ত নাগরিকদের ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা প্রদান করতে চায়; একই সাথে সুরক্ষিত রাখতে চায় দারিদ্র্যে নিপতিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে। একটি কল্যাণ রাষ্ট্র নির্মাণে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আয়বর্ধক কার্যক্রম, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ, মূলধন সরবরাহ ও  গঠন, খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন মাত্রায় দারিদ্র্য হ্রাস এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি হ্রাসে অবদান রাখছে। তবে বিভিন্ন গবেষণা ও প্রমাণ থেকে দেখা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরো ভালো সুরক্ষা প্রদানের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কার্যকারিতা এবং বিতরণ ব্যবস্থা উন্নত করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বিষয়ে সচেতনতার পাশাপাশি সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা ও পরিমাণ বৃদ্ধি, সঠিক গ্রহীতা নির্বাচন, ভাতা প্রাপ্তির পদ্ধতি সহজীকরণ, ইত্যাদির কোনো বিকল্প নেই।

মীর মোস্তাক আহমেদ

প্রকল্প সমন্বয়কারী ওয়েভ ফাউন্ডেশন

মানিকগঞ্জ জেলার দুটি উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এখানে নাগরিক ফোরামকে সংগঠিত করা হয়েছে। প্রতি ইউনিয়নে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যাতে তারা বিভিন্ন ফোরামে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে পারে এবং সমাজে ব্যাপকভাবে সচেতনতা তৈরি হয়। স্থানীয় মানুষকে সাথে নিয়ে সোশ্যাল অডিট সম্পন্ন করা হয়েছে। ৩৬০ জন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। সেখান থেকে কিছু ফাইন্ডিংস এসেছে। যেমন ৩৩ শতাংশ ভিজিডি কার্ডের সুবিধাভোগীর কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই।

সাকিবুল হাসান

ঢাবি শিক্ষার্থী ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে সাত থেকে আটদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। চারটি জেলায় গিয়েছি। সাধারণ মানুষ পরিবর্তন চায়। প্রবীণরা পরিবর্তনে বিশ্বাস করতে চায় না। এই যে বর্তমানের পরিবর্তনটা সেটা কিন্তু আমরা করতে পেরেছি। প্রবীণদের সহায়তা দরকার এ পরিবর্তনের যাত্রায়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দরকার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে এগুলো না থাকার জন্যই। নিজের চোখের সামনে ১৫ জনকে মরতে দেখেছি। সেখান থেকেই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছি। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার ছিল।

শারমীন আক্তার 

শিক্ষার্থী

ইডেন মহিলা কলেজ

অধিকার ও উন্নয়নের কর্মসূচি যা নেয়া হয়েছে সেগুলো অবশ্যই বাস্তবায়ন করা হবে। যে অধিকার আমরা চাচ্ছি, সেটি প্রান্তিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সমানভাবে পাবে সেই প্রত্যাশা রাখি। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উন্নয়ন দরকার। যদি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সঠিকভাবে উন্নয়ন করা সম্ভব হয় তাহলে সবকিছুরই উন্নয়ন হবে।

ড. আসিফ এম. শাহান

সহযোগী অধ্যাপক উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সহযোগী অধ্যাপক উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৫ সালে প্রণীত জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র (এনএসএসএস) দুটি ধাপের মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা। যার প্রথম ধাপটা প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিবেচনায় স্থানীয় সরকার শাসন ব্যবস্থায় দলগুলোর মাঝে অনেক মতপার্থক্য থাকে। তবে সামাজিক নিরাপত্তা জাল এমন একটা বিষয়, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে মোটা দাগে একটা মতৈক্য ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক নিরাপত্তা জালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। শুরুতে বন্যা, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসূচিগুলোর জন্ম। আশির দশকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করার জন্য কর্মসূচিগুলো এসেছে। নব্বইর দশকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার মতো কর্মসূচিগুলো শুরু করা হয়েছে। একই সঙ্গে খাদ্যনির্ভর সামাজিক নিরাপত্তা জালের দিকে কর্মসূচিগুলো স্থানান্তরিত হয়েছে। এর পরও ২০১৪ সালে এসে আমরা উপলব্ধি করলাম, ওই মুহূর্তে ২৩টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪৫টি সামাজিক নিরাপত্তা জাল ছিল। এগুলোর সুবিধাভোগী নির্বাচনে সমস্যা ছিল। ফলে যে কার্যকারিতা হওয়ার কথা ছিল তা আমরা দেখিনি। তারই প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালে এসে জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র (এনএসএসএস) তৈরি করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক নিরাপত্তা জাল নিশ্চিত করা। যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে সুবিধাভোগীর আওতায় নিয়ে আসা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একজন মানুষ দারিদ্র্যের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেয়ে দারিদ্র্যের মূল কারণগুলোকে চিহ্নিত করে তা দূর করাই ছিল এনএসএসএসের লক্ষ্য। যে কারণে জীবনচক্র পন্থাকে জোরালোভাবে গ্রহণ করা হয়। যেখানে জীবনচক্রের প্রতিটি পর্যায়ে মানুষের কী ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, সেগুলো নির্ধারণ ও সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগীদের সুবিধাভোগী করা হবে।

অধ্যাপক 

ড. এম এম আকাশ

চেয়ারম্যান, ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ অর্থনীতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কাদের দিতে চাই? যদি ২৫ শতাংশ লোককে দিতে চাই তাহলে তিন কোটি মানুষ হবে। এর মধ্যে দেড় কোটি নারী। আমরা দিচ্ছি ১৬ লাখকে নারীকে। এমন লোককে আমরা দিচ্ছি যারা প্রাপ্য নয়। প্রয়োজনের তুলনায় ১০ ভাগের এক ভাগও পাচ্ছে না। মৌলিক সমস্যা হলো বণ্টন। জাতীয় বাজেটে কেন দারিদ্র্যের অধিকার বাস্তবায়ন করতে পারছি না তার কারণ জবাবদিহিতা নেই। আর দারিদ্র্যেরও ভয়েস নেই। আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করতে পারছি কিনা যেখানে দরিদ্ররা অধিকার না পেলে টুঁটি চেপে ধরতে পারবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মেকানিজম চালু করতে হবে। সংসদ সদস্যরা বিলিবণ্টন তার রাজনৈতিক সুবিধার জন্য করে থাকে। তাই রাজনৈতিক সুবিধার জন্য বিলি-বণ্টন বন্ধ করতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় এটি সম্ভব না। বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যবহার করতে হবে। দারিদ্র্যের ম্যাপিং করতে হবে। যদি বরিশালে বেশি দারিদ্র্য থাকে তাহলে সেখানে বেশি বরাদ্দ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সুবিধা ব্যবহার করে অর্থ ও পেশিশক্তি দিয়ে নির্বাচনে জিতলে হবে না। সেনাপ্রধান বলেছেন ১৮ মাসে নির্বাচন হবে। কিংস পার্টি তৈরি করা যাবে না। অনির্বাচিত সরকার রাখা যাবে না। 

ড. মাহফুজ কবীর

গবেষণা পরিচালক

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ

২০১৯-এর একটা মিশ্র সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক সুরক্ষা সুবিধাভোগী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ৬০-৬৫ শতাংশ ভুল আছে। তার মানে যাদের আমরা ভাতা দিচ্ছি, তাদের মধ্যে অনেকই ভাতা পাওয়ার যোগ্য নয়। সমাজকল্যাণমন্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনেও ভরা তালিকা আমরা দেখতে পেয়েছি। বিষয়গুলো অসুখের মতো হয়ে গেছে। এখানে মৌলিক পরিবর্তন দরকার। পরিসংখ্যানে দেখতে পাই, দেশের প্রায় সাত-আট কোটি মানুষই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আসার যোগ্য নয়। তবে তারা তা পাচ্ছেন। আসলে কী হচ্ছে? গ্রামের মূল্যস্ফীতি সবসময় শহরের চেয়ে কম ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে দেখেছি, সেটা বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের সিন্ডিকেট সেখানেও চলে যাচ্ছে কিনা। বস্তির প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ কোনোভাবে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা পাচ্ছে না। অজুহাত হচ্ছে, তার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। তারা কি এ দেশের নাগরিক নয়? নারীরা যারা শহরে বাস করে, তারাও ভাতা পাচ্ছে না।

জাকিয়া আফরোজ

পরিচালক 

(অতিরিক্ত সচিব)

মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর

সরকার ভিডব্লিউবির মাধ্যমে নারী ও শিশু সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তবে কর্মসূচি বাস্তবায়নে এখনো নিড অ্যাসেসমেন্ট হয়নি। যার ফলে আমাদের প্রকৃত উপকারভোগীর সংখ্যা নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সুবিধাভোগী সিলেকশনের ক্ষেত্রে সঠিক মানুষকে সিলেকশন করতে পারাটাও বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা ২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা বাজেট পেয়েছি। ১০ লাখ ৪৪ হাজার লোক এ সুবিধা পাচ্ছে। প্রতি বছর ১০ শতাংশ করে সুবিধাভোগী বাড়ানোর কথা, কিন্তু বাজেটস্বল্পতার জন্য সেটা সম্ভব হয় না। ৩০ কেজি চাল দিলে দারিদ্র্য দূর হবে কিনা সেটাও অ্যাসেসমেন্ট করতে হবে। মহিলাদের মধ্যে যাদের আর্থিক সহায়তা করা হয়, অনেক সময় দেখা যাচ্ছে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকে না। তাদের স্বামী অথবা পরিবারের কারো অ্যাকাউন্টে টাকা নেয়। ফলে সরাসরি সে টাকাটা পাচ্ছে না। আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যেন সরাসরি তারা টাকাটা পায়।

আইয়ুব খান

উপ-পরিচালক (নিবন্ধন)

সমাজসেবা অধিদপ্তর

বয়স্ক, বিধবা ভাতার মতো জনপ্রিয় ৫৪টি কর্মসূচি পালন করে থাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সরকার এ পর্যন্ত ৬০ লাখ ১ হাজার লোককে বয়স্ক ভাতা দিচ্ছে। বিধবা ভাতা দিচ্ছে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার জনকে। প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া হচ্ছে ২৫ লাখ ৩৪ হাজার জনকে। বেদে, হিজড়া ইত্যাদি জনগোষ্ঠীসহ প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ লোককে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। তবে বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক সময় সরকারি সংস্থাগুলো শতভাগ চেষ্টা করেও নির্ভুল তালিকা তৈরি করতে পারে না। বাছাইয়ের অংশ হিসেবে আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সরকারের যথেষ্ট প্রচারণা তহবিল নেই এখানে। যথেষ্ট জনবলের অভাব আছে। সেজন্য আমাদের স্থানীয় কোনো না কোনো ব্যক্তি বা জনপ্রতিনিধির ওপর নির্ভর করতে হয়। তখন তারা প্রথমেই নিজস্ব লোককে ভাতা দিতে চায়। সেজন্য আমরা এখন অনলাইন প্রক্রিয়ায় উন্মুক্ত ভাতায় চলে এসেছি। অর্থ আদান-প্রদানে যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য সরকার জিটুপি (গভর্নমেন্ট টু পারসন) পদ্ধতিতে গেছে। আগে এ ভাতা পাওয়ার জন্য অনেককে ব্যাংকে আসতে হতো। আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক টাকা ব্যয় হতো। যাদের ভাতা দেয়া হয় তারা অত্যন্ত অসহায়। এ রকমও ব্যক্তি আছেন যিনি বিছানা থেকে উঠতে পারেন না, তার জন্য ভাতার টাকাটা ব্যাংক থেকে নিয়ে আসা অনেক কঠিন।

এখন বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যে সীমাবদ্ধতা আছে, সেখানে বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) সহযোগিতা করতে পারে। আমাদের প্রায় ৭০ হাজারের মতো এনজিও আছে। 

আমানুর রহমান

চিফ অব পার্টি

থ্রিভ অ্যাক্টিভিটি

কেয়ার বাংলাদেশ

অভিযোগ দায়ের করার যে পদ্ধতি তাতে আমরা অভ্যস্ত নই। আমরা যারা শহরে থাকি কিংবা এখানে যারা বসে আছি, তারা কখনো অভিযোগ বক্সে কোনো চিঠি দিয়েছি কিনা জানি না। এটা আমাদের অনুশীলনের সংস্কৃতিতে নেই। কিন্তু আমাদের অভিযোগের শেষ নেই। এটাকে আমাদের সাংস্কৃতিক অনুশীলনের মধ্যে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ, গার্মেন্টস ও কারখানায় অভিযোগ বক্স দিয়েছি। সেখানে অভিযোগ জমা পড়ে না। বেনামে অভিযোগ দিতে বলার পরও উন্নতি হয়নি। অভিযোগ বলতে যদি কারো সমস্যা থাকে, তাহলে আমরা পরামর্শ বলতে পারি। এর পরও কোনো ফলাফল আসেনি। মোদ্দা কথা, অভিযোগের আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে আমাদের অভ্যস্ততা নেই। এ জায়গায় বড় ধরনের প্রচারণা দরকার। মানুষের তো রাগ, ক্ষোভ আছে। সেটা যদি শোনানোর কোনো প্রক্রিয়া না থাকে তাহলে এটা কোনো কাজে লাগবে না। আমরা কিছু ডিজিটাল বেনিফিট নিয়েছি। সরকারি নতুন কোনো নীতিনির্ধারণ কিংবা বাজেটের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গিয়ে পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু এগুলো কেউ পড়েছে কিনা আমরা জানি না। এ পদ্ধতিগুলো নিয়ে আমাদের আরো নিবিড়ভাবে কাজ করা দরকার। গবেষণায় এসেছে, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনের তিনজন কখনই কোনো সামাজিক সুরক্ষা পাননি। শতকরা হিসাবে এটা ৬৪ শতাংশ। তার মানে হলো এসব কর্মসূচির বিষয়ে মানুষ জানে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন হয়, এটা নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দলীয় প্রতীকের বাইরে গিয়ে পুরনো পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে আমাদের সমাজে বিভাজন হতো না।

মহসিন আলী

প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক

ওয়েভ ফাউন্ডেশন

ওয়েভ ফাউন্ডেশন টেকসই উন্নয়ন; জলবায়ু ন্যায্যতা; সুশাসন, অধিকার ও ন্যায্যতা এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে সাফল্য এসেছে সেক্ষেত্রে আমাদের পদ্ধতিগত সংস্কার এবং তা বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়া, নগর ও পার্বত্য অঞ্চলে যথেষ্ট বরাদ্দ বৃদ্ধি, স্থানীয় সরকারের কাঠামো সংস্কার, জবাবদিহিতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের আরো কাজ করে যেতে হবে। নাগরিক সমাজের সংগঠন হিসেবে আমরা যেমন সোচ্চার আছি। তবে আমাদের ভয়েজ অতদূর যায়নি। অধিকার বৈষম্যের কথা আমরা তুললেও সমগ্র মানুষকে উৎসাহিত করতে পারিনি। কিন্তু ছাত্ররা পেরেছে। তার সঙ্গে জনতা যুক্ত হয়েছে। এ সময় যেন আমরা সঠিক কাজটি করতে পারি। আমরা ২০০৪ সাল থেকে সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে আসছি। এ রকম অনেক কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা সরকারকে অনেক ধরনের প্রস্তাব দিয়েছি। অনেক মিটিং করেছি। এমপিদের পাশে বসিয়ে মিটিং করেছি। কাজ হয়নি। কখনো কায়দা করে কথা বলতেন, কখনো বলতেন আরেকটু অপেক্ষা করেন। পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটিতেও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, আলোচনা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু হয়নি। এবার সেই না হওয়াটা যেন হয়। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি যথাযথ বাস্তাবায়নে স্ট্রাকচার হিসেবে স্থানীয় সরকার একটা বড় বিষয়। কিন্ত আমাদের স্থানীয় সরকার পিপলস ফ্রেইন্ডলিও না, দরিদ্র ফ্রেইন্ডলিও না। ইলেকটেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ফ্রেইন্ডলি। যখন যে সরকার থাকবে সরকারি লোক সুবিধা পাবে। এ রকম স্থানীয় সরকার আমরা চাই না। এটি স্বচ্ছ করার একটিই প্রক্রিয়া। নগর ও পার্বত্য অঞ্চলেও পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। ঢাকা শহরে বস্তির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পার্বত্য অঞ্চলেও বড় বৈষম্য আছে। তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি এবং দারিদ্র্য দূর করতে হলে তাদের নিয়ে কমপ্রিহেনসিভ পরিকল্পনা করা দরকার।

ড. শহীদুল ইসলাম জাহিদ

অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বৈষম্য শুধু আজকে নয়। আজ থেকে ১০০ বছর আগেও বৈষম্য ছিল। সেজন্য কবি নজরুল লিখেছিলেন কুলি মজুর কবিতা। এখন আগামীতে যে বৈষম্য থাকবে না এ নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আমরা শুধু বৈষম্য কমানো নিয়ে কথা বলতে পারি। শুধু দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে কথা বলি। কিন্তু ভাতের বৈষম্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির বৈষম্য নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট নয়। দারিদ্র্যের সীমারেখা প্রতিদিন ২ ডলার আয়ের সক্ষমতা কতজনের আছে? স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে ২২-২৫ হাজার টাকার একটা বেতনের জন্য একটা শিক্ষার্থীকে কতটা পরিশ্রম করতে হয়। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে কিংবা আয়বৈষম্য দূর করতে আমরা যে খুব একটা চেষ্টা করেছি তা দাবি করতে পারি না। আমি মনে করি, দারিদ্র্য জিইয়ে রাখলে অনেক মহলেরই কাজ করতে সুবিধা হয়। এটা রাজনৈতিক মহল, ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা গুলশানের কথা বলা যায়। ওখানেই বাতির নিচে অন্ধকার। 

ড. এস এম জুলফিকার আলী

গবেষণা পরিচালক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান

সামাজিক নিরাপত্তা বলয় কর্মসূচি বলতে সাধারণত আমরা বুঝি, এ কর্মসূচি দরিদ্র, হতদরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষদের সাহায্য করবে। কিন্তু আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে দেড়শর কাছাকাছি প্যাকেজ আছে। এটার বরাদ্দ বাজেটের ১৬-১৭ শতাংশ। জিডিপির অংশ হিসেবে ২+ শতাংশ। এর মধ্যে বড় একটি অংশ পেনশন। পেনশন বাদ দিলে বরাদ্দটা বাজেটের ১১ শতাংশে নেমে আসে। জিডিপির অংশ হিসেবে ১ শতাংশেরও নিচে নেমে আসে। আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা বলয় কর্মসূচিকে শ্রেণীগতভাবে আলাদা করে দেখা দরকার। যাতে আমরা বুঝতে পারি, দরিদ্র ও বঞ্চিতদের জন্য কোন কর্মসূচিগুলো আছে এবং সেখানে প্রকৃত বরাদ্দ কত। না হয় এটা বিভ্রান্তিকর থেকে যায়। দ্বিতীয়ত, উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নির্বাচন সক্ষমতা। এখনো আমরা সুবিধাভোগী নির্বাচন সঠিকভাবে করতে পারিনি। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা, তারা অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে না। যারা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা নয়, তারা রাজনৈতিক কারণ, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির কাছের লোকজন হওয়া কিংবা আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ জিনিসটা এখনো পুরোপুরিভাবে আমরা চিহ্নিত করতে পারিনি। এটা জরুরিভাবে চিহ্নিত করা দরকার।




সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৮১৮০১৯৩-৪ (বিজ্ঞাপন), ৮১৮০১৯৬-৭ (সার্কুলেশন)

ই-মেইল: [email protected]