বিখ্যাত যারা সমাহিত

প্রকাশ: অক্টোবর ০১, ২০২৪

মাহমুদুর রহমান

ঢাকা শহরে বেশকিছু কবরস্থান আছে। এর মধ্যে বিখ্যাত হলো আজিমপুর করবস্থান, বনানী কবরস্থান। এর বাইরে আছে খ্রিস্টান কবরস্থান, যাকে সিমেট্রি বলে অভিহিত করা হয়। মূলত পৃথিবীর প্রতিটি দেশে সমাধির জন্য আলাদা স্থান থাকে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি আবার নানা কারণে বিশেষ হয়ে ওঠে। এমনই বিশেষ এক গোরস্তান ওয়াদি আস সালাম। ইরাকের এ সমাধিস্থল পৃথিবীর বৃহত্তম। বহু মানুষ ঘুমিয়ে আছে সেখানে। প্রায় দেড় হাজার একরের এ সমাধিস্থলে সমাহিত হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। একদম সাধারণ মানুষ যেমন আছে, তেমনই আছে অনেক বিখ্যাতও।

ইরাকের এ বিস্তৃত সমাধি বহু বছরের। এ সময়ে জায়গা করে নিয়েছে বিখ্যাত অনেক মানুষ। তাদের মধ্যে আছেন দ্য গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ, মুহাম্মদ বাকির আল সদর, মুহম্মদ সাদিক আল সদর প্রমুখ। এছাড়া এখানে সমাধিসৌধ আছে নবী হুদ (আ.) ও সালিহ (আ.)-এর। মুহম্মদ মাহাদি বাহার উল উলুমের অনুরোধে এ দুটি সমাধিসৌধ নির্মিত হয়। এছাড়া ইমাম মাহাদি ও ইমাম জাফর আল সাদিকের সম্মানেও জায়গা রাখা আছে ওয়াদি আস সালামে।

এছাড়া রইস আলি দেলভারি, খালো হোসেন বোর্দ খুনি দাশতি, সৈয়দ আলি কাদি তবাতবায়ি, আবদুল হোসেন আমিনি, লায়লা কাসিম, মির্জা ইয়হিয়া খোয়ি, আমিনা আল সদর, গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ মুহম্মদ সাদেক আল সদর, গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ মুহম্মদ বাকির আল সদর, হুসেন কুলি খান ফেয়ি ও আরো অনেক ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সমাধি রয়েছে এ গোরস্তানে।

রইস আলি দেলভারি ছিলেন ইরানের একজন সেনা কর্মকর্তা। তার জন্ম ১৮৮২ সালে বুশেরে। ইরানে তিনি জাতীয় নায়ক হিসেবে মর্যাদা পান। কেননা ইরানে ব্রিটিশ আক্রমণের সময় তিনি তার দল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বুশেলে তিনি তাঙ্গেস্থান নামে একটি ধারা গড়ে তোলেন। কিন্তু ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ আক্রমণের চাপে একসময় এ প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। তবে রইস আলি শুরু থেকেই তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রইস আলি একটি ব্রিটিশবিরোধী প্রতিরোধ তৈরি করেন। ১২ জুলাই তার তাঙ্গেস্থানি দল ব্রিটিশ রেসিডেন্সি আক্রমণ করে। বুশেরে তাদের তীব্র আক্রমণ শুরু হলেও ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে পেরে ওঠেনি স্থানীয়রা। ৮ আগস্ট ব্রিটিশরা বুশের দখল করে ফেলে। এরপর তারা ধীরে ধীরে আশপাশের আরো অঞ্চল দখল নেয়। রইস আলিকে ২ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয়।

রইস আলি দেলভারির বাড়ি দেলভারে। তার বাড়িটিকে পরে একটি জাদুঘরে পরিণত করা হয়। সেখানে তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সংরক্ষণ করা আছে। বুশেরে ঘোড়ার পিঠে দেলভারির একটি ভাস্কর্যও আছে, কিন্তু তাকে সমাহিত করা হয়েছে ওয়াদি আস সালামে।

ইরানের জন্য এ ঘটনা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ ঘটনার মাধ্যমে পারস্যে এক ধরনের জাতীয়তাবাদ ও প্রতিরোধ শুরু হয়, যা পরে ইরানকে তৈরি করায় ভূমিকা রাখে। রইস আলি দেলভারির এ বীরত্ব ও যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিল আরো কিছু মানুষ। বিশেষত বুশেরে ঘটা এ প্রতিরোধে অংশ নেয় বুশেরের সাধারণ মানুষ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিখ্যাত। এমনই একজন হলেন খালো হোসেন বোর্দ খুনি দাশতি।

বোর্দ খুন মূলত বুশেরের একটি অঞ্চল। সেখানকারই মানুষ ছিলেন খালো হোসেন। রইস আলির সঙ্গেই তিনি ১৯১৫ সালে লড়েছিলেন বুশের রক্ষার জন্য। রইস আলি, খালো হোসেনের সঙ্গে এ প্রতিরোধে সাহায্য করেছিলেন উইলহেম ওয়াসমুস নামে একজন জার্মান কূটনীতিক।

১৯১৫ সালের সে যুদ্ধ বা ব্রিটিশ আক্রমণ রুখতে পারেনি বুশের। অঞ্চলটি স্বাধীনতা হারায়। রইস আলি মারা যান। কিন্তু রইস, উইলহেম ও খালো হোসেনকে মনে রেখেছে ইরান। খরমুজে আছে তারও একটি ভাস্কর্য। তিনিও বুশের বা খরমুজে সমাহিত হননি। বোর্দ খুনের এ বীরকে সমাহিত করা হয়েছে ওয়াদি আস সালামের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের কোনো এক জায়গায়।

তাবরেজে ১৮৮৬ সালে জন্মেছিলেন আলি কাজি তবাতবায়ি। তিনি সাইয়েদ আলি কাজি তবাতবায়ি নামে পরিচিত। আবার আল্লামা কাদি নামেও তিনি পরিচিত। তিনি ইরানের অন্যতম একজন আলেম। কাদির বাবা হোসেন কাজি ছিলেন মির্জা শিরাজির একজন ছাত্র।

তবাতবায়ি শিক্ষা পেয়েছিলেন বড় বড় ইসলামী প্রতিভাবানদের কাছ থেকে। এর মধ্যে আছেন মির্জা মুসা তাবরেজি, মুহম্মদ আলি কারচি দাগি, সৈয়দ হোসেন কাজি, মির্জা মুহম্মদ ত্বকি তাবরেজি প্রমুখ। তিনি দিনে দিনে নিজেও একজন শিক্ষক হয়ে উঠেছিলেন। ইসলামী শাস্ত্র, অধ্যাত্ম ইত্যাদিতে তার ছাত্র সংখ্যাও কম না।

আলি কাদির ছাত্রদের মধ্যে আছেন আল্লামা সৈয়দ মুহম্মদ হোসেন তবাতবায়ি, সৈয়দ মুহম্মদ ইলাহি তাবরেজি, সৈয়দ হাসান মাসকাতি প্রমুখ। আলি কাদি নিজের শিক্ষা শুরু করেছিলেন তাবরেজে। ১৮৯৫ সালে তিনি নাজাফে গমন করেন। সেখানে ইজতিহাদের ওপর আরো শিক্ষা নেয়ার ইচ্ছা ছিল তার। নাজাফে তনি মুহম্মদ কাসেন খোরাসানি ও মির্জা ফতেউল্লাহ শরিয়তির অধীনে ইজতিহাদ নিয়ে পড়াশোনা করেন। ২৭ বছর বয়সে তিনি এ পাঠ শেষ করেন।

তিনি কোরআনের তাফসির নিয়ে কাজ করেছিলেন। এছাড়া লিখেছেন সামাত দোয়ার ব্যাখ্যা, বুক অব ইরশাদের সংশোধনী, ফতুহাত ও ফওসের টীকা, কোরআনের তাফসির এবং ইসলামী অধ্যাত্মবাদ নিয়ে বেশকিছু চিঠিপত্র।

ইসলামী এ পণ্ডিত নাজাফেই অবস্থান করেছেন তার জীবনের একটা বড় অংশ। সে কারণেই মৃত্যুর পর নাজাফেই সমাহিত হন। ১৯৪৭ সালে মারা যান আলি কাদি তবাতবায়ি। তাকে নাজাফে ওয়াদি আস সালামে দাফন করা হয়।

আরো একজন ইসলামী পণ্ডিত শেখ আব্দুল হোসেন আমিনি। তিনি ধর্মমতে শিয়া। তিনি কাজ করেছেন বিচার ব্যবস্থা, ধর্ম ও দর্শন নিয়ে। তার বিখ্যাত কাজটির শিরোনাম আল গাদির ফিল কিতাব ওয়াল সোন্না ওয়াল আদব।

১৯০২ সালে জন্ম আবদুল হোসেন আমিনির। তিনি আবুল হাসান ইসফাহানি, হোসেন নাইনি ও হোসেন ইসফাহানির অধীনে শিক্ষালাভ করেন। উল্লিখিত বইটি ছাড়াও তার বেশকিছু লেখাপত্র আছে। ইরানে তিনি বেশ পরিচিত। হাদিসেই বেশি আগ্রহ ছিল তার। শিক্ষার জন্য তিনি ভ্রমণও করেছেন অনেক। নানা স্থানে গেছেন। ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষকের কাছ থেকে শিখেছেন ইসলামী শাস্ত্র। ১৯৬৮ সালে তিনি তেহরানের দিকে যাওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৭০ সালে মারা যান। তাকে নাজাফে ফিরিয়ে এনে ওয়াদি আস সালামে দাফন করা হয়।

কুর্দি অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন লায়লা কাসিম। তার জন্ম ১৯৫২ সালে। ইরাকি বাথের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সর্বদা সরব। এ কারণেই বাগদাদে তাকে হত্যা করা হয়, কিন্তু তিনি কুর্দিদের মধ্যে এখনো শহীদের মর্যাদা পান। 

লায়লা কাসিমের জন্ম এক কুর্দি কৃষক পরিবারে। তিনি ও তার ভাই সিয়াকো আরবি ও কৃষি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৫৮ সালে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৭১ সালে তিনি বাগদাদে যান বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সোসিওলজি পড়ার জন্য। এ শিক্ষাই তাকে সচেতন করে তোলে এবং তিনি প্রতিবাদের পথে নামেন।

লায়লা কাসিমের যখন ১৬ বছর বয়স, সে সময় আবদুর রহমান আরিফ উৎখাত হন এবং বাথ পার্টির আবমেদ হাসান আল বকর ক্ষমতায় আসেন। এ সময়ের নৃশংস ঘটনা লায়লাকে নাড়িয়ে দেয়। ষাটের দশকে তিনি বাথ পার্টির ভয়াবহ নিষ্ঠুর আচরণ দেখতে শুরু করেন। তিনি ও তার ভাই বাথ পার্টির এসব আচরণের বিরুদ্ধে প্যামফ্লেট লেখা শুরু করেন। লায়লা সাদ্দাম হোসেনেরও বিপক্ষে ছিলেন, কেননা সাদ্দাম ছিলেন কুর্দিবিরোধী। লায়লা মূলত কুর্দিদের নিয়েই ভাবতেন।

১৯৭০ সালে লায়লা কাসিম কুর্দিদের অধিকার আদায়ে আরো কাজ করা ও সরাসরি কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যোগ দেন কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টিতে। ১৯৭৪ সালে তাকেসহ আরো চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের অত্যাচার করা হয় এবং ১৯৭৪ সালের ১২ মে তাদের বাগদাদে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। তাকে দাফন করা হয় ওয়াদি আস সালামে।

আমিনা হায়দার আল সদর ছিলেন আরেকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাকেও সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলে হত্যা করা হয়। আমিনা হায়দারের জন্ম হয়েছিল বাগদাদের কাজিমিয়ায়। তিনি ইসলাম ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন। ইরাকের নারীদের মধ্যে ইসলাম ও সচেতনতা জাগানোয় তার অবদান ছিল। কিন্তু তিনি ১৯৭৭ সালের সফর আন্দোলনে অংশ নেন। এ কারণেই সাদ্দাম হোসেনের সরকারের আমলে তাকে হত্যা করা হয়। ১৯৮০ সালে মারা যান আমিনা। তার বয়স হয়েছিল ৪২ বছর।

একই সময়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন আমিনার ভাই মুহম্মদ বাকির আল সদর। গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহ খেতাব পেয়েছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধেও একই রকম অভিযোগ তোলা হয়েছিল। কাজিমিয়ায় বাকিরের জন্ম ১৯৩৫ সালে। তিনি ছিলেন ইসলামী দাওয়া পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। আরো বিশেষ করে পরিচয় দিলে বলতে হয় মুক্তাদা আল সদরের শ্বশুর তিনি। সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে এ পরিবার বেশ সরব ভূমিকা পালন করেছিল। সে কারণেই তাদের সাদ্দাম সরকার হত্যা করে। বাকিদের মৃত্যু হয় ১৯৮০ সালে। তাকেও ওয়াদি আস সালামে সমাহিত করা হয়েছে।

এরপর আরেক গ্র্যান্ড আয়াতুল্লাহও আছেন ওয়াদি আস সালামে। ১৯৪৩ সালে জন্ম তার। ১৯৯৯ সালে ইরাকে শিয়া মতাবলম্বীদের আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম কণ্ঠস্বর। একইভাবে বাকির আল সদরের মতো তিনিও ছিলেন বাথ পার্টির রোষের শিকার। ১৯৯৯ সালে একটি হামলায় তিনি মারা যান। এর সঙ্গে তৎকালীন সরকারের যোগসাজশ আছে বলেই অনেকে অভিযোগ করেন। এ নেতারও সমাধি ওয়াদি আস সালামে।

মাহমুদুর রহমান: লেখক ও সাংবাদিক


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৮১৮০১৯৩-৪ (বিজ্ঞাপন), ৮১৮০১৯৬-৭ (সার্কুলেশন)

ই-মেইল: [email protected]