শান্তির উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ

প্রকাশ: অক্টোবর ০১, ২০২৪

ফাহাদ হৃদয়

পার্থিব দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার পর যেখানে স্থান হয় আমাদের নশ্বর দেহের তার নাম কি শান্তির উপত্যকা হতে পারে? যেহেতু জাগতিক সব বিবাদ, প্রত্যাশা ও কর্মযজ্ঞ থেকে মুক্ত হয়ে কবরই হয় আমাদের শেষ আশ্রয়, সেহেতু এক অর্থে তাকে শান্তির জায়গাও বলা যেতে পারে হয়তো। শান্তির জায়গা হোক বা না হোক বিশ্বের সবচেয়ে বড় কবরস্থানটি মুখোমুখি হয়েছিল একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে সংঘাতময় কিছু সময়ের।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় কবরস্থান ‘ওয়াদি আস সালাম’ অবস্থিত ইরাকের নাজাফে। এ কবরস্থান ভ্যালি অব পিস বা শান্তির উপত্যকা নামেই পরিচিত। বিশেষ করে ইরাক ও ইরানের শিয়া মতাদর্শী মুসলিমদের কাছে স্থানটি যথেষ্ট পবিত্র। একাধিক নবী, খলিফা ও ইসলামের নামকরা কিছু সাহাবির কবর আছে বিশাল এ এলাকায়। প্রায় ৬০ লাখের কাছাকাছি কবর আছে সাত বর্গমাইলের বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ওয়াদি আস সালামে। ধারণা করা হয় ইরাক ও ইরানে বসবাসকারী শিয়া মুসলিমদের প্রত্যেকের কমপক্ষে একজন আত্মীয়র মরদেহ শায়িত রয়েছে এ কবরস্থানে। তবে স্বাভাবিক সময় হওয়া শেষকৃত্যের চেয়ে অনেক বেশি মরদেহ দেখেছে এ কবরস্থান ২০০৩ সালে শুরু হওয়া রক্তক্ষয়ী ইরাক যুদ্ধের সময়।

ইরাক যুদ্ধ বা দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধ ২০০৩-১১ সাল পর্যন্ত ইরাকে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী এক ইতিহাসের নাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সশস্ত্র জোট সাদ্দাম হোসেনের বাথবাদী সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে ইরাক আক্রমণ করার মাধ্যমে এ যুদ্ধ শুরু হয়। মার্কিন জোট এবং আক্রমণ-পরবর্তী ইরাকি সরকারের বিরোধিতা করে পরে ইরাক ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী জেগে উঠলে সংঘাতটি পরবর্তী প্রায় এক দশক দীর্ঘায়িত হয়।

২০০৩ সালের ১৯ মার্চ আমেরিকান সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সশস্ত্র বাহিনী ইরাক আক্রমণ করে। আক্রমণ প্রায় টানা এক মাস চলেছিল। শুরুর এক মাসের যুদ্ধে একপক্ষে ছিল ইরাকি সেনাবাহিনী ও অন্যদিকে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও পোল্যান্ডের সম্মিলিত বাহিনী। যুদ্ধ প্রাথমিকভাবে শেষ হয় ১ মে, ২০০৩। এদিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ যুদ্ধ সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এরপর গঠিত হয় কোয়ালিশন প্রভিশনাল অথোরিটি (সিপিএ), যা সক্রিয় ছিল জানুয়ারি ২০০৫-এ পরবর্তী ইরাকি জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ২০১১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইরাক থেকে প্রত্যাবর্তন করে।

এদিকে মার্কিন জোটের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিদ্রোহে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া বা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড আল শাম (আইএস) নামে পরিচিত দলটির উত্থান একটু ভিন্নভাবে। ১৯৯৯ সালে এ গোষ্ঠী জামাত আল তাওহিদ ওয়াল জিহাদ নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং ২০০৪ সালে তানজিম কাইদাত আল জিহাদ ফি বিলাদ আল রাফিদাইন বা সাধারণভাবে আল কায়েদা ইরাক (একিউআই) নামে নাম বদল করে। এ সময় তারা আল কায়েদার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা ও মিত্রতা স্বীকার করে। ২০০৩ সালে আমেরিকা নেতৃত্বাধীন জোটের ইরাক আক্রমণের পর তারা জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। ২০০৬ সালে সংগঠনটি আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী মুজাহিদিন শুরা কাউন্সিলের সঙ্গে যোগ দেয় এবং পরে তারা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক (আইএসআই) নামক ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেয়। মার্কিন জোটবিরোধী অবস্থানের কারণে আইএসআই ইরাকের আল আনবার, নিনেভেহ, কিরকুক ও অন্যান্য স্থানে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। তবে ২০০৮ সাল নাগাদ তাদের আত্মঘাতী হামলাসহ অন্যান্য সহিংসতার কারণে সুন্নি ইরাকি ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।

২০১৪ সালের জুনে দলটি তাদের নাম বদলে ইসলামিক স্টেট (আইএস) রাখার পর এটি আইএস নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে।

আমেরিকান জোট ইরাক আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে যা উল্লেখ করেছিল তা ছিল সাদ্দাম হোসেনের শাসনের অবসান, ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র ও অস্ত্রের উৎস শনাক্ত করা, বিচ্ছিন্ন করা এবং নির্মূল করা, ইরাকে অবস্থানকারী উগ্র জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সন্ধান করা, ধরা এবং তাড়িয়ে দেয়া, অভাবী ইরাকি নাগরিকদের কাছে মানবিক সহায়তা প্রদান করা, ইরাকের তেলক্ষেত্র ও সম্পদগুলোকে সুরক্ষিত করা এবং ইরাকি জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক নতুন সরকার গঠনের পরিস্থিতি তৈরি করতে সহায়তা করা।

কিন্তু আক্রমণ-পরবর্তী সময়ে সাদ্দাম হোসেনের সরকার পতনের পর সাদ্দামের অনুসারী বাথ পার্টির সদস্য, দখলদারত্বের ওপর বিরক্ত ইরাকি জনগণ এবং ধর্মীয় উগ্রবাদিতার প্রভাবে প্রভাবিত মানুষসহ অনেকেই মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে (পাশাপাশি নিজেরা নিজেদের মাঝেও) বিদ্রোহ ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ সংঘাতে সবচেয়ে সশস্ত্র ভূমিকা পালনের মাধ্যমে ইসলামিক স্টেট নামক গোষ্ঠীটির উত্থান ঘটে।

নাজাফের বাসিন্দাদের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষার নাম ছিল সম্ভবত ২০০৪ সালের আগস্টে সংঘটিত নাজাফের যুদ্ধ। যুদ্ধ দুই ভাগে সম্পন্ন হয় শহরের দুই অংশে, যার এক অংশে ছিল মার্কিন জোটের বিরুদ্ধে ইরাকি বাহিনী। অন্য অংশে মার্কিন জোটের বিরুদ্ধে ছিল মুক্তাদা আল সদরের নেতৃত্বে মাহদি বাহিনী। এ মাহদি বাহিনীর অন্যতম মিত্র ছিল তানজিম কাইদাত আল জিহাদ বা বর্তমান আইএস।

যুদ্ধ শুরুর ১ ঘণ্টার মাঝেই মার্কিন সেনারা ৭০ জন বিদ্রোহীদের হত্যা করার দাবি করলেও মাহদি আর্মির সদস্যরা ক্রমাগত ওয়াদি আস সালাম কবরস্থান থেকে অস্ত্রের সাপ্লাইসহ বেরিয়ে আসছিল ও পাল্টা আক্রমণ জারি রাখছিল। মূলত বিশাল এ কবরস্থানের মাঝেই তখন বাংকার খুঁড়ে অস্ত্রসহ নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিল মাহদি বাহিনী।

হিজবুল্লাহ আল নুজাবার প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা আকরাম আল কাবি পরবর্তী সময়ে দাবি করেছিলেন আইআরজিসি এবং লেবানিজ হিজবুল্লাহ এ যুদ্ধে মাহদি আর্মিকে সহযোগিতা করেছে। তিনি বলেছিলেন, আইআরজিসি (ইরানি বিদ্রোহী গোষ্ঠী) ও হিজবুল্লাহ অফিসাররা যুদ্ধের সময় কবরস্থানের পাশে উপস্থিত ছিলেন এবং মাহদি বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করছিলেন। আগস্টে এ অঞ্চলে প্রচুর সংঘর্ষ হয়। ভারী মেশিনগানের গুলি ও মর্টার শেল পড়তে শুরু করে। বিশাল কবরস্থানটি বহু শতাব্দী ধরে স্তরে স্তরে তৈরি হওয়ার ফলে মাটির নিচে অনেক এলাকাজুড়ে সমাধি, সুড়ঙ্গ ও স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, যার অনেকগুলো প্রায় দুইতলা সমান লম্বা। মার্কিন সেনারা পরে দাবি করেছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এ প্রথম তারা এত বড় মাটির নিচের সুড়ঙ্গে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছেন। বিস্তৃত এলাকাজুড়ে মাটির ওপর ও নিচে এ লড়াই চলেছিল প্রায় ২২ দিন। ২৭ আগস্ট দুই পক্ষের মাঝে সমঝোতা চুক্তি হওয়ার পর যুদ্ধের অবসান ঘটে। 

যুদ্ধের সময় বিদ্রোহী মাহদি বাহিনীর RPG ফায়ার দ্বারা অর্ধ ডজন ইউএস অ্যাব্রাম ট্যাংক ও ব্র্যাডলি ফাইটিং যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বেশি বস্তুগত ক্ষতির শিকার হয়েছিল সম্ভবত ঐতিহাসিক ওয়াদি আস সালাম। যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়া কবরস্থানটির এক পাশের বেশকিছু অংশ গোলার আঘাতে নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মরদেহ ও কবরের ক্ষয়ক্ষতিও ঘটে। বিষয়টি মুসলিম বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে শিয়া মুসলিমদের মনে কবরস্থানের পবিত্রতাকে নষ্ট করার একটি চেষ্টা হিসেবে দেখা দেয়। মার্কিন সেনাবাহিনীর সমালোচনার পাশাপাশি যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করে কবরস্থানের ন্যায় পবিত্র জায়গার সম্মানহানি করেছে মাহদি বাহিনী এমন অসন্তোষ দেখা দেয় মানুষের মনে। ফলে পরে আইএস ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর প্রতি সুন্নি মুসলিমদের নেতিবাচক চিন্তাধারা গড়ে ওঠে।

ইরাক যুদ্ধ চলাকালীন প্রতিদিন এ কবরস্থানে প্রায় ২০০ জনকে সমাহিত করা হতো। ইরাকি মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, এখানে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ শিয়া মুসলমানদের সমাহিত করা হয়েছে ওয়াদি আস সালামে। বিদ্রোহ-পরবর্তী সময়ে আইএসের সহিংস কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার ফলে এখানে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে বলে দাবি করা হয়েছে ২০০৮-এর পরবর্তী সময়ে। ২০১৪ সালে আইএসের তৎপরতার সময় মরদেহের সারি এতটাই দীর্ঘ হচ্ছিল যে গোরস্তানের জায়গায় ঘাটতি দেখা দেয়। আইএসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে প্রায়ই সৈনিকরা এখানে এসে প্রার্থনা করতেন যেন তাদের মৃত্যুর পর এখানে সমাহিত করা হয়। গোরখোদকের সাক্ষ্য ছিল, ‘আমরা কখনো এতটা ব্যস্ত সময় কাটাইনি। এমনকি ২০০৩ কিংবা ২০০৬ সালের পরও না।’

ফাহাদ হৃদয়: প্রতিবেদক, বণিক বার্তা


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৮১৮০১৯৩-৪ (বিজ্ঞাপন), ৮১৮০১৯৬-৭ (সার্কুলেশন)

ই-মেইল: [email protected]