বারানির রাজনৈতিক দর্শনে ভাষার বিনির্মাণ

প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪

ইমরান নাফিস

প্রাক-মোগল ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও উল্লেখযোগ্য যে কজন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক চিন্তক ছিলেন জিয়াউদ্দিন বারানি তাদের অন্যতম। তিনি শুধু তার পূর্বসূরিদের জ্ঞানে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি, বরং ভারতে ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় শরিয়াহসংক্রান্ত আলোচনাকে উন্নত ও যুগোপযোগী করতে নিজস্ব চিন্তাভাবনার অবতারণা করেন। তার চিন্তাভাবনা পূর্বসূরি ও সামসাময়িকদের থেকে স্বতন্ত্র।

বারানিকে প্রাথমিকভাবে মূল্যায়ন করতে গেলে ফতোয়া-ই-জাহান্দারি নামক গ্রন্থটি সহায়ক হতে পারে। যদিও ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয়ে লেখা কিতাবাদি পড়া ব্যতিরেকে তার সম্পূর্ণ মূল্যায়ন কষ্টকর। বারানি তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরতে প্রতিটি বিষয়বস্তুকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটি অংশে বিভক্ত করেন। প্রতিটি অংশই পরস্পর সহায়ক ও সম্মিলিতভাবে বারানির রাজনৈতিক সংলাপকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে। তিনি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক উপাদান নির্বাচন করে তৎকালীন শাসনসংক্রান্ত সমস্যাবলির সঙ্গে ইসলামী শরিয়তের আবশ্যক দিকগুলোর তাত্ত্বিক মেলবন্ধন ঘটান। 

বারানিকে শুধু একজন সাধারণ লেখক হিসেবে বিবেচনা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তিনি তার সময়ে একজন শিক্ষিত ইতিহাসবিদ ও তাত্ত্বিক ছিলেন। তিনি সভাসদ ও সঙ্গী হিসেবে প্রাক-মোগল আমলের অত্যন্ত বিচক্ষণ শাসক মোহাম্মদ বিন তুঘলগের সহবত পেয়েছিলেন। তিনি একটা ঘটনার কোন তথ্য ইতিহাসে ঠাঁই পাবে আর কোনটা হারিয়ে যাবে এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতেন। নবী মোহাম্মদ (সা.)-এর সিরাত সংকলন, আব্বাসীয় বারমাকি উজিরদের নিয়ে আরবি ইতিহাসের ফারসি অনুবাদসহ অনেক কিতাব বারানি রচনা করেন। ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থে অতীতের ঘটনাগুলোকে কীভাবে গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করবেন তা নিয়ে খুবই সতর্ক ছিলেন। বারানি ইতিহাসের নিজস্ব সংস্করণ তৈরি করে নায়ক ও খলনায়ক চরিত্র নিজের ইচ্ছেমতো আরোপ করেন। তিনি খলিফা আল মামুনকে সুন্নি ইসলামের সংরক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করেন। মুতাজিলা সম্প্রদায়ের সঙ্গে আল মামুনের সম্পর্কের কোনো কথা বারানি বিশ্বাস করেননি, বরং আল মামুনকে সুন্নি ইসলামের নায়ক ও ইসলামী সোনালি যুগের রাহবার হিসেবে ঘোষণা দেন।

বারানি গজনীর সুলতান মাহমুদকে নির্লোভী, পৌত্তলিক নির্মূলে আত্মপ্রত্যয়ী ও পরম এক ধার্মিক চরিত্র দিয়ে প্রকাশ করেন। বারানির সুলতান মাহমুদ মোতাজিলা ও দার্শনিককে ঘৃণা করতেন। সুলতানের ধারণা এরা মিথ্যা তথ্য ছড়ায় এবং সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে দেয়। সুলতান মাহমুদকেন্দ্রিক বারানির তথ্যাদি অনেকটাই অতিরঞ্জিত। ফতোয়া-ই-জাহান্দারিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, একটা ইসলামিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক যেমন হওয়া উচিত সুলতান মাহমুদ তেমনই একজন।

বারানির মতে, একজন মুসলিম শাসক কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ফতোয়া-ই-জাহান্দারিতে পাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য কাহিনীতে বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। কাহিনীটি মূলত ইসলামী দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রসঙ্গে। প্রথমজন ইয়াকুব আল-লাইস আল-সাফার, যিনি সাফারীয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা ও অন্যজন সামানি শাসক ইসমাইল সামানি। বারানির মতে, ইয়াকুব মুসলিম শাসকের প্রকৃত আদর্শ ধারণ করেননি, কারণ তিনি বাগদাদের খলিফার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেন। বিপরীতে ইসমাইল সামানিকে প্রশংসনীয় মুসলিম নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যিনি ইয়াকুবের হুমকি থেকে খলিফা ও রাজধানী শহরকে উদ্ধার করেছিলেন।

বারানি মুসলিম বিশ্বে অ-ইসলামী, আধিপত্য পরম্পরা পরায়ণ ও অভিজাত সাসানীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রভাব নিয়ে অস্বস্তি ও চিন্তিত ছিলেন। ধারণা করা হয় তার ধর্মনিরপেক্ষতার যে বয়ান সমাজে প্রচলিত তার পেছনে এ অনৈসলামিক রাষ্টীয় কাঠামোর অনুপ্রবেশের চিন্তাই দায়ী। বারানি প্রথাগত শরিয়তের প্রতি একনিষ্ঠ থাকার পাশাপাশি বাস্তব সামাজিক সমস্যাগুলোর দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাতেও সক্রিয় ছিলেন। অতীতে অনেক তাত্ত্বিকরাই রাজনৈতিক আদর্শে অনৈসলামিক উপাদানগুলোর সম্মুখীন হলে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণ করতেন অথবা শরিয়তের পুনর্ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বারানি শরিয়তসম্মত নয়, এমন সবকিছু সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে এ সমস্যার প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি ইরানের শাসনপদ্ধতি বা পাদশাহি নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন। তিনি সেটাকে একটি পাপ হিসেবে দেখেন। তিনি বিশ্বাস করেন, যে শাসক এ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেও একজন পাপী। যদিও তিনি পরে বলেছেন একজন শাসক যে শুধু ভালোভাবে তার দেশ শাসন করতে চায়, সে প্রাচীন ইরানি রাজাদের নীতিকে বিবেচনা করতে পারে। তবে নবীর ঐতিহ্য ও ইরানি সম্রাটদের জীবনধারার মধ্যে একটি বিরাট দ্বন্দ্ব থাকায় যদি কোনো মুসলিম শাসক এ দ্বন্দ্ব প্রথাগুলো গ্রহণ করার চেষ্টা করে, তাহলে তা আইনের পরিপন্থী বলে পরিগণিত হবে।

বারানি তার রচনায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন। প্রথমত, তিনি সুলতান শামসউদীন ইলতুতমিশকে শায়খ নুর আল-দীন মুবারক গজনভির দেয়া উপদেশ ও উপদেশের কথা উল্লেখ করেন। শায়খ সুলতানকে তাকওয়া ও প্রার্থনার ব্যক্তিগত কাজের চেয়ে শরিয়াহ কার্যকর করার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানান। দ্বিতীয়ত, যদিও বারানির আলাউদ্দিন খলজি সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, তাও তিনি তার রাজত্বের প্রশংসা করেন। তিনি বিশ্বাস করেন শেখ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার উপস্থিতির কারণে এটি সৌভাগ্যজনক ছিল। উপরন্তু, বারানি প্রশংসা করেন কীভাবে সুলতান আলাউদ্দিন শক্তিশালী শত্রুদের পরাজিত করে দিল্লিকে একটি সম্মানিত কেন্দ্রে পরিণত করেছেন।

জিয়াউদ্দিন বারানি স্পষ্টভাবে রাজনীতিকে ধর্ম থেকে আলাদা করেন, যা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নমনীয়তার পথ রুদ্ধ করে। তিনি শাসন করার একটি কঠোর ও কিছুটা অবাস্তব কাঠামোর রূপরেখা দিয়েছে, যা মূলত সত্যিকারের মুসলমান নির্দেশ করবে। তিনি বিশ্বাস করেন ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাস তার রাজনীতিকে খুব সহজে প্রভাবিত করে। মুসলমানদের স্বতন্ত্র ইসালামভিত্তিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকাটা প্রশংসনীয়। মুসলিম নেতৃত্ব সত্যিকার অর্থে জনগণের কাছে ন্যায়বিচার দিতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন ন্যায়বিচার চাওয়া অপরিহার্য। রাজা যখন বিশ্বস্তভাবে ধর্মীয় আদেশ মেনে চলেন, তখন ন্যায়বিচার অর্জিত হয়।

প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের মতো গ্রিক দার্শনিকদের প্রভাবকে বারানি স্বীকার করেন। তিনি সাসানীয় শাসক নওশেরওয়ানের ন্যায়বিচারের গল্প উল্লেখ করে ইসলামের দ্বিতীয় ধর্মপ্রাণ খলিফা উমর বিন আল-খাত্তাবের ন্যায়বিচারের গল্পগুলো উল্লেখপূর্বক এর ন্যায্যতা বজায় রেখেছেন। বারানি দুই ধরনের ন্যায্যতার কথা আলোচনায় এনেছেন। প্রথমত, সর্বজনীন ন্যায্যতা, যা শাসক-শাসিতের মাঝে কোনো সীমানা থাকবে না বলে স্বীকৃত। দ্বিতীয়ত, সম্রাট নওশেরওয়ানের উল্লেখ করে সীমিত ন্যায্যতার মাপকাঠি আলোচিত হয়। সীমিত ন্যায্যতা বলতে রাজদরবার কর্তৃক পরিচালিত চাহিদানির্ভর ন্যায্যতা।

বারানি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, রাজনৈতিক অসুবিধার কারণে মুসলিম শাসকরা যখন শরিয়তের বিধিবিধান সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে অক্ষম হয়, তখন রাজনৈতিক সুবিধার নিশ্চিতকরণে ধর্মনিরপেক্ষতা ন্যায্যতা পাবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য হবে শরিয়াকে শক্তিশালী করা এবং শরিয়ার পরিপূরক হওয়া। ব্যক্তির জন্ম, পারিবারিক পটভূমি ও সামাজিক শ্রেণীর মতো বিষয়গুলোয় বারানি অনেক বেশি গুরুত্ব দেন, যা সাধারণত তার রাজনৈতিক ধারণার ধর্মনিরপেক্ষতা জানান দেয়। কেউ কেউ মনে করে, নেতৃত্বের গুণাবলি শেখা দক্ষতা নয় বরং জিনগত ব্যাপার। তিনিও বিশ্বাস করেন সাসানীয় রাজবংশ দীর্ঘস্থায়ী ছিল, কারণ তারা তাদের কর্মকর্তাদের নিয়োগকালে বংশগত পরিচয়কে গুরুত্ব দিত।

তিনি লক্ষ করলেন, যে সময়ের মধ্যে মুসলিম শাসন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হওয়ার কথা ছিল, সে সময় মুসলিম পরিবারগুলো ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলেন বংশগতি এখানে একটা বড় সংকট তৈরি করে রাখে। একমাত্র বংশগতির চাকার দিকে মনোযোগ দিলে পারিবারিক আত্মবিশ্বাস ও মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কাঠামো পোক্ত হবে। তিনি একটি দীর্ঘ অনুচ্ছেদে এ বিশ্বাসের ওপর জোর দেন, যা একটি হৃদয়গ্রাহী উপদেশের মতো শোনায়, যেখানে তিনি যুক্তি দেন যে নেতৃত্বের ক্রমাগত পরিবর্তন মহান মুসলিম পরিবারের পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

এটা স্পষ্ট যে এ উপরোক্ত ধারণাগুলো সম্ভবত উত্তর ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রাথমিক তুর্কি শাসকদের নীতিতে খুব কম প্রভাব ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ যুক্তি দিয়েছিলেন মুসলিমরা এখনো খুব দুর্বল। গিয়াসউদ্দিন বলবন দিল্লির রাজনীতিতে প্রথমে অভিজাত দলের নেতা এবং পরে সুলতান হিসেবে আসীন হন। বারানির মতো ধর্মতাত্ত্বিক ও তাত্ত্বিকদের তিনি হাতের নাগালে রেখেছিলেন। সিকান্দার লোদিও রাষ্ট্রীয় কাজে আরো ভালোভাবে জড়িত হওয়ার জন্য অমুসলিমদের ফারসি শিখতে উৎসাহিত করেছিলেন। এভাবে বারানির ‘ফতোয়া-ই-জাহান্দারি’র মধ্য দিয়ে বারানি যে ভাষা নির্মাণ করেছেন, তা সুলতানি আমলের ভারতীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।

মুজাফফর আলমের ‘The Languages of Political Islam in India’ অবলম্বনে।

ইমরান নাফিস: লেখক 


সম্পাদক ও প্রকাশক: দেওয়ান হানিফ মাহমুদ

বিডিবিএল ভবন (লেভেল ১৭), ১২ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫

বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ফোন: ৮১৮০১৯৩-৪ (বিজ্ঞাপন), ৮১৮০১৯৬-৭ (সার্কুলেশন)

ই-মেইল: [email protected]